দ্বিতীয় জীবন
২ মাসে আমার শরীরজুড়ে ২১টা ফোঁড়া উঠেছে। অস্বাভাবিক তাই না?
বড়ভাই ডাক্তার। ফোন করলাম। বললেন, ডায়াবেটিস চেক করিয়ে নে। ডায়াবেটিস থাকলে এমনটা হতে পারে।
আমি কিঞ্চিৎ আতঙ্কিত হলাম। এর আগে ডায়াবেটিস সম্পর্কে তেমন খোঁজখবর রাখা হয়নি। মা বাবার ডায়াবেটিস নেই। আমার হবে কেন? কিন্তু ডাক্তারের কথা শুনে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। বাসার কাছেই চট্টগ্রাম ডায়াবেটিস হাসপাতাল। হাঁটা পথ। কিন্তু আমি আর টেস্ট করাতে যাই না। ভয়ে। যদি পজিটিভ হয়!
ফোঁড়ার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে অবশেষে গেলাম। আল্লাহ ভরসা।
খালি পেটে বসে আছি। সিরিয়াল নম্বর ৯। সোয়া ৮টায় ডাক পড়ল। রশিদ টশিদ কেটে রক্ত দিলাম। এক প্যাকেট গ্লুকোজ একগ্লাস পানিতে গুলে খেতে হলো। ২ ঘণ্টা পর আাবার রক্ত দিতে হবে। এই ২ ঘণ্টায় আমরা ছিলাম ক্লাসরুমে। সত্যিকারর ক্লাসরুম। শত শত হবু রোগী। সবার চোখে আতঙ্ক। একজন পুষ্টিবিদ আর একজন ডাক্তার এসে বললেন-আগামিকাল রিপোর্ট দেওয়া হবে। আগামিকাল যাদের ডায়াবেটিস হবে এবং যাদের হবে না-এই ক্লাস তাদের জন্য।
ডায়াবেটিস কেন হয়-সেটা বলা হলো। আমাদের রক্তের গ্লুকোজ ইনসুলিনের সাহায্যে শক্তি তৈরি করে। ইনসুলিনের অভাব হলে গ্লুকোজ রক্তে জমে যায়। এর পরিণতি ভয়াবহ। হার্ট এটাক ইত্যাদি। আমি অবশ হয়ে শুনে যাচ্ছিলাম। ডাক্তার যখন বললেন- মা বাবার না থাকলেও যে কারও ডয়াবেটিস হতে পারে, ডায়াবেটিসের লক্ষণ ওজন কমে যাওয়া, দুর্বলতা, ফোঁড়ার মতো চর্মরোগ...আমার বুকের ভেতরটা রীতিমতো লাফাতে শুরু করল। হায় হায় আমার ডায়াবেটিস হয়ে গেল বুঝি!
যখন বাসায় ফিরলাম, আমার জীবন-যৌবন প্রায় নিঃশেষ! হায় চিনি, চায়ে মেশানো চিনি...আর বুঝি খেতে পারব না! হাত পা ঝিম ঝিম করছে কেন? বুকে ব্যথা করছে কেন? হার্ট এটাকে বুঝি আমি মারা যাব!
আমি না হয় মারা গেলাম। আমার একমাত্র আদরের মেয়েটার কী হবে? ওরও বুঝি ডায়াবেটিস হয়ে যাবে! অন্ধকার, অন্ধকার...আমার চোখে ব্যথা করছে কেন? চোখও বুঝি গেল!
আর কয়েক ঘণ্টা পরেই আমার ডায়াবেটিস হয়ে যাবে। এ জীবনের আর মূল্য কী?
সারারাত আর ঘুম আসেনি। শেষবারের মতো ৩ চামচ চিনি মিশিয়ে প্রিয় চা টা খেয়ে নিলাম। চোখ গর্তে ঢুকিয়ে, বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। কাউন্টার-কর্মী আমার সামনেই রিপোর্টগুলোকে আলাদা করলেন। একভাগে ডায়াবেটিস আছে, অন্যভাগে নেই। আমার রশিদ নম্বর ৬০৬। দেখলাম- যাদের ডায়াবেটিস আছে সেই ভাগে ৬০৪, ৬০৫ এবং এর পরের রশিদটাও রাখা হলো। আমার হাঁটু কাঁপতে লাগল। মাথা ঘুরে পড়ে যাব নাকি? ধরুন না প্লিজ আমাকে!
এই নিন ৬০৬। ডায়াবেটিস নেই।
কী, কী! ডায়াবেটিস নেই! ৬০৫ এর পরের রশিদটা ছিল ৬১৩।
আমি লাফালাম। যেন লাফিয়ে লাফিয়ে চলে এলাম বাসায়। চিৎকার করে বললাম-আমার ডায়াবেটিস নেই...।
বউকে বললাম-দাও, সব দাও। সব খাব। আজ বিরিয়ানি করো। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রাখলাম পাঁচ মিনিট।
আাহা সুস্থ থাকার কী আনন্দ!
বউ বলল, তোমার ডায়াবেটিস হবে কেন, তুমি তো নিয়ম মেনে চলো।
বললাম, একটা শিক্ষা হয়েছে। আরও কঠোরভাবে নিয়ম মানতে হবে।





জীবন এর একটা ঘটনা গল্পে রুপ নিল......।। লেখাটা পরতে ছিলাম আর খুব ভয় ভয় লাগতে ছিল।।......... কি হয়... কি হয়????
আমাদের জীবনে এমন আরও কত গল্প আছে! আমরা সেসব শেয়ার করতে পারি
সিরাজি ভাই আপনিও চিটাগাংয়ের মানুষহ??ডায়াবেটিস খুব খারাপ রোগ। আমার আম্মু ডায়াবেটিসের রোগি। আমি জানি এইডা কি চিজ। আপোনার যে হয়নাই শোকর করেন আর আমাদের জন্য মিলাদ দেন আর ভাল তাবারক দেন

দোয়া করি সবার জন্য।
চায়ে তিন চামচ চিনি আর বিরিয়ানি খেলে ডায়বেটিস পজিটিভ হতে বেশি সময় লাগবে না
, তখন ক্লাশের শিক্ষা কাজে লাগবে 
এখন পৌনে এক চামচ চিনি খাই। বিরিয়ানি খুব কম।
আপনি সৌভাগ্যবান। ভালো লাগলো।
ভালো থাকুন। পোষ্ট টা পড়ে মজা পেলাম খুব।
ভাল লাগলো । ছোট্ট একটি বিষয় বস্তু (যদিও ঘটনাটি বৃহৎ), নিখুঁৎ বর্ণনার গুণে হয়ে উঠেছে অপূর্ব ।
এখন আমার কাছে বড় ঘটনা হচ্ছে- আমার ডায়াবেটিস নেই। বিশ্বাস করুন, অন্য কত অসুখ যে আমার ভালো হয়ে গিয়েছে এই ঘটনায়!
যেমন বয়ানভঙ্গি, আতঙ্ক ধরিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু!
মেয়েকে অনেক আদর। কী নাম তার?
মেয়ের নাম কুশিয়ারা
ক্যান, কুশিয়ারা ক্যান ? মেয়ের নানা বাড়ি বা জন্মস্থান কি সিলেটে... বেবিটা অনেক কিউট
য়াযাদ ভাই, মেয়ের নানাবাড়ি হাতিয়া, জন্মস্থান মাইজদি। মেঘনা নামটা খুব কমন। তাই অন্য সুন্দর নামের নদী.....।...
কুশিয়ারা ছাড়া আর কী আছে সুন্দর!
আরে না না, অনেক সুন্দর নাম। জাস্ট মজা করার জন্য বলছিলাম...
মজা পাইলাম। আমার এ নাগাদ শোনা সবচে সুন্দর নাম এটি। নিজের মেয়ের নাম বলে কথা! যদিও নামটি আমি রেখেছি
যাক বাঁচা গেল। মিষ্টি না খেতে পারলে যে জীবনের ১৫ আনাই মিছা...
মিষ্টি কম খান, রশীদা।
১ আনার জীবনও অনেক মূল্যবান।
একটা ঘটনাকে কিভাবে উপস্থাপন করতে হয় এটা তার চমৎকার উদাহারন।
ধন্যবাদ সিরাজী ভাইজানকে
আপ্লুত হলাম অরিত্র
আরও কঠোরভাবে নিয়ম মানতে হবে।
নিয়ম মানার কোনো বিকল্প নেই।
নিয়ম মেনে স্মার্ট হতে হয়, নিয়ম ভেঙে নয়।
কম দুরত্বের জায়গাটুকু সবা্র েহটে চলা উচিত। ফলাফল পাবেন বেশী বয়সে।
হাঁটুন। হাঁটুন। হাঁটুন
নইলে একদিন বুঝবেন
মজার, একই সাথে আবেগময় পোষ্ট। খুব ভাল লাগলো মাইনুল ভাই। ব্লগে আমার একটা র্দুনাম আছে, সেটা হল কমেন্ট দিতে গেলে মিনি পোষ্টের মত হয়ে যায় কিন্তু নতুন পোষ্ট দিতে যত আলসেমি। যাই হোক, আপনার ঘটনা শুনে নিজের ঘটনা শেয়ার করার লোভ সামলানো গেল না।
সময়টা খুব সম্ভবত নয় দশ বছর আগের যখন চট্টগ্রাম ডায়বেটিক সমিতিটা এনায়েত বাজার বাটালী রোডে ছিল। আমি অনেকদিন যাবত এ্যাপথাস আলসার নামের একধরনের মুখের অসুখে ভুগছিলাম, যে রোগের কারন বা ঔষধ এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি। এক পর্যায়ে আম্মার কথায় যখন ইন্ডিয়ায় যাওয়ার কথা ভাবছিলাম এমন সময় আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে এক ডাক্তারের স্বরণাপন্ন হই। ডাক্তারের লম্বা ল্যাব টেষ্ট দিল। লিষ্টে ডায়বেটিস টেষ্টের কথাও উল্লেখ ছিল আর আমিও সুবোধ রোগীর মত চট্টগ্রাম ডায়েবেটিস সমিতিতে গিয়ে ব্লাড দিয়ে এলাম।
রিপোর্ট দেয়ার দিন সাথে করে এক বন্ধুকে নিয়ে রিপোর্ট আনতে গেলাম। রিপোর্ট কাউন্টারের ভদ্রলোক আমাকে রিপোর্টের খামখানা দিয়ে ডিউটি ডাক্তারের সাথে দেখা করতে বললেন। তারপর সেই ডাক্তার আমাকে যা বলল আমার বিশ্বাস হতে চাইছিল না। আমি শুনতে পেলাম ডাক্তার মুখ অন্ধকার করে বললেন আপনার ডায়বেটিস হয়েছে এবং আনফরচুনেটলি আপনার টাইপ ওয়ান ডায়বেটিস, এতে আপনার নিয়মিত দিনে দু'বার ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হবে। এত ইয়াং এইজে আপনার ডায়বেটিস হওয়াটা দু:খজনক কিন্তু এটাই বাস্তব। পাশে বসা আমার বন্ধুর তখন চোখের পানি টলমল করছে। ডাক্তার ওকে উদ্দেশ্য করে আমাকে জিজ্ঞেস করলো "উনি কে?" আমি বললাম সে আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড। শুনে ডাক্তরের মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো "এ ফ্রেন্ড ইন নিড এ ফ্রেন্ড ইনডিড"।
সেদিনই একগাদা ঔষধ, ইনসুলিন ইনজেকশন, সিরিঞ্জ, ডিপষ্টিক, টেষ্ট টিউব, বার্নার সব নিয়ে বাসায় এসে আম্মাকে বল্লাম, বিলিভ ইট অর নট, আমি আজ থেকে ডায়বেটিক পেশেন্ট। রাতে আমার জন্য ভাতের পরিবর্তে রুটি বানাবে।
শুরু হলো আমার ডায়বেটিক জীবন। জীবনটা হয়ে গেল সুগারলেস। একটা তেতো দুনিয়া। যে পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করলাম সেগুলো হলো, চরম আলসে আর লেইট রাইজার আমি খুউব ভোরে আকাশ আলো হবার আগেই কেডস্ পড়ে বৃষ্টির মধ্যে জগিং করতে বেড়িয়ে গেছি। বন্ধুদের সাথে আড্ডার বদলে আমার আড্ডা হত তাদের ডায়েবেটিক মা বাবা'র সাথে। মোট কথা বুড়োবুড়িদের সাথে সখ্যতা বাড়তে থাকলো। প্রায় জিইসি মোড়ের কেন্ডিতে আমাকে দেখা যেত লুকিয়ে লুকিয়ে ঢাউস আকারের জিলাপী খাচ্ছি। রাতের বেলা যেখানে খাওয়া উচিৎ চারটা রুটি সেখানে আমি খেলে ফেলেছি বারো'টা।
এর তিন মাস পর....
আম্মা একদিন বললেন আমি তোমার জন্য আর রুটি বানাতে পারব না, রাতে শুধু তোমার জন্য ময়া করা, রুটি বেলা, রুটি শেঁকা, এ বড় হেপা। তারচেয়ে চলো ঢাকায় যাই ওখানে তোমার খালাত বোন, দুলাভাই, মামতো ভাই সবাই ডাক্তার, দেখি ওরা কি বলে।
যেই কথা সেই কাজ, মা-ছেলে রওনা দিলাম ঢাকা'য়। ঢাকায় এসে কাজিন ডাক্তারনীর তত্বাবধানে টেষ্ট হলো একটা প্রাইভেট ল্যাবে আর বারডেম এ।
টেষ্টের রেজাল্ট শুনে আরেক দফা আক্কেল গুরুম। তারা যা বলল তা হলো আমার কোন ডায়বেটিস নেই।
ডায়বেটিস নেই????!!!!!! বলে কি?!! তাহলে আগের রিপোর্ট?!!
হয়তো ভুল ছিল। বারডেম কাউন্টারে বসা ব্যাক্তির নির্লিপ্ত উত্তর।
কাহিনী শেষ।
কাহিনি শেষ!
হুমম, একটু মজারু স্টাইলে লেখাটা হালকা শিক্ষনীয়, ঐ সময়টা কেমন ভয়ে থাকে, বোঝা গেলো, এবং, সকালে যারা পজিটিভ রিপোর্ট পায়, তাদের কি করুন অবস্থা হয়।
আপনাকে ধন্যবাদ।
যারা পজিটিভ রিপোর্ট পায়, তাদের করুণ চেহারা আমি সেদিন দেখেছি। আমিতো একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছি!
মজা লাগলো পড়ে। ভাল যে শেষটা মজা হলো।
েশষটা মজা হলো। তাইতো বেঁচে গেলাম!
মজা লাগল পড়ে। বেঁচে থাকতে পারাটাই অনেক বড় অর্জন, সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারা আরো বড় অর্জন। কাছের সব মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকবে এর চেয়ে জীবনে আর খুব বেশী কিছু বুঝি চাইবারই নেই আমার।
যারা একবার এসব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যায়, তারা বোঝে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারা কত বড় অর্জন
উত্তর চল্লিশে ডায়াবেটিক এখন অনেকেরই হচ্ছে। দায়ী আমাদের লাইফস্টাইল।আমি প্রতিদিন সন্ধ্যার পর রাস্তায় 'জগিং' করি। আমার বন্ধুরা হাসে,দুর থেকে টিপ্পনি দেয়... 'ডায়াবেটিক হইছে নাকি '? গর্দভগুলো বুঝে না যে, ডায়াবেটিক হওয়ার পর দৌঁড়ানোর চেয়ে আগে দৌঁড়ানোই উত্তম।
'ডায়াবেটিক হওয়ার পর দৌঁড়ানোর চেয়ে আগে দৌঁড়ানোই উত্তম'।
ধন্যবাদ ঈশান। হাঁটুন। ডায়াবেটিস মুক্ত থাকুন।
মন্তব্য করুন