গল্প: মজনু
অন্ধকারে মিটিমিটি আলো জ্বলে। কালা কুচকুচা একটা মেয়ে বিড়াল মেউ মেউ করে হুট করে দৌড় দেয়। মনে হয় কেউ বিড়ালটাকে দৌড়ানি দেয়। বিড়ালটা হারিয়ে যায় অন্ধকারে।
ঝি ঝি পোকা ডাকে। মনে হয় তাদের নিশ্বাস নেয়ার প্রয়োজন হয় না। কিংবা ঝি ঝি করে ডাকাটাই তাদের নিশ্বাস নেয়া।
মাঝে মাঝে দূর থেকে কান্নার আওয়াজ আসে। গোঙানো কান্না। শুনশান নিরবতার মাঝেও পাহারাদার নিরবতা ভাঙতে চায় তার বাঁশির আওয়াজ দিয়ে। হঠাৎ পাতা ভেঙে যাওয়ার আওয়াজ আসে। মনে হয় কেউ হেঁটে যাচ্ছে।
দূরে দেখা দেয়া যায় শুধু ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধুমাত্র হাঁটার জায়গাটাতেই আলো পড়ছে মিটিমিটি। এর মাঝেই মজনু তার বন্ধুদের সাথে গাঁজা টানে। মজনু গাঁজা টানে জোরে। ভটভট করে ধোঁয়া বের হয় নাক-মুখ দিয়ে। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে- আহ্ আসমান! কত ব-ব-ড়।
দুইহাত দুইপাশে দিয়ে বলে- আয় আসমান মোর কুলে আয়।
পাশ থেকে মজনুর বন্ধু বাপ্পি বলে- মজু চুপ কর শূয়োরের বাচ্চা। কিসমত পাগলা শুনলে আইয়া পরবো।
কিসমত পাগলা কবরস্থানের মালি।কিসমতের কাজ কেচি দিয়ে ঘাস কাটা। কোনো কবরে ফাটল ধরলে অফিসে জানানো। লোকে বলে- কিসমত আগে সুস্থ ছিল। পরে নাকি কোন এক লাশকে কবর থেকে বের হতে দেখেছে। এরপর থেকে কিসমত পাগল হয়ে গেছে।
আবার অনেকে বলে- বছরের পর বছর কিসমত কবরে থাকতে থাকতে সে মানুষ নামের অর্থ বোঝে না। তার কাছে সব মানুষই একটা ভবিষ্যত লাশের মতো। আজকে তাজা কালকা লাশ। কিসমত লাশ দেখলে চিল্লায়া উঠে।
তবে কিসমত ঠিক কবে কোনো লাশকে জীবিত দেখেছে তা কেউ বলতে পারে না। মজনু ছোটবেলা থেকে কিসমত পাগলারে পাগলা হিসেবেই চিনে।
ছোটকালে মজনু তার বাবার সাথে কবরে আসতো দাদার কবর জিয়ারত করতে। মজনু তখনও কিসমত পাগলারে চিনতো। সারাদিন কেচি হাতে কিসমত এদিক সেদিক ঘুরতো। কাউরে দেখলে হাত উচাইয়া বলত- আ-স-সা-লা-মু-আ-লাই-কুম।
কেউ কেউ ভয় পেতো। কেউ কেউ পেতো না। যারা ভয় পেতো তাদের দিকে কিসমত তার কালা দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলতো- ট্যাকা দিবি? ভাত খামু।
তখন যারা ভয় পেতো। তাড়াতাড়ি টাকা বের করে কিসমতের হাতে দিয়া দিতো।
মজনুও ছোটবেলা থেকে কিসমতকে ভয় পায়। এখনও এই ২৬ বছর বয়সেও মজনু কিসমতরে দেখলে পলায়।
একবার এক ভদ্দর লোক বলছিল- কিসমত নাকি পাগলার অভিনয় করে। আসলে কিসমত সুস্থ। পাগলের অভিনয় কইরা নাকি কিসমত লাশের কিডনী-চোখ বেইচা দেয়। হইতে পারে ভদ্দর লোক কিসমতের ব্যবসার পার্টনার। হইতেও তো পারে!
মজনু ফিসফিসাইয়া বাবলুরে প্রশ্ন করে- ‘বাজে কয়ডা?’
বাবলু উত্তরে বলে- রাত হইছে। ঘড়ি দেখি না। চুখ লাফায়। কাটা লাফায়।
মজনু বলে- বান্দির পুত। বাড়ি যাইতে হইবো। মায় আ-য়া পরছে।
বাবলু হাসে আর বলে- তোর মায়ে রুজ রাতে কাম কইরা ঘরে আসে। তুই তো ঘরের মইধ্যেই গানজা খাইবার পারস।
মজনু কয়- না। ঘরে খামু না। মায় আইলে গন্ধ পাইবো। আমার পাপ মায়ে শুকবো কে!!
মজনু নেশা নিয়া হাটা দেয় ঘরের দিকে।
রাস্তা দিয়া হাটার টাইমে হেলে দুলে পড়ে। মাথায় চক্কর দেয়। মনে হয় গোটা রাস্তাটাই লাফায়। তাও মজনু গান গায়। ভাবের গান- 'টাইম হইলে যাইতে হবে যাওয়া ছাড়া নাই উপায়'।
ঘরের কড়া নাড়ে মজনু। ভেতর থেকে মা দরজা খুলে।
চটাস কইরা একটা থাপ্পড় দিয়া মা বলে- হারামি। তোর মতো পোলা দেখলে আমার পেটটা কাইটা ফালাইতে মন চায়। হারামির পোলা। বাপ খাইছে ১৪ বছর। এবার তুই খা। হারামির পোলা হারামি।
মজনু তার অপরাধ বোঝে। অপরাধীর মতো তার রুমের দিকে হেটে যায়। মজনুর মা পিছে পিছে যায়।
ঝুপড়ির মতো ঘর। দুই রুমের এই ঘরে তারা মা-ছেলে থাকে। ঘরে তেমন কিছু নাই। এক ঘরে আদি যুগের নষ্ট এক টেলিভিশন পড়ে আছে। আর একটা বিছানা। তাও এক পা ভাঙা। সেই ভাঙা পা-তে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে এক চেয়ার। ঘরে এই একটা মাত্র চেয়ার ব্যবহার হচ্ছে খাটটা দাড়া করিয়ে রাখার কাজে।
অন্য রুমে মজনু থাকে। দেয়ালে সাদাকালো তার বাবার ছবি। মাটিতে বিছানা পাতানো। অপরিস্কার রুম। মা মাঝে মাঝে বলে- ঘরটারে বানাইছস হাগার খানা।
মজনু মাটিতে ধড়াম করে তার নেশাগ্রস্থ দেহটারে লুটায়া দেয়। মা বলে- খাবি না?
মজনু উত্তরে বলে- খাইছি।
মা বলে- খাইছস্ তো ধুয়া। ভাত খা। পেটে কিছু দে। নাইলে মইরা যাবি।
মা কাঁদে। মজনুর কানে কান্নার আওয়াজ যায়। মজনু শুনতে পায় মায় চিল্লায়। কিন্তু শক্তি নাই। সারাদিনের খিদার শরীরে মজনু শক্তি হারায়। মারে মজনুর জড়ায়া ধরতে মন চায়। চোখের পানি মুছে দিতে মন চায়। কিন্তু মজনু পারে না। নেশার ভেতর মজনু সব চেতনা হারায়।
২.
সকালে দুইটা রুটি একটা কলা দিয়া মজনু নাস্তা করে। কোনো সকালে মায়ের সাথে মজনুর দেখা হয় না। সকালে উইঠা দেখে মা চলে গেছে গার্মেন্সে। গার্মেন্সের শ্রমিক হইয়া এই মহিলা কাটাচ্ছে দীর্ঘ ১৩ বছর। তার মইধ্যে ৬/৭ বছর আগে বাপ ঘর থেকে পালায়া গেছে। কোথায় গেছে মজনু জানে না। এখনকার মতই এক সকালে মজনু উঠে দেখে মা ঘরে। মজনু তখন মারে প্রশ্ন করে- মা, কামে যাও নাই?
মা ধীরে ধীরে বলে- নাহ।
মজনু প্রশ্ন করে- কেন্? যাও নাই কেন্?
মা বলে- তোর বাপ রাইতে ঘরে আসে নাই।
মজনু হাসতে হাসতে তখন বলে- হ্। আইবো ক্যা? তোমার অত্যাচারে ব্যটা ভাগছে।
মা তখন কান্দে। মজনু কান্নার কোনো পাত্তা দেয় না। কারণ মজনু ভেবেছিল বাপ ফিরে আসবে। কিন্তু আসে নাই। গত ৬ অথবা ৭ বছর হয়ে গেছে। মজনুর বাপ আসে নাই। তাই সেদিন মায়ের কান্নার পাত্তা দেয় নাই বলে মজনু এখনও অপরাধবোধে ভোগে। মনে হয়, মায়ের কষ্টে মজনু মজা নিছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়- মজনু তার মায়ের পা ধরে ক্ষমা চাবে। কিন্তু পারে না।
মজনু অশিক্ষিত। মূর্খ। পড়াশোনা করেছে ক্লাস নাইন পর্যন্ত। এরপর সৌদি যাইবো বইলা আর পড়ে নাই। পরে জড়ায়া গেছে নেশার জগতে। নেশাই হয়ে গেছে মজনুর পেশা।
নেশা করে। খায়। আর ঘুমায়। এইভাবে মজনু দিন কাটায়।
মজনু কবরস্থানে নেশা করে। রাত ৯টার পর থেকে নেশার টাইম। তখন কবরস্থান ফাকা থাকে। লোকজন কম থাকে। অন্ধকারে কোনো এক চিপা খুইজা মজনু গাজায় টান লাগায়। কবরের নিস্তব্ধতায় গাজাখোরগুলা হাসে আর কান্দে। তারা ফিসফিসিয়া কথা বলে। কারণ মজনু কিসমতরে ভয় পায়। কিসমত হলো কবরস্থানের মালি। তার হাতে কেচি থাকে। মজনুর ধারণা হইল- কিসমত দেখলে তার পেট কেচি দিয়া ফাইরা ফালাবে।
আজকে যেই কবরের সামনে তারা গাজা ধরিয়েছে। সেই কবরের বয়স অনেক। বাবলু পড়ে। মো:আকতার উজ জামান। মৃত্যু সাল- ১৯৫৭।
মজনু বলে- শালায় বহুত আগে মরছে।
বাবলু খেপে। বলে- হারামি। কবরের মাইনষেরে গালি দেস। অমানুষ।
মজনু হাসে আর বলে- এহ্। আইছেন আমার মানুষ। কবরে খারায়া মুতস। গানজা খাস। আর আমি শালা কইছি দেইখা দোষ হইয়া গেছে!
আড্ডার সকলে হাইসা উঠে। মজনু ভড়কাইয়া যায়। কারণ তখন কিসমত চিল্লায়া উঠে- আইজকা মানুষ। কাইলকা লাশ। আইজকার মানুষ ভবিষ্যতের লাশ।
মজনু এদিকসেদিক তাকায়া বলে- ব্যাটা কইছি আস্তে কথা ক। নাইলে কিসমত পাগলা পেট ফাইরা ফালাইবো। তারা এদিক সেদিক তাকায়। দেখে কিসমত আসে নাকি!
একসময় তারা অনেক মানুষের দৌড়া-দৌড়ির আওয়াজ শুনতে পায়। তারা তখন আরেক কবরের আড়ালে লুকায়। কবর থেকা বিদঘুটে গন্ধ বের হয়। মনে হয়- নতুন লাশ। ১৫-২০ দিনের কবর থেকে লাশ পচা গন্ধ আসে। মজনু টিকতে পারে না। ভটভটায়ে বমি কইরা দেয়। বাবুল চুপ মাইরা বইসা আছে। তারা দেখে, কিসমতের সাথে কিছু লোক অন্ধকারে কথা কয়। মানুষগুলার মুখ ঢাকা। দেখা যায় না। কিসমত তাদের অন্যদিকে নিয়া যায়। কিসমতরে একদম সুস্থ মনে হয়। মনে হয় না সে পাগল। তার হাটার গতি দ্রুত। মনে হচ্ছে এখনই দৌড়াবে।
বাবলু বলে- চল্ তো কাহিনীডা দেইখা আসি। মজনু বলে- তুই যা। আমি পারুম না।
বাপ্পি মজনুরে ধরে। বলে- চল্ দোস্ত। আজকা দেখি তোর কিসমত পাগলারে। তারা এরপর ধীরে ধীরে এগোয়। দূর থেকে দেখে টর্চের আলো দিয়া এক কবর থেকে লাশ উঠানো হচ্ছে। সাদা কাপড়ে হালকা কাদার দাগ। কিসতম তার ধারালো কেচি দিয়া পুরা পেট কাইটা ফেলল। এরপর মজনুর আর সহ্য হলো না।
৩.
চোখ খুলে দেখে মা পাশে। বাবুলও আছে।
মায়ের বিছানায় শুয়ে আছে মজনু। মা বলে- এতো কইরা কই গানজা ছাড়। কাম কর। কাম কইরা আমারে একটু শান্তি দে। তা না। তুই গানজা খাবি। আর কত্ত জালাবি তুই?
মজনুর তখনও ইচ্ছা হয় মারে জাড়ায় ধরতে। মজনু পারে না।
সেইদিন মজনুর মনটা ভালো থাকে না। গানজাও খাইতে যায় না। কারণ, মা অসুস্থ। মারে একা ঘরে রাইখা মজনু গানজা টানতে যাবে না। মজনুর মা ঘুমায়। নিবিড় নিদ্রায় হারায়া আছে মা। মজনু মায়ের কপালে হাত বুলায়। মা ঘুমায়। মজনু মায়ের কপালে চুমু খায়। তাও মা ঘুমায়।
একসময় মজনু ঘুমায়া যায়। সকালেও মা ঘুমায়। মজনু বোঝে মা এক্কেবারে ঘুমায়া গেছে।
মারে যখন কবর দেয়। মজনুর তখন ইচ্ছা হয় মারে একটু জড়ায়া ধরতে। কিন্তু মজনু পারে না। মজনু মারে ধইরা কবরে নামাইতেও পারে নাই। কারণ, হুজুর বলছিল- যে যে নেশা করে তারা লাশ ধরবেন না। কবরে মাটিও ধরবেন না।
মজনু দূরে সইরা যায়। মারে কবরে শোয়াইতে পারে নাই মজনু। এমনকি একমুট মাটিও মজনু দিতে পারেনি।
এরপর ১মাস মজনু কবরে যায় না। বাবলুরাও মজনুরে খুজতে আসে না। বাবলুরা ভাবে মজনু মায়ের শোকে আসে না।
একদিন বাপ্পি আসে মজনুর বাসায়। মজনুরে বলে- দোস্তো ঘরে গানজা ধরাই।
মজনু বলে- নাহ্। মায়ে আসে রাইতে। গন্ধ পাইলে ঘরে ঢুকবো না।
বাপ্পি আবার বলে- আইচ্ছা চল্। আইজকে কবরস্থানে যাই। আমাগো পুরাণ আড্ডায় যাই। ঐখানে দুইডা সুখটান দিয়া আসি।
মজনু বলে- না। ঐহানে মায়ে শুইয়া আছে। গন্ধ শুকলে মায়ের ঘুম ভাইঙ্গা যাইবো।
০৪/০৬/২০১১
আজকের মানুষ ভবিষ্যতে লাশ ......
ভালো বলেছেন। গল্পের জন্য ধন্যবাদ।
থ্যাংকু।
মজনু বলে- নাহ্। মায়ে আসে রাইতে। গন্ধ পাইলে ঘরে ঢুকবো না।
বাপ্পি আবার বলে- আইচ্ছা চল্। আইজকে কবরস্থানে যাই। আমাগো পুরাণ আড্ডায় যাই। ঐখানে দুইডা সুখটান দিয়া আসি।
মজনু বলে- না। ঐহানে মায়ে শুইয়া আছে। গন্ধ শুকলে মায়ের ঘুম ভাইঙ্গা যাইবো।
দারুন
ধন্যবাদ মেজবাহ ভাই। কেমন আছেন?
দারূণ একটা লেখা...
থ্যাংকু।
অসাধারন। একটানে পড়ে গেলাম। একেবারে অন্যধরনের।
অসাধারন। একটানে পড়ে গেলাম। একেবারে অন্যধরনের।
কিছু টাইপো আছে, পারলে দেখে নিয়েন
বিড়াল মিউ মিউ হবে না কথাটা?
জ্বি আপু। থ্যাংকু আপু।
গল্পটা অনেক বেশি ভাল লাগলো!অন্যরকম....।
মন্তব্য করুন