রোবট নাকি মানুষ... কি আমি?
আমি হয়তো মানুষ নই মানুষগুলো অন্যরকম!!!!
মানুষগুলোর আবেগ থাকে। তারা কষ্টপেলে কাঁদে, আনন্দে হাসে। শেষ কবে প্রাণ খুলে হেসেছি মনে নেই। চিৎকার করে কেঁদেছি সেটাও মনে নেই। আবেগ আমাকে খুব বেশি স্পর্শ করেনা, অনেকটা রোবোটিক।
আর যদি করে তবে লুকিয়ে চলি আমার আব্বার মতো... আমার আব্বা ছিলেন আবেগ লুকানোতে এক্সপার্ট... অথবা আমি ছিলাম বুদ্ধিহীন যে বুঝতেই পারতো না...
আমার এখনো মনে আছে, এইতো সেদিন যখন আব্বা অসুস্থ। তখন আমি চাকরী করি। প্রতিমাসে বাসায় কিছু টাকা পাঠাতাম। আর যখন ফোন করে বলতাম টাকা পাঠানোর কথা তখন তিনি খুবই চিন্তিত হয়ে পরতেন। বলতেন কতো আর কামাই করো? বাসায় কি টাকার দরকার? তোমার কষ্ট হবেনা তো?
এই প্রশ্নগুলোর মর্ম সেদিন বুঝিনি। কতটা ভালোবাসা যে এগুলোতে ছিলো তাও বুঝিনি। আসলে সত্যি বলতে কি, আমি জীবনেও আমার বাবার ভালোবাসার পালসটাই ধরতে পারিনি। তাঁর প্রতিটা কথা, প্রতিটা প্রশ্ন আমার কানে এখনো বাজে। কিন্তু কিছুই করার নেই। সে এখন পরপারে।
আজকে যখন তাঁর ভালোবাসাগুলো বুঝি তখন বুক ফেটে কান্না আসে। কিন্তু কাঁদিনা, আবেগটাকে গিলে খেয়ে ফেলি। শুধু মনেহয় কতদিন দেখিনা আব্বাকে। কতদিন তাঁর মুখের ডাক শুনিনা। এই কষ্টের কোনো তুলনা হয় না। এটাকে শব্দে বাঁধাও যায় না। শুধু অনুভব করা যায়, শুধুই অনুভব...
যখন খুব বেশি কষ্ট হয় তখন ডুব দেই, সবার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেই। সবার কাছথেকে আবেগ লুকিয়ে চলি।
আজ আব্বার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। সেই ২০১২ এর আজকের দিনে আব্বাকে হারিয়েছিলাম। আর ঠিক তিন বছর পরে আজকে বাস্তবতার কারনে সব ভুলে গেছি টাইপ ভান ধরে বসে আছি। আজকের এই দিনে আমি মা'কে একটিবারের জন্যও কল করিনি। হয়তো সে মনখারাপ করে বসে আছে। আমি কল করলে সে আবেগী হয়ে পরতে পারে, এই ভয়থেকেই কল করা হয়ে ওঠেনি। অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। জীবনটা অফিস - বাসা - অফিসের মাঝেই স্বীমাবদ্ধ। কোনো ভাইবোনকেই একটিবারের জন্যও কল দেইনি। দুপুরে বড় আপা কল দিয়েছিলো, তাঁর কন্ঠ কেমন যেন ভেজাভেজা। বুঝতে পেরেই বললাম আমি অনেক ব্যস্ত, পরে কথা বলবো। আপাও রেখেদিলো। আসলে আবেগ খুব খারাপ জিনিস একে লুকিয়ে রাখতে হয়। অনেক আগে থেকেই আমি কেমন যেন আবেগটা দেখিয়ে উঠতে পারিনা।
আব্বা যেদিন মারা যান, সেদিন থেকে তাঁর দাফনের আগ পর্যন্ত আমি এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলিনি। সব ভাই-বোনেরা এবং মা আমাকে ধরে কেঁদেছে। আমি তাদেরকে স্বান্তনা দিয়েছি। তবুও চোখের পানি ফেলিনি। হয়তো রোবট বলে ফেলতে পারিনি!!! কিন্তু যখন কবরে মাটি দেওয়া হয়ে গেলো, সবাই একে একে চলে যেতে থাকলো তখন শুধু মনেহয়েছে, "আব্বাকে একা রেখে যাচ্ছি!! তিনি এখানে কিভাবে থাকবেন? আমি কি আর কোনো দিনও আব্বাকে দেখতে পাবোনা? আর কক্ষনো কেউ আমায় ভিন্ন নামে ডাকবে না!!"
তখন আমি আর চোখের পানি আটকাতে পারিনি। কিন্তু সেটা কক্ষনো মা- ভাইবোনকে বুঝতে দেইনি। এভাবেই দিনের পর দিন পরিবারের সবার থেকে আবেগকে লুকিয়ে চলছি। শেষ পর্যন্তও চলবো। আমাকে চলতেই হবে। এই লুকিয়ে চলার স্বভাবটা আমি হয়তো আমার আব্বার থেকেই পেয়েছি। সে যেমন লুকোচুরিটা করে গিয়েছে সর্বদা আমার সাথে। স্বভাবটাকে আত্মস্থ করে নিচ্ছি ধীরেধীরে। আমাকে পারতেই হবে। বাবাকে ধারন করবো নিজের মাঝে, এ এক অনন্য সুখ।
যেই মানুষটার ভালোবাসাকে কক্ষনো খেয়ালই করিনি, সেই মানুষটা আজীবন বটবৃক্ষের মতো আমাদের জন্য ছায়া নিশ্চিত করে গিয়েছেন। আমি বাবাকে হারিয়ে বুঝেছি বাবা কি ছিলেন। যাদের বাবা আছে তাদের প্রতি একটাই অনুরোধ বাবাকে কষ্ট দিয়েন না, তাঁর কথায় বিরক্তও হয়েন না। না হলে আমার মতো আফসোস করবেন। আমার জীবনের সবথেকে বড় আফসোস, আব্বাকে পুরোপুরি দাফনের পরই বুঝতে পারলাম কত্তো ভালোবাসতাম তাকে। তিনি কতটা বাসতেন আমাকে। আফসোস... কেন তখন বোঝার মতো বুদ্ধি ছিলোনা?
আমার মতো আফসোস যেন কাউকে করতে না হয়। এই একটা আফসোসের কারনে নিজেকে মাঝেমাঝে মানুষ মনেহয়। এছাড়া বাকিটা রোবোটিক।
বাবা তো বাবাই, বটগাছের মতো। তারাই একমাত্র যারা নীরবে ভালোবাসে। পৃথিবীর সকল বাবারা ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক।
এইকথাগুলো আমি বাবাকে নিয়ে যখনই কিছু বলতে যাই তখনই বলি। হয়তো সারাটি জীবন বলে যাবো। কথাগুলো আমার ক্ষেত্রে টনিকের মতো মোটিভেশনের কাজ করে।
পরক্ষনেই বলতে ইচ্ছেকরে, আব্বা দেইখেন একদিন আমিও.........
কিন্তু বাকিটা বলতে পারিনা!!! গলা আঁটকে আসে... চোখ ভিজে যায়...আঙ্গুলগুলো থমকে যায়... কিছুই বলতে পারিনা... ভাবতেও পারিনা... শুধু চুপ করে বসে থাকি, অজানায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে...
অনেক অনেক শুভকামনা জানবেন
ধন্যবাদ। আপনিও ভালো থাকবেন আপু
উনি নিশ্চয়ই ভালো আছেন।
মন্তব্য করুন