দুইটি মৃত্যু
দুলে দুলে পুঁথি পড়ছে যেনো ছটোন, বিকেল টা বুঝি শেষই হয়ে গেলো।
..a cow is the domestic animal........a cow is the domestic animal.....a cow, a cow, a cow is the domestic animal.......
আজকে আর দুটো শপাট শপাট বারি মারা হলোনা টেপ টেনিস বলে। মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মায়ের আজকে মেজাজ ভিসুভিয়াসের মত, লুকিয়ে বের হবারও সাহস করে উঠতে পারলো না...
......a cow is the domestic animal.....a cow, a cow, a cow is the domestic animal.......
রাতের জন্য রান্না ঘরে রুটি বেলতে বেলতে জুয়েনার মেজাজ খারাপ বাড়তে থাকে আবারো। ছেলের পড়ালেখার জন্যই সমস্ত ধ্যান তার, অথচ, ছেলেটা পড়ালেখা নিয়েছে আরো কয়েকটা দৈনন্দিন বিরক্তিকর কাজের একটা হিসেবে।জোর করে পড়তে বসালে বসে, ঘন্টা খানেক ঠিক ঠাক থাকে, তার পর শুরু হয় তালগোল পাকানো।
এই যেমন এখন আর্টিকেল উল্টা-পাল্টা করে ফেলছে। আধা ঘন্টা আগেও একই জিনিষ ঠিকই পড়ছিলো।
অনেক অভিমান জুয়েনার, নিজে পড়ালেখা করতে পারেনি জলদি বিয়ে হয়ে যাওয়াতে, বিয়ের পরও স্বামীর ইচ্ছে ছিলোনা, জুয়েনার ছিলো খুব। তার বদলে বরং অল্প বয়সের সন্তান এই ছোটোন। মফস্বলে ঘাটের কাছের বাজারের পাশে নিজেদের ছোটো টিনের বাড়ি সম্বল করে সাচ্ছন্দ্যে চলা হয়ে উঠেনি। তাই অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ায় যে অভিমান ছিলো বাবার বাড়ির প্রতি, সেটা ধরে রাখতে পারেনি। ভাইদের সাহায্য নিতে গিয়ে মরমে মরতে হয়েছে। এখন একটাই ফ্যান্টাসী জুয়েনার জীবনে, ছেলে পড়ালেখা করে, সবাইকে অনেক সাহায্য করবে, আর সে ভাইদের সেই কৃপার দৃষ্টি গুলো ফেরৎ দিতে পারবে।
"...বেলন দিয়া পিটাইয়া আজকে হাড্ডি গুড়া করবো তোর।"
দাত কিড়মিড় করে তেড়ে আসতে দেখে ছোটন মাকে।
ভড়কে যায়, বুঝতেই পারেনা ,এত জোরে জোরে পড়ার পরও হঠাৎ মায়ের মনে হলো কেনো সে পড়ছেনা?
মায়ের রুটি বেলার শব্দের দিকে ভালো মতন খেয়াল রেখে সে যদিও বিছানার পাশের জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তায় কি ঘটছে সেটা দেখে এসেছে বার কয়েক, কিন্তু সেও তো পড়া আওড়াতে আওড়াতে।
"..আমি তো পড়তেই আছি"
ভয়ের চোটে চেঁচিয়ে উঠে ছোটোন। মা ক্ষেপলে কাহিনি কি হয় ভালোই জানা আছে তার।
"...পড়তাছি বললেই পড়া হয় হারামী? আধা ঘম্টা আগে যেইটা ঠিক পড়ছস, এখন সেইটা ভুল করস, অভিনয় করো আমার সাথে?"
এইরে, মা তো তুমিতে নাইমা আসছে, বিপদ সংকেত একলাফে ৩ থেইকা ৭ তে উইঠা গেছে। এখন চুপচাপ অল্প মাইর হযম কৈরা বাইঁচা যাওয়ার সময় হৈছে কিনা ভাবত্ব শুরু করে ছোটন।
জুয়েনা বেলন হাতে এগিয়ে আসতে থাকে। পিছতে থাকে ছোটন।
....ক্রী ঈ ঈ ঈই ঈ ঈ ঈই ঈই ঈ চ........
তীক্ষ্ন শব্দে চমকে উঠে মা- ছেলে দুজনেই এমন সময়......
শব্দটা এসেছে জানালর কাছ থেকে। জানালায় তাকাতে হিম হয়ে গেলো জুয়েনা।
শব্দটা এসেছে আচঁড়ের শব্দ থেকে।
একটা পাশবিক মুখ জানালায়। মানুষ তো বটেই। মহিলা একজন...পাগলী। চুল উষ্কু-খুস্কো...গায়ে কাপড়ের ঠিক নেই, যাও আছে নোংরা। কিন্তু তার কিছুই ভয় যাগায় নি, বা পাশবিক মনে হয়নি।
এক রাক্ষুসীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মানুষ নামের ঐ প্রানীটি, জুয়েনার দিকে।
"....মার, ওরে মার। মার না তুই, একদম একবার মার..."
ত্বারস্বরে চিৎকার করতে থাকে পাগলীনি।
ছোটোন একলাফে মায়ের গা ঘেসে দাঁড়ায়। ঘাটের বাজারে পাগল নিয়া রসিকতা করার অভ্যাস আছে ছোটোনদের। কিন্তু সে কখনো এমন মূর্তির পাগল দেখেনি। ভয়ে তার গায়ের লোম দাড়িয়ে যায়। মায়ের হাত ধরে দাড়ায়, মায়ের গায়ের লোম ও দাড়িয়ে আছে।
পাগলীনি চিৎকার করেই যাচ্ছে...
"....মার না ওরে, মার। মার না তুই, একদম একবার মার..."
জানালায় মুখ রেখে দাঁত খিঁচিয়ে, আর হাত দিয়ে দুই পাশের টিনের দেয়াল খামচে খামচে....তীক্ষ্ন
ক্রীঈঈঈঈঈচ...
মায়ে ছেলেতে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে ভয়ে....
এক:
ঐ, ঝুড়ির টিন উঠাইছোস আমীন?
এখন আরেকবার যদি উপলগো বাড়িত গেছোস মোহাইমেনন, তাইলে কলাম আইজকা তোরে রাইখাই যামু, হারামি পোলা, আমীনের লগে জিনিষ গুলা নিয়া
তোর বাপের কাছর দে।
উল্লাসের আজ বাড় বাড়ন্ত মোমিনার। তার মাইয়ার বিয়া হৈবো একটা সোনার টুকরা ছেলের সাথে, তাও টাউনে গিয়া। এক জীবনের একটা অংশ তো খুব ভালো মতন হৈলো, এই কপাল কয়জনের হয়।
তাদের সংসারের পয়লা সন্তান মাইয়া হওনে শ্বাশুড়ী - ননাসের খোঁটা উপেক্ষা কৈরা লোকটা তারে কৈছিলো,
"..আমারে অনেক খুশী করলা গো মোমিনা, অনেক...আমি চাইছিলাম, আমাগো পয়লা মাইয়াই হোক।"
আনন্দে চোখে পানি আসছিলো মোমিনার।
লক্ষী মাইয়া তার রানী। দেখতে শুনতে --- মায়ের চোখে নিজের মাইয়া ভালো বাদ দিলেও, দশজনেরও মতামত আছে।
মাইয়াটা মায়ের পরান জুরাইন্যা। সেই মাইয়ার একটা ভালো বিয়ার ব্যাবস্থা করতে পাইরা, রানীর বপ-মায়ের মনে যার পরনাই খুশি। তার উপর বিয়ার জন্য যাইতাছে, রানীর খালার বাড়ি, টাউনে। সব কিছু সেইখানেই।
"রানী, পায়খানার দরজায় হুড়কা লাগাইছোস তো মা?"
যদিও দরকার নাই, মুরগী-হাস আর গরু সবই জব্বার ভাইয়ের জিম্মায় রাইখা আসা হৈছে যতদিন তারা বাড়ির বাইরে থাকবো, ততদিনের জন্য।
"হ, মা, লাগাইছি" মায়ের কাছে আসতে আসতে নিচু স্বরে উত্তর করে রানী।
আহারে, মাইয়াডা এম্নেই নীচু স্বরে কথা কয়, আর তার বিয়ার উছিলায় এত হুলুস্থুল কারবারে লাজুক মাইয়াডা আরো নীচু স্বরে কথা কয়। কিন্তু, মা তো, মাইয়ার খুশিডা টের পায়। পাইবো নাই বা কেন, এক্কেরে মায়ের কাঁখের মাইয়া, সব সময় মায়ের লগেই। যেনো মায়ে মাইয়াতে দোস্ত। আমীন্যা আর মোহাইমেননইন্যা তো মায়ের হাড়-মাস জ্বালাইতে খালি বাকী। আইজ যাওনের সময় বেশি কিছু কৈতাছেন্না।
দুই:
"লঞ্চের ডেকের উপরে দাপড়াইয়া পাড়া মাথায় করতাছে পোলা দুইডা, ওগোরে থামাও।"
স্বামীরে বলে মোমিনা।
আহা, বৈনের বিয়া, লঞ্চে চড়তাছে আইজকাই পয়লা, একটু দাপা-দাপি করবোই, ছাড়ান দেও।
"তুমি বড় আলগা আলগা পোলাপাইনের ব্যাপারে" শ্রাগ করে জানায় মোমিনা। তার স্বামী হাসে, প্রশ্রয়ের হাসি। প্রসঙ্গান্তর হতে সময় লাগেনা অবশ্য।
"হাজী গঞ্জের ঐদিক দিয়া আসলে কি হৈতো? তাইলে অনেক্ষানি বাসে আসা যাইতো, এত খানি লঞ্চে যাওয়া লাগতোনা"
"..কেন লঞ্চে ডড় করে নাকি গো?" মিহি স্বরে জিগায় তার স্বামী।
"আরে, লঞ্চে কত দুলুনি, ভাল্লাগেনা।" বিরক্ত ভাবে জানায় মোমিনা।
"আজকা অবশ্য একটু বেশি দুলতাছে, বাতাস মনে হয় একটু জোড়ই"...ভ্রু কুঁচকে অন্যমনস্ক হয়ে উঠে যায় পান আনতে লোকটা।
মোমিনার মনে হঠাৎ কু ডেকে উঠে কেন?
তিন:
অন্ধকারে ফুঁপিয়ে উঠে মোমিনা। কিছুই দেখা যায়না। লোকটায় গেলো কুনদিকে? আমীন -মোহাইমেনন কৈরে? সারা শরীর থেকে ছিটকে কান্না বের হয়ে আসে মোমিনার, কানতে পারেনা বেশিক্ষন। রানীর হাত শক্ত করে ধরে আছে আর প্রান পনে চেষ্টা করছে পানির ভিতর থেকে শরীর বের করতে, পারছে না...মাঝরাতের উলোটপালট ঝড়ে ডুবছে লঞ্চটি..
.আমীন লাফ দিয়া পড়ছে আগেই, কিন্তু চোখের পলকে ঢেউ ভাসাইয়া নিয়া গেছে। তারপর মোহাইমননরে নিয়া লোকটা, তাদেরও দেখা যায়না, এমন বৃষ্টির মাঝে খালি আন্ধার, মনে হয় অন্ধ হৈয়ে গেছে মোমিনা, মাইয়ার হাত ধৈরা রাখছে, তাও চিৎকার কৈরা ডাকে,
"রানী..."
...এই বাতাসের শব্দেও রানী কেম্নে জানি টের পায়, মায়ের হাত আঁকড়াইয়া ধরে জোরে শোরে...
জাহাজের মৈধ্যে পানি, বাইরে পানি, উপরে বৃষ্টি....সাঁতার জানা মোমিনাও হাবুডুবু খায় ক্রমাগত...
এক হাত তবু ছাড়েনা মেয়ের, দরকারে নিজে মরবে, তবু মেয়েকে বাঁচাতে হবে,
এই মাইয়াই থাকবো তাগোর হৈয়া..এই দুনিয়ায়....ও খোদা...খোদারে...
হাতড়ে হাতড়ে লঞ্চের রেলিং এ আটকে ধরে হাত মোমিনার। কিন্তু লঞ্চটা রয়েছে পুরাপুরি কাত হয়ে। মাথা বের করা যাচ্ছে, কিন্তু খোলা যায়গায় যেতে গেলে কিসে যেনো আটকে ধরে, বের হওয়া যায়না।
আবারো ফোঁপাইয়া উঠে মোমিনা, তাইলে কি লঞ্চের লগেই তলাইয়া যাইবো মা আর মাইয়া? না...
মাইয়ারে যেমনে কৈরাই হোক, বাইর কৈরা দিতেই হৈবো।
অল্প অল্প টানে ডুবছে লঞ্চ, আর দুইজনের বাইর হওয়া সুযোগ কমে আসছে।
আর পারতাছে না মোমিনা।
রানীর পাও জড়াইয়া উপরে ঠেইলা দিলো, রানী প্রান পনে চেষ্টা করতাছে, বাইর হৈতে পারেনা। আর বেশিক্ষন নাই।
মোমিনার দম শেষ।
তাও চাইপা রাখছে আপ্রান।
ফুসফুস ফুইলা বুকের হাড্ডিতে চাপ দিতাছে।
এখন এমনে যতক্ষন পারে, শ্বাস নেওনের চেষ্টা করলেই পানি ঢুকবো ফুসফুসে, তারপরে আর গ্যান রাখা যাইবো না।
দম..
দম..
দম...
আর পারেনা, মোমিনা, হা কৈরা টান দেয়। হড়হড় কৈরা পানি ঢুকতে থাকে ফুসফুসে। সবদিক আন্ধার। কিছু চোখে পড়েনা।
মোমিনা কৈতে পারেনা কই আছে এখন, খালি জানে আলো আর বাতাস দরকার তার।
পাগলের মত হাত পা ছুঁড়ে, কোনো কিছুতে হাত ছোঁয়ার জন্য মরিয়া।
শেষ হৈয়া আসতাছে সব। এখন আর মোমিনার ইচ্ছায় কিছু নাই, তার শরীর নিজেরে বাঁচানের জন্য যা করার করছে...
হাতে হঠাৎই নরোম-শক্ত লম্বা কিছু খুঁজে পায়। আঁকড়ে ধরে সমস্ত শক্তি দিয়ে। তারপর, স্বত: ক্রিয়াতেই জিনিষটার উপর চেপে ধরে চড়ে বসে। পায়ের নীচে পড়ে আর শেষ বারের মত ঠেলা দেয় পা দিয়া,...
বাতাস, বাতাস....বৃষ্টির মধ্যেও, ফুসফুস বাতাস নেই ভৈরা ভৈরা....
পরিশিষ্ট:
উপজেলা শহরের হাসপাতালে লঞ্চডুবি রোগগিদের ভিড় থেইকাও কি কৈরা জানি একজন মহিলা গ্যিয়ান ফেরৎ পাইয়া হঠাৎ দৌড়াইয়া বের হৈয়া যায়। ছুটে যায় ঘাটের দিকে, আজকে সেখানে লোকে লোকারণ্য, ঝড় থেমেছে। চলছে লঞ্ডুবি উদ্ধার কাজ।
দৌড়ে ছুটে যায় মহিলা, উন্মাদের মত চিৎকার করতে থাকে,
"আমি আমার মাইয়ার গায়ে পাড়া মাইরা ভাইসা উঠছি, আমি আমার মাইয়ারে মাইরা ফালাইছি"
বুক চাপড়াইতে চাপড়াইতে ছুটে যায় মহিলা, কয়েকজন তাড়াতাড়ি আকঁড়ে ধরে...
মহিলা চিৎকার করতেই থাকে,
"আমি আমার মাইয়ার গায়ে পাড়া মাইরা ভাইসা উঠছি, আমি আমার মাইয়ারে মাইরা ফালাইছি গো, আমি নিজের মাইয়াডারে মাইরা ফালাইছি"।
প্রথম অংশের সাথে আবছা আবছা মিলাতে পারলাম। প্রথমের পাগলীটাই কি মোমিনা?
পাগলীটাই তো মোমিনা....হ, বেশি বড় করতে মন চায় নাই, তাই আর ভাইঙ্গা চুইরা লেখিনাই...
ধন্যবাদ মুকল।
আমি শাওনের লেখার অপেক্ষায় থাকি।
জি বস, আপনারা পড়েন বৈলাই তো হাবিজাবি লেইখা ফেলি....
একেবারে জীবন্ত লাগলো গল্পটা!!
কিন্তু মৃত্যুর গল্প তো.....
নীড় সন্ধানী, ভালো আছেন?
অদ্ভুত!!!
অদ্ভুত একটা গল্পের স্বাদ পাইলাম
পড়ার জন্য অনে কধন্যবাদ চৌধুরী সাহেব/ স্যরি কাজী সাহেব...খিকয..
অনেক ভাল লাগল
অনেক ধন্যবাদ, রুমন....
ভালু পাইলাম
বুইড়া আঙ্গুল
ভালু না হৈলেও তো বুইড়া আঙ্গুল!!!!
গল্পটা বেশ ভালো লাগলো।
কিন্তু আমার মনে হয় আরেকবার ব্রাশাপ করলে জিনিসটা আরো ভালো হবে।
লেখার মাঝখানেই কুনসম কারেন্ট যাইবো, সেই টেমশমে লেখন লাগে তাড়াতাড়ি, সেই জন্য সবসময়ই আউলা ঝাউলা থাকে....
লাইক করছি। অনেক দিন পর বিলাই এর একটা সুন্দর গল্প পড়লাম।
এইখানকার ইমোর বাক্সটা কৈ গেলো? শুধু মনে রাখা ইমো গুলা দিয়া কাজ চালাইতে হয়....
পেটের ভিতরটা পাঁক দিচ্ছে। আহারে
এর পেছনে একটা সত্য ঘটনাও কিন্তু থাকতে পারে-----:(
বিলাই, এত সোন্দর একখান গল্প এতদিন পরে লেকলে চলবো ?
আরো বেশি বেশি লেইখো...
থ্যাংকু
আমি তো আর লেখক না ভাই, ঘন ঘন লেখতে পারলে তো খুশি হৈয়াই লেখতাম।
আমার আদ্ডা দিতেই ভাল্লাগে....:
মন্তব্য করুন