গল্প: কার ছবি নেই
১.
বাংলাদেশ ব্যংক কলোনী হাই স্কুলটা আগ্রাবাদের ব্যংক কলোনীর ভেতরে অবস্থিত। জায়গাটা পনেরো-ষোলো বছর আগে যেরকম ছিলো, স্বাভাবিকভাবেই এখন আর সেরকম নাই। কলোনী-গেটের মুখে ইদানীং লাইব্রেরী'টা চোখে পড়লো। এইখান থেকে ১৩ টাকা দিয়ে চাচা চৌধুরী কেনা হতো। কমিকগুলোর নতুন পাতা ওল্টানোর অনুভূতিটা মনে পড়ে গেল। কখনো কখনো একটা কমিক কিনেই হাঁটতে হাঁটতে পড়ে ফেলা হতো। আবার কখনো 'পড়ে ফেললেই শেষ হয়ে যাবে' ভেবে ইচ্ছে করে দেরী করা হতো। অনেকদিন পর সায়ানের সে কথাগুলো মনে পড়ে গেল, তিতলিকে নিয়ে এখানে এসে।
মেয়েটা ঠিক বুঝতে পারছে না। সায়ান ভালো ভালো জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবার কথা বলে ওকে নিয়ে এসেছে চিটাগাংএ। কিন্তু আসার পর এখন চলছে শহরের রাস্তায় রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ঘোরা-ঘুরি। প্রথমে সে গেল সিএন্ডবি কলোনী নামের একটা জায়গায়। সেখানে কথা নাই, বার্তা নাই; একটা বিল্ডিংএর ভেতরে ঢুকে পড়লো। চারতলায় উঠে একটা দরজার পাশের দেয়ালে খুঁজে বের করলো সিমেন্টে খোদাই করে লেখা ওর নামের ইনিশিয়াল। কালে কালে চুনের আস্তর পড়েছে, কিন্তু খোদাই করা লেখাটা পুরোপুরি ঢেকে যায় নি। এই ছেলেটা যে এত অতীতে অতীতে ঘুরতে পারে! মাঝে মাঝে তিতলি অস্থির হয়ে যায় দেখলে।
ওরা সেখান থেকে গেল ব্যংক কলোনীতে। স্কুলবাড়িটা এখন আর আগের মতো খোলামেলা নেই। উঁচু দেয়াল উঠেছে, উঠে স্কুলটাকে অনেক ছোট পরিসরে আঁটিয়ে দিয়েছে। আগে কলোনীর একদম একপাশটায় বসে থাকা জমজমাট লাল-সাদা একতলা এল শেপের ভবনটাকে মনে হতো, পুরো কলোনীরই একটা অংশ। কলোনীর সীমানাই স্কুলের সীমানা। কিন্তু এখন এই উঁচু দেয়ালটাকে মনে হয় স্কুলের বাউন্ডারি। তিতলি জানতে চায়, তুমি কি এই স্কুলে পড়েছিলে?
-হুম। ওয়ান থেকে সেভেন পর্যন্ত।
তারপর?
-তারপর এখান থেকে আরেক জায়গায় চলে গিয়েছিলাম।
কেন?
-বাবার ট্রান্সফারের কারণে।
তুমি এখন এখানে এসেছ কেন?
-তোমাকে নিয়ে আমার শৈশব স্মৃতি বিজড়িত জায়গাগুলো ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করছিলো। ভাবছিলাম তুমি আর আমি যদি ছোটবেলা থেকে এই স্কুলটায় একসঙ্গে পড়তাম, তাহলে কেমন হতো?
এহ্, ঠিক করে বলো, তোমার কি আমাকে নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, নাকি অন্য কিছু? তোমরা না কই জানি পানির টাংকির ওপর টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলতা আর একটা মেয়ে বারান্দায় দাঁড়ায় দাঁড়ায় দেখতো, সেটা কই?
-উরে, সেইটাও তোমার মনে আছে? বাহ বাহ। ওটা কলোনীর আরেকপ্রান্তে। এখন তো মনে হয় পোলা-পান এই বাউন্ডারী-ওয়াল পেরিয়ে কোথাও যাওয়ারই সুযোগ পায় না।
হুম। ওরা স্কুল পালানোর সময় এই দেয়াল টপকায়।
-আগে আমরা কলোনীর দেয়াল টপকে বাইরের শহরটায় গিয়ে পালাতাম, এখন ওরা বাউন্ডারী-ওয়াল টপকে কলোনীতে গিয়ে পালায়। কি নিদারুণ বিবর্তন!
ঠিকই আছে। আমাদের সময় দিন-কাল অনেক ভালো ছিলো। মানুষের মধ্যে টেনশন অনেক কম ছিলো। এখন তো বাচ্চাকে স্কুলে পাঠিয়ে মা'কে চিন্তায় বসতে হয়, ছেলে বেঁচে-বর্তে ঘরে ফিরবে তো?
-একটা দারুণ কথা বলেছো। চলো আমরা কলোনীর যেখান দিয়ে ওয়াল টপকে পালাতাম সেই জায়গাটা কি আগের মতোই আছে কিনা দেখি।
ওরা গিয়ে দেখলো দেয়ালের সেই কাঁটাতারের বেড়াভাঙা জায়গাটা এখনও আগের মতোই আছে। শুধু বেশ খানিকটা জঙ্গল তৈরী হয়েছে আশেপাশে। দু'জনে কাপড় বাঁচিয়ে আরেকবার জায়গাটা টপকালো। এবং স্টাফ কলোনী পার হয়ে সিডিএ ২৮ নম্বর রোডের মাথায় চলে আসলো।
সায়ানের সঙ্গে এ কাজগুলো করতে তিতলির খুবই মজা লাগছিলো। যৌথ পরিবার, বাবা-মা, ভাই-বোন আর নানা-নানু-দিদা-ফুপিদের মধ্যে বড় হওয়া তিতলি এর আগে কখনো এমন করে কোনো দেয়াল টপকায় নি। অথচ আজ কত অনায়াসে একটা বেশ উঁচু দেয়াল সে টপকে গেল। কোথাও একটু কাপড়ও আটকালো না। সম্ভবত: চার বছর বয়স থেকে জাগো আর্ট সেন্টারে গিয়ে নাচ শেখার সুফল এটা। আর মনের সাহসটুকুর উৎস যে কি সেটা তিতলি নিজেও বুঝতে পারছিলো না।
অবশ্য দু'একটা শিশুমানব, যারা পাশেই মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে নিজেদের শরীরে ধুলা-বালি মাখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো অনেকক্ষণ ধরে, তারা খানিকক্ষণ চোখ বড় বড় করে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। হয়তো একটু ভাবলো, এই বাচ্চা দু'টো এত বড় কেন? শিশুমানবদের মাথার চুলে হিজিবিজি হাত বুলিয়ে দিয়ে তিতলি দৌড় লাগালো সায়ানের পেছন পেছন।
২৮ নম্বরের মাথা থেকে ওরা রিকশা নিলো এবং সিডিএ, বেপারীপাড়া, হালিশহর, পুলিশ লাইন এলাকাগুলোর এদিক দিয়ে-সেদিক দিয়ে ঘুরে লাকি প্লাজায় চলে আসলো। সায়ান ছোটকালে এখানে একটা খাবারের দোকান দেখেছিলো, ক্যফে নেওয়াজ। এখন সেটা নেই। সেই দোকানের মোগলাই পরোটার কথা মনের ভেতর থেকে গেছে, এতদিন পরও। যে কারণে দোকানটার দেখা না পাওয়ায় সায়ানের খানিকটা মেজাজ গরম হলো।
গরম মেজাজ নিয়েই সে আশপাশে খুঁজে ফুড ফেয়ার নামের একটা দোকানে ঢুকে পড়লো। নিতান্ত খারাপ না। বিশেষত চিকেন শর্মা একটা খাওয়ার পর ওদের দু'জনেরই মনে হলো আরো একটা করে খাওয়া উচিত। বেড়াতে গেলে বোধহয় সবারই ক্ষুধা বেড়ে যায়। নাহলে তিতলি কখনো এমন জাম্বো সাইজের শর্মা একটার পিঠে আরেকটা শেষ করতে পারতো না। সায়ান চারটি খেয়ে দম নিলো। শুধু খেলেই তো আর চলে না, বেলা বাড়ছে অথচ কত কত কাজ এখনো রয়ে গেল বাকী।
ওরা বৌদ্ধ মন্দির যাবার জন্য রিকশা ঠিক করলো। মানুষের কোলাহল অনেক বেড়ে গেছে শহরটায়। চৌমুহনীর জ্যকস্ মার্কেটটা দেখে সায়ানের মনে পড়লো, ছোটবেলায় খেলনা কেনার জন্য আব্বুর হাত ধরে ও এ মার্কেটটায় আসতো। সে সময় আব্বুর ওপর যতটা নির্ভর করতো, এখন তিতলির ওপরেও ততটাই নির্ভর করে সে।
রিকশা মার্কেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে, ভেতরে চলে গেল ওরা এবং সায়ান বড় একসেট লোগো কিনে নিল তিতলির কাছ থেকে। ওর এমন শিশুসুলভ আচরণে কোনো বিচিত্র এক কারণে তিতলি বিরক্ত হচ্ছিলো না মোটেও। এটা অনেক বেশি ভালো লাগলো সায়ানের। মেয়েটা ভীষণরকম মনের মতো।
মোগলটুলী আর এনায়েতবাজার পার হয়ে বৌদ্ধ মন্দিরে চলে আসলো ওরা। সায়ান একটা মোমবাতি কিনে মন্দিরের ভেতরে প্রায় ঢুকে যাচ্ছে দেখে আঁতকে উঠলো তিতলি, এই কি করিস? তুই বৌদ্ধদের মন্দিরে ঢুকিস ক্যন?
-হে রাম, মেয়েটা এসব কি বলে! মন্দির ইজ মন্দির। আমি ঢুকবো না ক্যন? অনেকদিন উপাসনা করি না। আজ একটু ওস্তাদকে অফিসিয়ালি থ্যংক্স জানাই। হাজারহলেও তোর সঙ্গে এমন চমৎকার একটা ভ্রমণের সুযোগ করে দিসে, তাকে ধন্যবাদ না দিলে খুব খারাপ দেখায়।
তিতলিও জুতা-মোজা খুলে মন্দিরের মধ্যে ঢুকে পড়লো সায়ানের সঙ্গে। যদিও মন্দিরের গেটে ওর নতুন কেনা হাশ-পাপিস্এর শ্যু রেখে যেতে একটু সংকোচ হচ্ছিলো। সায়ান কটমট চোখে তাকাতেই ওগুলো প্রায় ছুড়ে ফেলে ভেতরে ঢুকে গেল তিতলিও। এরকম দশটা শ্যু জলে ভাসিয়ে দিতে হলেও, সায়ানের দুষ্টামিভরা কটমটে চোখের সামনে কিছুই করার নেই বেচারীর। নাহলে যে পরে এটা নিয়ে পচানো থামবেই না।
ওরা দু'জনে ছোট মূর্তিটার সামনে একটা মোম জ্বালিয়ে প্রার্থনা করতে বসলো। ঈশ্বর তোমার অশেষ কৃপায় যা কিছু পেয়েছি তার জন্য ধন্যবাদ। যা কিছু তুমি দাওনি তার জন্যও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ যা কিছু তুমি দিয়ে আবার নিয়ে গেছ, তার জন্য। ধন্যবাদ তোমার অনুমতির জন্য, ধন্যবাদ তোমার নিষেধাজ্ঞার জন্য; ধন্যবাদ তোমার ক্ষমার জন্য। ধন্যবাদ ঈশ্বর, যা কিছু আমার জন্য প্রস্তুত করেছ সেজন্য। এবং যে মৃত্যূ তুমি আমার জন্য রেখেছ, ধন্যবাদ সেজন্য। ধন্যবাদ স্বর্গে আমার জন্য যে জায়গা তুমি গড়েছ সেজন্য। অনন্তকাল তোমায় ভালবাসার সুযোগ দেবার জন্য ধন্যবাদ হে ঈশ্বর।
সায়ানের প্রার্থনার বহর দেখে মন্দির থেকে বের হয়ে তিতলি তো হেসে কুটি-কুটি। তোকে দেখলে কিন্তু মনে হয় না, তুই এরকম প্রার্থনাও করতে পারিস।
- আরে পারি না আবার, ঠিকই পারি। কিন্তু সবসময় করি না। বেশি বেশি করলে দাম কমে যায়। ওস্তাদ কথা শুনতে চায় না। তাই মাঝে মাঝে করি। আর ওস্তাদ সবসময় আমার জন্য ভালো ভালো জিনিসের ব্যবস্থা করে।
কি রকম ভালো ভালো জিনিস?
-এই যেমন আপাতত তোকে ম্যনেজ করে দিয়েছে।
আমি ভালো জিনিস? আর তুই কি?
-আমি হলাম ভালো জিনিসের ভোক্তা। বিশেষ ভোক্তা।
তাই না? খালি নিজেই সব। আমিও তোর ভোক্তা।
-ঠিক আছে, আমি তোর ভোক্তা, তুই আমার ভোক্তা।
এইসব বলতে বলতে ওরা হাঁটছিলো শহরের ছবির মতো রাস্তাগুলো ধরে ধরে। সায়ানের একটা হাত দুই হাত দিয়ে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে তিতলি। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে এক ফোঁটা ছেলেটা। দুই পাশে পাহাড়, ল্যন্ডস্কেপের সিনারীও, শীতল হাওয়া, দু'জন মানুষের পাশাপাশি হাত ধরে চলা; সব একটা বিন্দুর আকার ধারণ করে মহাশূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছিলো বার বার।
হঠাৎ তিতলির মোবাইল বেজে উঠলো। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসলো ওর বাবার আনন্দময় গলা,
আম্মু, কি খবর?
-এই তো, ভেরি ওয়েল। হাউ আর ইয়া ডুড?
মী ওয়েল ঠু, মা' ডিয়ার ইয়ং লেডী। তুমি কোথায়?
-ডিপার্টমেন্টে বাবা, একটা মেক-আপ ক্লাস হচ্ছে। জানোই তো, পরীক্ষার আগে আগে কি রকম চাপ থাকে। তুমি, আম্মু তোমরা সবাই কেমন আছো?
সেটা সত্যি সত্যি জানতে চাইলে তুমি ক্লাস শেষে ফোন করো। আমরা সশরীরে এসে তোমায় জানিয়ে যাবো।
-মানে?
মানে হচ্ছে আমরা দু'জন এখন ঢাকায়। তোমার ক্যম্পাসের দিকেই যাচ্ছি। কিন্তু মধ্যপথে তোমার মা নিউমার্কেট দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারেন নি। যে কারণে আমরা এখন একটু মার্কেটে ঘুরছি এবং অদরকারি জিনিস-পাতি কিনছি। তোমার মা বলেছে, অনেকদিন নাকি বাসায় অদরকারি জিনিস কেনা হয় না। আশা করছি কেনা-কাটা শেষ হলেই তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারবো।
-মানেহ্?
হাহা, বেশি চমকে যাবার দরকার নেই মামনি। ক্লাস শেষ করো। আমরা আসছি।
২.
তিতলি ঘড়ি দেখে। সোয়া দুইটা বাজে। সিরিয়াস একটা ঝামেলা হয়ে গেল। বাবাকে বলা যেত, সে বান্ধবীর বাসায় এসেছে। ক্যম্পাস থেকে অনেকটা দূরে। তাহলেই আর এত বিপদ হতো না। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। একবার যেহেতু ক্লাসের কথা বলে ফেলেছে সুতরাং এখন চাইলেও সেটা পাল্টানো যাবে না। আর পাল্টানো উচিতও হবে না। এটা ওনাদের মনে দীর্ঘমেয়াদী কুপ্রভাব ফেলবে, তিতলি জানে। এমনিতেই বাবা তার একমাত্র আদরের মেয়েকে হলে রেখে পড়ানোর জন্য সারাদিন টেনশন করেন। তার মধ্যে যদি ক্যম্পাসে এসে মেয়েকে দেখতে না পান, তাহলে মনে তো আঘাত পাবেনই, শরীরেও আঘাত পাবেন।
মেয়েটি চিন্তায় প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়ার ঠিক আগে আগে সায়ান একটা 'ওয়ে আউট' খুঁজে বের করে ফেললো। এমনিতেও ওর বিমানে চড়ার শখ বহু পুরোনো। কথায় আছে, মানুষ যা চায় তা পায় না; সেরকম ওর'ও কখনো সুযোগ হয় নি বিমানে চড়ার। সে ভেবে দেখলো, সুযোগ যখন একটা এসেই গেছে, তখন এই অপূর্ণ শখটা মিটিয়ে নিতে সমস্যা কি? মাঝখান দিয়ে একটা বিপদ থেকেও যদি বাঁচা হয়ে যায়, তাহলে তো ভালোই।
আর ওরা এমন একটা কাজ করে ফেলেছে, যে সেটা স্বীকার করে নিলেও অপরাধ মওকুফের সুযোগ নেই। তিতলির বাসায় কোনভাবেই বিষয়টা সহজভাবে মেনে নেবে না। কনফেস্ করার সুযোগ যেহেতু নেই, অল আউট এ্যটাকে যাওয়াই ভালো। হেরে গেলেও স্বান্তনা পাওয়া যাবে, অন্তত সর্বোচ্চ চেষ্টা তো করা হয়েছিলো।
দ্রুত কর্মপন্থা ঠিক হলো। তিতলি বাবাকে ফোন করে জানালো, মা'কে নিয়ে খুব ভালো করে নিউমার্কেট এবং আশপাশের মার্কেটগুলোয় ঘুরতে। কেননা ওদের ক্লাসটিচার হঠাৎ একটা কুইজ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যেটা শেষ হতে হতে অন্তত সাড়ে ছয়টা বাজবে। এর আগে ওর পক্ষে বাবা-মা'র সঙ্গে দেখা করা অসম্ভব।
বাবা তাই শুনে জানালেন, তথাস্তু, তারা হাতের কাজগুলো ভালোমতোই সেরে নেবেন। তবে পরীক্ষা শেষে তিতলিকে বাবা-মা'র সঙ্গে উত্তরায় চাচার বাসায় যেতে হবে এবং আজ রাতে তাদের সঙ্গে থাকতে হবে, এই দাবিও জুড়ে দিলেন সঙ্গে। তিতলি তার চাচার বাসায় থাকার ব্যপারে আগে সর্বদাই ঘোর আপত্তি জানাতো, তবে এবার কোনো উচ্চ-বাচ্যই করলো না। একবার বলতেই রাজি হয়ে গেল বাবার কথায়।
এসব ফোনালাপ যতক্ষণে হচ্ছে ততক্ষণে ওদের ট্যক্সি পতেঙ্গার দিকে অনেক এগিয়ে গেছে। পথে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের অফিস। ওয়েবসাইট থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন করা হয়ে গেছে। একটা আশার আলো সম্ভাবনা হয়ে উকিঝুঁকি মারছে। ৪ টা ২৫ এ যে ঢাকার ফ্লাইট, সেটায় একটা ব্যবস্থা হলেও হতে পারে।
প্রার্থনার জোরেই হোক, কিংবা গুরুজনদের আশীর্বাদের কল্যাণেই হোক। টিকেট পাওয়া গেল। সায়ান যেমনটি ভেবেছিলো, বিমানযাত্রা তেমন সুখকর ছিলো না মোটেও। তবে একটা বিষয় স্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, ফ্লাইট ছিলো একদম অন-টাইম। কাঁটায় কাঁটায় ৫ টা ১৫ তে বিমান শাহজালাল বিমান বন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করলো।
তিতলির বিমান যাত্রা উপভোগের মতো মনের অবস্থা তখন ছিলো না। আবার এইভাবে ট্যূর বাতিল করে ফিরে আসার জন্য ভালোও লাগছিলো না। দোলাচলে ভরা মন নিয়ে ও সায়ানের কাঁধে মাথা রেখে বসেছিলো। আর সায়ান মাঝে-মধ্যেই ওর চুলের মধ্যে অদৃশ্য আঁকিবুকি কাটছিলো।
এয়ারপোর্ট থেকে পড়ি-মড়ি দৌড়ে বের হয়ে, আরো একবার ভগবান বুদ্ধের অশেষ কৃপায়, তিতলি সোয়া সাতটায় সত্যি সত্যি ক্যম্পাসে পৌছে গেল। ট্রাফিক জ্যম বেরসিকের মতো ওদের এই মিশন এ্যবর্টিং-কে ভণ্ডুল করে দেয় নি।
তিতলির বাবা-মা অনেকক্ষণ আগেই ওর জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন এবং ক্যম্পাসময় পায়চারি দেয়া শুরু করেছেন। মেয়েকে দৌড়ে দৌড়ে আসতে দেখে খানিকটা আপ্লুত হয়ে পড়লেন। বাবা-মেয়ে আর মা'র অশ্রুসজল সাক্ষাৎ হলো। সায়ান দূরে দাঁড়িয়ে কেন সবার চোখ ছলছল করছে সেটা আন্দাজ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছিলো। কিন্তু তার চোখটাও কিছুটা আদ্র হয়ে আসছে দেখে আর দাঁড়ালো না। তাড়াতাড়ি সিগারেটওয়ালা রুবেলের খোঁজে মধুর ক্যন্টিনের দিকে পা বাড়ালো।
৩.
একটা গোল্ড লীফ ধরানোর সঙ্গে সঙ্গে সায়ানের মনে পড়লো, দুইদিন আগে তিতলির রাগ ভাঙানোর জন্য যে কাজটা করার প্ল্যন করেছিলো সে, সেটা করা হয় নি। চিটাগাং থেকেই ফিরে আসার জন্য ওর প্ল্যনের সবচে' গুরুত্বপূর্ণ অংশটা বাকী থেকে গেছে। এ অংশ বাস্তবায়নের জন্য যা দরকার, সেটা এখনো রয়ে গেছে ওর পকেটের ভেতরেই। তিতলিকে দেয়া হয় নি।
তক্ষুণি আবার ফোন করলো সে। একবার-দুইবার-তিনবার, কেউ ফোন ধরছে না। সায়ানের আবারো মেজাজ গরম হওয়া শুরু হলো। মেয়েটা বাবা-মা'কে পেলে সব ভুলে যায়। কি আশ্চর্যের কথা! সেও বারংবার ফোন দিয়েই যেতে লাগলো।
একসময় ওপাশ থেকে তিতলি'র গলা পাওয়া গেল। কি ব্যপার? হঠাৎ এরকম ফোনের বন্যা শুরু হলো কেন?
-তুমি কই?
এই যে এখন হল থেকে বের হবো, আব্বু-আম্মুর সঙ্গে উত্তরা যাবো।
-এক্ষুণি আমার সঙ্গে দেখা করে যাও।
অসম্ভব। উনারা গেস্টরুমে বসে আছেন।
-যেকোন ভাবে ম্যনেজ করো। তোমার সঙ্গে জরুরি আলাপ আছে।
আজকে না বাবু। প্লীজ, বোঝার চেষ্টা করো।
-বোঝার চেষ্টা করেছি, করে দেখেছি নো ওয়ে। এবার তুমি বোঝার চেষ্টা করো। উনারা তো গেস্টরুমে বসেছেন। তুমি কোনভাবে সটকে বেরিয়ে পড়ো। বাকীটা আমি দেখছি।
ওক্কে, ট্রাইং বস্।
-দ্যটস্ মা' গুড গার্ল।
তিতলিকে নিয়ে সায়ান বেলালের দোকানে এসে দাঁড়ালো। হঠাৎ এমন ডাকাডাকির কারণ জানতে চাইলে সে বললো; এমনি, একসঙ্গে এক কাপ চা খেতে খুব ইচ্ছে করছিলো, তাই ডেকেছি। এটা শুনে তিতলি ভ্রু কুচকে ফেললো।
গেস্টরুমে বাবা-মা বসে আছেন। তারা আজ মেয়ের আচার-আচরণ দেখে বেশ খানিকটা চিন্তায় এরইমধ্যে পড়ে গেছেন। যদিও এখনো কেউই কিছু বলেন নি, তাও তিতলি ঠিকই বুঝতে পেরেছে। সে নিজেও আসলে আজ সারাদিনে কি কি ঘটেছে আর ঘটে নি, এখনতক তার হিসাব মেলাতে বসার সুযোগ পায় নি। আর সায়ান কিনা এখনো ওরসঙ্গে দুষ্টামি করেই যাচ্ছে!
এ সময় ও পকেট থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বের করে তিতলির সামনে রেখে বললো, প্লীজ এটা নাও। আমি খুব, খুব খুশি হবো, তুমি এটা নিলে। প্লীজ গ্রহণ করো।
তিতলি আলতো করে বাক্স'টা হাতে নিয়ে ডালাটা খুললো। ভেতরে একটা হীরে বসানো আংটি, আধো আলো-আধো অন্ধকার মাখা এই শীতের সন্ধ্যায় নিজের ঝিকিমিকি উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।
---
হাহাহাহা বস। পুরা বাংলা সিনেমার দিকে টার্ন নিয়েছে। ওয়াহ ওয়াহ দারুন। কিন্তু পকেটে হাত দেয়ার ব্যাপারটা দিয়ে আংটি যে বেরোবে সেটা বোঝা গেছে বস। আর হীরার আংটি একটু বেশি বেশি হয়ে গেলো না?
বাকি পর্ব দেখি কে লিখে। দারুন জমেছে, মজা পাচ্ছি।
কীপ আপ দি গুড জব বাডি।
সায়ান তো ভালোই বান্দর।
ভাবতেছি সায়ান-তিতলি শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছয়
আজকের লিখাটা আমার ভালো লাগেনি। প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।
একমত
কে জানি কোরিয়া থেকে বাংলাদেশ যাচ্ছে , ভাবতেছি তারে নিয়ে উত্তরা তিতলির চাচার বাসায় ওঠায় দিলে কেমন হয়?
পরের পর্ব যে লিখবে সে এটা ভেবে দেখতে পারেন।
হ দেন দেন .।.।।
হাম দিল দে চুকে সোনমের নতুন ভার্সান।
এইটা হলে ঠিকাছে, দেখি?
শুরুতে ভয়ে ভয়ে ছিলাম জমবেনা হয়ত। কিন্তু যে মোড় দিলেন, অসাধারণ! তবে একটা সাসপেন্স এর বিশাল সম্ভাবনা ছিল, সেটা হলনা। আমি শিওর, রাতে একসাথে থাকার বিষয়টাকে একটা স্মার্ট, দুর্দান্ত টেক্সট() আপনার হাত থেকে পেতে পারতাম।
রায়হান ভাই, কেমন আছেন?কাল আপনাকে নিয়ে কত গুজব শুনলাম , কিন্তু সঠিক খবর পেলাম না যে, আছেন কেমন?
গুজবের থিকাও বেশি। লাইফ ইজ স্টরেঞ্জার দ্যান ফিকশন ।
খাইছে। কাহিনী কি?
আমার গুরু'র আবার কি গুজব!
জানান, আর সইতে পারছি না।
কীসের গজব, রায়হান ভাই ? খুইল্লা (জামা-কাপড় না...) কন ... টেনশিত
মেজবাহ সাহেব, আপনি কই! আপনার জন্য আমি লিখতে পারচ্ছি না। আপনি একটা পোষ্ট দিন, আমার মন ও হাত খুলে যাক। কেমন আছেন। ভাল থাকুন সবসময়।
কঠিন প্রেম
গজবের কতা কৈলেন্না, রায়হান ভাই
গুরু, এটা কি কইলেন! আপনার সাথে কি আমার কম প্রেম। আমার মত 'সারগেদ' আর সারা জীবনে পাবেন না। বলে দিলাম।
গুরু, এটা কি কইলেন! আপনার সাথে কি আমার কম প্রেম। আমার মত 'সারগেদ' আর সারা জীবনে পাবেন না। বলে দিলাম।
মীরের পোষ্টে পেচ্ছাপেচ্ছি! মীর ভায়া আবার মাইন্ড খাইবো না তো?
চলতে থাক।দারুণ মজা লাগতেছে।সায়ানের মতো সুইট কাউরে তো দেখলাম না। আপসুস।
একটানে পড়ে ফেলেছি। ভাল সমাপ্ত হয়েছে (আমি কষ্ট ভালবাসি), যদিও গল্পে এমন হয় না।
(নেক্সষ্ট মনে হচ্ছে নাই, যদি থাকে দিয়ে দিন - বাসর রাতে একটা বিশাল ক্যাচাল লাগিয়ে দিতে পারেন।)
রাসেলের সঙ্গে একমত। আসলে প্রত্যাশা বেড়ে গেছে এই সিরিজ নিয়ে।
অসাধারন!!!!!
এটা মীরের পোস্ট ? মীরের আবেগ,আর ভাষায় মনের মাধুর্য কোথায় তা'হলে? প্রত্যাশা পূরণ হয়নি এবার । অমনোযোগিতার ছাপ প্রকট । তিতলী বাবা-মায়ের কাছে মিথ্যা বলেছে এটা মোটেই ভাল লাগেনি । তিতলিদের সত্য কথা বলবার সাহস থাকা বাঞ্চনীয় ।
মিথ্যা বলা অবশ্যই খারাপ। তবে প্রেম সবসময় যুক্তি মানে না বলেই জানি। যদি প্র্যাকটিক্যালি দেখি তাহলে এটা সত্যি যে তিতলীর পক্ষে বাবা-মা কে বলা সম্ভব না সে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে চট্রগ্রাম ঘুরতে গেছে।বাবা-মা সেটা মেনে নেবে না অথবা মানানো যাবে না। মধ্যবিত্তের এই মানসিকতা দেখেই তিতলীরা বড় হয়।অার প্রেমে একটু পাগলামী না থাকলে প্রেমের চার্ম কই আর!
জয়িতার কথায় একমত। লুকিয়ে আছে বলেই এর নাম প্রেম। যে সত্যি কথা আপনজনদের হৃদয় ভেঙ্গে দিবে সে সত্যি দূরেই থাকুক।
এরই নাম ভালোবাসা, এরই নাম প্রেম.......
ধরেন গল্পে তিতলী বাপ-মায়ের কাছে কইতো সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারে কাছে নাই, সে এখন সায়ান নামের একটা ছেলের সাথে ঘুরতেছি চট্টগ্রামে...তাইলে মীর কোন দিকে নিয়া যাইতে পারতো গল্পটারে।
এখন উপরের চারটা সম্ভাবনা আমি ভাবতে পারলাম। আপনিই বলেন কোনটাকে আপনার মিষ্টি বা ভালো লাগতেছে? আর কোনটা বাস্তবতা...
আমি চার নম্বরটা চাইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইই
মীর, প্রত্যাশার চাপ একটু বেশীইই আপনি আর তানবীরা'পুর উপর । প্লিইইইইইইইইজ তিতলি আর সায়ানের দম বন্ধ করা প্রেমের গল্প চাই । আজকেরটা কেমন সাদামাটা লেগেছে । বাস্তবে এইরম বাবা মা চলে আসে রোমান্সের মইধ্যে । কিন্তু গল্পে ক্যান আসবে । লাইক্কর্লামনা ।
ওরে সায়ান!! তোর জন্য একরাশ সহানুভূতি ।
মাইয়াদের বাবারা প্রথম প্রথম ২ নাম্বারটাই তো ভাবে।
(আমার পরিচিতা এক বালিকারে চ্যাংড়া বয়সে বিয়া করব বলসিলাম, বালিকা জবাবে বলসিল, তোমার কাছে ব্যা দিতে আমার বাপে পালসে না!)
চিটাংয়ে বাবার ফোন পাওয়ায় যে সাসপেন্স তৈরি হইছিলো, তার সাথে তাল মিলায়ে যেভাবে গল্প এগুচ্ছিলো, হুট করে জ্যাম এড়িয়ে উত্তরা থেকে শাহবাগ, বিমানবন্দরের সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে তাড়াহুড়ো করে এসে পড়ায় তেমনটা জমলো না।
পরের পর্বের অপেক্ষায়।
মন্তব্য করুন