বিপ্লবের ভেতর-বাহির: ২
প্রথম পর্ব বিপ্লবের ভেতর-বাহির ১ এখানে
এবারের পর্ব রুহুল আর রাহেলাকে নিয়ে। দুজনেই বিবাহিত। রুহুল একজন প্রকৌশলী, কিন্তু চাকরিতে মন নেই। রাজনীতিতে মগ্ন, তাও আবার প্রথাগত রাজনীতিতে নয়। সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য তৈরি হচ্ছেন। পিকিং-এর গরম হাওয়া তার শরীর আর মন জুরে। স্ত্রী আছে, সন্তানও আছে।
রাহেলার জীবন একদমই অন্য রকম, অন্য মেরুর। রাহেলারও দুই সন্তান। রাহেলার স্বামী সামরিক বাহিনীতে কর্মরত, নাম বিগ্রেডিয়ার হাকিম। পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা বা এনএসআইর মহাপরিচালক।
রাহলারও এই জীবন পছন্দের নয়। রাহেলার লেখালেখিতে আগ্রহ। বেগম পত্রিকায় লেখেন। প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার মানুষ। কিন্তু রাহেলার এসব চিন্তা বা কাজে সমর্থন নেই স্বামীর। ফলে এক প্রকার গৃহবন্দী রাহেলা। এক পর্যায়ে বাইরে যাওয়াই নিষিদ্ধ হয়ে গেল।
রাহেলার আসল নাম জাহানারা হাকিম। তাঁর মামাতো বা খালাতো ভাই রোকন। তাঁর আরেক নাম সূর্য রোকন। মালিবাগে তখন তৈরি হয়েছে মাওসেতুং চিন্তাধারা গবেষণাগার। এই কেন্দ্রের সঙ্গে কাজ করেন তিনি। রোকনের সাহায্যে বাসা থেকে পালালেন জাহানারা। সময়টা ১৯৬৯ সাল। সেই সময়ে জাহানারার সঙ্গে দেখা হল রুহুলের। এই দেখা হওয়াটার একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে। ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার পেছনে এই রুহুল আর রাহেলার দেখা হওয়াটার একটি প্রতিক্রিয়া আমরা পরে দেখতে পাবো।
এবার রুহুলের প্রকৃত নাম বলি। আমাদের এই রুহুলই সিরাজ সিকদার। সিরাজ সিকদার আর জাহানারা পরস্পরকে পছন্দ করলেন, ভালবাসলেন। এবং উত্তপ্ত সেই সময়ে এক সঙ্গে থাকাও শুরু করলেন, এখনকার ভাষায় লিভ টুগেদার। জাহানারা নাম পালটে হলেন খালেদা। এনএসআই তখন হন্যে হয়ে খুঁজছে জাহানারাকে। একপর্যায়ে জেনে গেলো খালেদাই এখন জাহানারা। আবার নাম পালটাতে হল। খালেদা এবার হলেন রাহেলা। মজার ব্যাপার হলো, তখন সিরাজ সিকদারও নতুন একটি নাম নিয়েছিলেন। সেই নামটি ছিল হাকিম ভাই। বলে রাখি, সিরাজ সিকদার পরে যখন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি গঠন করেন, তখন রাহেলার নাম হয়ে যায় জাহান, কমরেড জাহান।
হুট করে এর আগে দরিদ্র কৃষকের মেয়ে রওশন আরাকে বিয়ে করেছিলেন সিরাজ সিকদার। সেই সম্পর্ক কখনোই মধুর ছিল না। দুজনের শিক্ষা-দিক্ষা ও শ্রেনীগত পার্থক্যের কারণে সম্পর্কটি শেষপর্যন্ত টেকেনি। কিন্তু জাহানারা কবিতা লিখতেন। নারীবাদি চিন্তাভাবনা ছিল। ফলে দুজনের মধ্যে একটা বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হতে সময় নেয়নি। সিরাজ সিকদার ও জাহানারা মিলে পরবর্তীতে লেখালেখি করেছেন, বিপ্লবের কবিতাও লিখেছিলেন।
এনএসআই তখন দুজনকেই খুঁজছে। এ কারণে রুহুল ও রাহেলাকে বার বার শেল্টার পালটাতে হয়েছিল। সূর্য রোকন লিখেছেন, সিরাজ সিকদার তখন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। এনএসআই সিরাজ সিকদারকে না পেয়ে শ্রমিক আন্দোলনের সদস্যদের ধরে কাফকা মামলায় জেলে দিয়েছিল। কাফকা মামলা হল, পরের বউকে অপহরনের অভিযোগ।
এনএসআই শেষ পর্যন্ত আর সফল হয়নি রুহুল ও রাহেলাকে গ্রেপ্তার করতে। এর মধ্যে বিগ্রেডিয়ার হাকিম আবার বিয়েও করেন। সব চেয়ে বড় কথা হল, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পুরো ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সিরাজ সিকদার বরিশালের পেয়ারা বাগানে নতুন দল করেন। সেই গোপন বিপ্লবী দলে যোগ দেন জাহানারা হাকিম। পুরোটা সময় ছায়ার মতো তিনি ছিলেন সিরাজ সিকদারের সঙ্গে। পরে তারা দলের অনুমোদন নিয়ে বিয়ে করেন, তাদের একটি ছেলেও হয়।
সিরাজ সিকদারের একসময়ের সহযোগি সূর্য রোকন লিখেছেন মজার একটি তথ্য। ১৯৭৩ সালে সিরাজ সিকদার আর্মির হাতে মাদারিপুরে একবার ধরা পরেছিলেন। কিন্তু সেসময়ের বঙ্গবন্ধু সরকারের উপর বিতশ্রদ্ধ আর্মির কমান্ডার মহসিন তাদের ছেড়ে দেন। এরপর দুজন পার্বত্য চট্টগ্রামে চলে যান।
দিনটি ছিল ১৯৭৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ওই তিন তিনি চট্টগ্রামে ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। আর সাভারে সিরাজ সিকদার খুন হন ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি। (কেউ বলেন শেরে বাংলা নগরে। বাংলাদেশে এটাই প্রথম ক্রসফায়ারের ঘটনা। সেই একই গল্প। পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় বাধ্য হয়ে পুলিশের গুলি)। এরপর জাহানারাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কুমিল্লায় তাঁর ভাইয়ের কাছে। আর তাদের একমাত্র সন্তান অরুণকে দেওয়া হয় সিরাজ সিকদারের বাবার কাছে, ঢাকায়।
আগেই বলেছি, সিরাজ ও জাহানারার বিয়ের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল দলটির মধ্যে। দলের মধ্যে প্রথম বিরোধ তৈরি হয় এই বিয়ে নিয়েই। এই বিরোধের ফল হয়েছিল মারাত্বক। দলের মধ্যে খুনোখুনির ঘটনা ঘটে। সম্ভবত, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নিজেদের মধ্যে প্রথম খতমের ঘটনা ঘটে এই বিয়েকে কেন্দ্র করেই, পার্টির সিদ্ধান্তে। সেই ঘটনায়ও জড়িয়ে আছে আরেক প্রেম কাহিনী। সেই ঘটনা পরের পর্বে
নোট: পিয়াল সিরাজ সিকদার নিয়ে একটি সিরিজ করেছিল সামুতে। সিরাজ সিকদার নিয়ে পড়তে গিয়ে সেই সিরিজের সূত্রে পেয়ে যাই সূর্য রোকনের ছোট্ট লেখাটি। সিরাজ সিকদার নিয়ে জানতে পিয়ালের সিরিজটিও পড়তে পারেন। আর এই পর্বের অনেক কিছুই পাওয়া যাবে পিয়ালের সিরিজে।
চাঞ্চল্যকর কাহিনী মনে হচ্ছে । বই পড়ার আগ্রহও হলো। সিরিজ চলুক দ্রুতগতিতে । অপেক্ষায় থাকছি ।
শেষ পর্বে সবগুলোর বই এর নাম দেবো। পইড়ো, ভাল লাগবে
পিয়াল সাহেবের সিরিজটা সেই আমলেই পড়ছি। আপনারটা তো পড়তেছি। দারুন। জীবন কত তুচ্ছ এইসব মানুষের কাছে তখন ছিলো!
পিয়াল ভাই এর সিরিজটার লিংক দিতে পারবেন, শান্ত ভাই?
http://www.somewhereinblog.net/blog/omipialblog/28983672
http://www.somewhereinblog.net/blog/omipialblog/28983787
http://www.somewhereinblog.net/blog/omipialblog/28985196
http://www.amarblog.com/omipial/posts/73771
ওই মানুষগুলোর অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে খুব ভাল থাকতে পারতেন। কিন্তু জীবনকে তুচ্ছ করেছেন কেবল একটা শোষনমুক্ত দেশের জন্য। ভাবা যায়!
দারুন লাগতাছে পড়তে, জানতে।
পর্বগুলি আরেকটু ঘন ঘন দেয়া যায় না, মাসুম ভাই?
সময়ের খুবই অভাব। সিরিজ যে শেষ করতে পারবো সেইটাই আসল।
বিপ্লবের প্রেম কাহিনি দেখি! মজা লাগলো এই পর্ব। পরে যেইটার ইঙ্গিত করলেন সেইটার সাথে কী হুমায়ুন কবীর আছেন?
ধীরে বন্ধু ধীরে। সবই আসিবেক
হুমায়ুন কবির।
পার্টির ইশতেহারে কবীর লেখা ছিল
মারাত্নক এক সিরিজ শুরু করছেন!
দূর্বোধ্য একজন বিপ্লবী'র জীবনের প্রেমের কথা জানিই বা ক'জনে।
শান্ত'রে থ্যাঙ্কু, পিয়াল্ভাইয়ের লিঙ্ক শেয়ারের জন্যে
পড়ার জন্য ধন্যবাদ
আছি।
সাথেই থাকেন
চলুক। পড়ছি।
চলবে
কর্ণেল তাহের, মেজর জিয়া উদ্দীন সহ সে সময়ের অনেক দূু:সাহসী তরুণ সিরাজ সিকদারের অনুগামী ছিলেন । তাদের মত/পথ সঠিক না ভুল ছিল তা ইতিহাস ঠিক করবে । আমার দূ:খ হয়, যখন দেখি আমাদের পচা রাজনীতি তাদের কাউকে দেশ প্রেমের তিলক আর কাউকে দেশদ্রোহীতার কালিমা পরিয়েছে ।
মূল্যবান পোষ্ট । অনেক কিছু জানা হল । সমসাময়িক হলেও এত কিছু জানতামনা। ধন্যবাদ !
দিন/তারিখ মনে নাই । সিরাজ হত্যার ঘটনা এবং তা নিয়ে কাগজে প্রকাশিত তখনকার সরকার প্রধানের আস্ফালন কিন্তু কখনো ভুলার নয় ।
পিয়াল সাহেবের সিরিজটাও পড়ার সুজোগ হলো আপনার পোষ্টের সুবাদে । আবারো ধন্যবাদ ! ভাল থাকুন ।
অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য
পড়ছি
পড়াশুনা করা ভাল
জমে উঠছে সিরিজ, দারুণ!
ধন্যবাদ
পৈত্রিক সূত্রে সিরাজ সিকদার আর মেজর জিয়াউদ্দীনের ঘটনা কিছু কিছু জানি।
পিয়াল ভাইয়ের লেখাটাও সামুতে থাকতে পড়েছি।
তবুও আপনার লেখাটাও অনেক উপভোগ করছি।
জানা ঘটনা কিছু আমাদেরও জানান
সিরিজ চলুক দ্রুতগতিতে । অপেক্ষায় থাকছি
প্রেম একটা মারাত্বক ব্যাপার
কতো মারাত্বক?
বিপ্লব ঘটানোর মতো মারাত্বক
উদাহরণ দাও
আপনিতো লিখছেন সিরিজ
অনেক আগে খুব সম্ভবত বিচিত্রায় একটি উপন্যাস ছাপা হয়েছিল সিরাজ শিকদারের কাহিনী নিয়ে অনেকদিন পর আবার পড়ছি; ভালো লাগছে লেখাটা; তবে সাংবাদিক সুলভ হচ্ছে। - উপন্যাসের প্রচুর উপাদান দেখছি।; শাহাদুজ্জামান এ নিয়ে লিখলে চমৎকার হতো।
আমি তো উপন্যাস লিখতে পারি না। আমি সাংবাদিক। তাই সাংবাদিকসুলভ হচ্ছে।
বিচিত্রার উপন্যাসটির নাম কি ছিল?
সিরাজ সিকদার ক্ষমতা দখলের লোভে বিভোর এক কুলাঙ্গার ছিলেন , এদের মত কিছু লোকের কারনে দেশের ইতিহাস বদলে , সময়ের আবর্তে এখন হেফাজতে ইসলামকেও সহ্য করতে হচ্ছে।
কুলাঙ্গার তিনি মোটেই ছিলেণ না।
মন্তব্য করুন