একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৪)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-১)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-২)
একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-৩)
প্রনব মুখার্জি
প্রনব মুখার্জি ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি এবং তিনি হলেন একমাত্র বাঙালি যিনি বিশ্বের বৃহত্তম গনতান্ত্রিক রাস্ট্র ভারতের সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে পেরেছেন। তাঁর বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবন, দৃঢ় ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা তাকে দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহনযোগ্য করে তুলেছে। একাত্তরে সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে চরম সংকটকালীন সময়ে উদারভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়ের রাজ্যসভার সদস্য প্রনব মুখার্জি। একাত্তরে লাখ লাখ শরনার্থি ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়সহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে আসে। বাংলাদেশের সেই চরম অসহায় মুহুর্তে পরম বন্ধুর মত ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাথে প্রনব মুখার্জি সীমান্ত খুলে দেয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় শরনার্থী শিবির স্থাপন, পর্যাপ্ত খাদ্য, চিকিৎসা ও অন্যন্য সুবিধা নিশ্চিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। কোলকাতায় প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী কার্যালয় স্থাপন, ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার কেন্দ্র চালুসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শসহ সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করেন।
লর্ড ব্রকওয়ে
ঔপনিবেশিক মুক্তি আন্দোলনের প্রাবাদপুরুষ ব্রিটিশ লর্ডস সভার সদস্য লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে ৪ এপ্রিল ১৯৭১ ব্রিটেনের এক উন্মুক্ত জনসভায় বলেন- তাঁর শৈশব কেটেছে বাংলায় তাই নিজেকে তিনি সবসময় বাংলার বন্ধু হিসেবে মনে করেন। পূর্ব বাংলায় তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে অবর্ননীয় মানবিক বিপর্যয় ঘটছে অতি দ্রুত তা বন্ধ করতে অবদান রাখার জন্য তিনি দাবি জানান। এজন্য তিনি ছয় দফা দাবি পেশ করেন-
১। পূর্ব পাকিস্তানের দুর্গত মানুষদের জন্য এখনই প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী পাঠাতে হবে।
২। সব রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৩। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে জনসাধারণের উপর গুলি করা বন্ধের আদেশ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাদের প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪। যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকে স্বাধীনভাবে জনগণের ভবিষ্যত্ নির্ধারণের অধিকার নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
৫। পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি স্বরূপ বিবেচনা করে জাতিসংঘকে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সম্মেলনে সিঙ্গাপুর ঘোষণায় সম্মতি দাতা দেশের তালিকায় পাকিস্তানও ছিল। ব্রিটেন, ভারতে ও কানাডার মতো প্রথম সারির কমনওয়েলথ সদস্য দেশ কার্যকরী ভূমিকা রেখে কমনওয়েলথ সচিবালয়ের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী তুলে ধরার জন্য ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠাবে।
নিরাপত্তা পরিষদে পূর্ব পাকিস্থানের পরিস্থিতি নিয়ে উত্থাপিত ভারতীয় প্রস্তাবের প্রতি লর্ড ব্রকওয়ে জোরালো সমর্থন জানান।
ফ্রাংক চার্চ
একাত্তরের ২২শে জুন, নিউইয়র্ক টাইমস সংবাদদাতা ট্যাড শুলক একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশ করলেন-
‘পাকিস্তানি পতাকাবাহী একটি মালবাহী জাহাজ সামরিক সরঞ্জামবোঝাই অবস্থায় নিউইয়র্ক থেকে করাচির উদ্দেশে রওনা করতে যাচ্ছে। এ ধরনের সরঞ্জাম পাঠাতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।‘
মার্কিন সিনেটে মুখ খুললেন সিনেটর ফ্রাংক চার্চ, তিনি বললেন- বিষয়টি উদ্বেগজনক। প্রথম থেকেই বলা হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার আমেরিকান অস্ত্র ও গোলাবারুদ পূর্ব পাকিস্তানী নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যায় ব্যবহার করছে। সেদিনই সিনেটর ফ্রাংক চার্চ মার্কিন সিনেটে বিষয়টি তুলে ধরে জানালেন, তাঁর কাছে প্রামাণিক কাগজপত্র রয়েছে যে, দুটি মালবাহী জাহাজ সুন্দরবন ও পদ্মা ৮ এবং ১২ই জুন নিউইয়র্ক বন্দর ছেড়ে যাওয়ার কথা। বিশেষ করে পদ্মা সেদিন বিকেলেই বন্দর ছেড়েছে। তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে কে সেদিনের চালানটি বন্ধ করার কার্যকরী নির্দেশ প্রদান করতে অনুরোধ করেন। তিনি আরও বলেন- ২৩শে জুন জাহাজটি মন্ট্রিয়াল ডকে পৌঁছানোর কথা, কোস্টগার্ডরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের জলসীমার মধ্যে জাহাজটিকে আটক করতে না পারে, তাহলে কানাডা সরকারের সাহায্য নিয়ে হলেও এইসব নিষিদ্ধ সরঞ্জাম পাঠানোর উদ্যোগ বন্ধ করতে হবে।
ফ্রাংক চার্চ
যুক্তরাষ্ট্র সিনেট
ওয়াশিংটন ডিসি
রাসেল জনস্টোন
একাত্তরের ৩১শে মার্চ রাসেল জনস্টোন ব্রিটিশ কমন্স সভার সদস্য যে বিবৃতি দিয়েছেনঃ
আমরা অত্যন্ত শঙ্কার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকটের বিস্তার পর্যবেক্ষণ করছি। স্পষ্ট ও বিস্তারিত প্রতিবেদন না পেলেও সংবাদগুলো অনেক সময় পরস্পরবিরোধী দুটি বিষয় কিন্তু অনস্বীকার্য। প্রথমত, এটা খুব স্পষ্ট যে সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবী পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বাধীনতা। দ্বিতীয়ত, এই স্বাধীনতার দাবীকে দমাতে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে সেনাবাহনীকে অত্যাচার আর নির্যাতনে নিয়োজিত করে। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ননামতে সেনাবাহিনীর নৃশংস ও নির্বিচার বর্বতার শিকার হয়ে বিপুলসংখ্যক বেসামরিক মানুষ নিহত হয়। এ ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বন্যা (জলোচ্ছ্বাস) বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সহানুভূতি জাগিয়েছে; বর্তমান পরিস্থিতিতে ত্রাণ সহায়তা ব্যহত হলে দুর্গতদের যন্ত্রণা আরও অসহনীয় হয়ে উঠবে। বর্তমান ঘটনাবলী পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার- এ যুক্তিতে ব্রিটেন অনড় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করছিযে, খারাপের দিক থেকে অসহনীয় বর্বরতা কতটা নির্মম হতে পারে আর ভালোর দিক থেকে রাজনৈতিক বিষয় মনে করে বড় ভ্রান্তি কি করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে। কমনওয়েলথের জ্যেষ্ঠ সদস্য হিসেবে একটা কার্যকরী সমাধান বের করতে এবং ওখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্রিটেনের সামনে খোলা সব পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব ব্রিটেনের ওপরই ন্যস্ত।
ফাদার মারিনো রিগন
উত্তাল একাত্তর। বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বানিয়ারচর গ্রামের একটি ক্যাথলিক মিশনের একজন ধর্মযাজক ‘ফাদার মারিনো রিগন’। ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশেই বসবাস। জন্ম- ১৯২৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী, ইতালি। কর্মসূত্রে বাংলাদেশে এসে এদেশের চরম দুঃসময়ে এদেশের মানুষের সাথে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ফেলেন নিজের ভাগ্যকে। মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে এদেশ থেকে চলে যাওয়ার পরিবর্তে তিনি এদেরই একজন হয়ে এদের পাশে দাঁড়ান পরম বন্ধুর মত। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা-লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের কারণে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিজ চোখে দেখে যুদ্ধপীড়িত ও যুদ্ধাহত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন, চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য ঢেলে সাজালেন নিজের ক্ষুদ্র চিকিৎসাকেন্দ্রটি। সেই সাথে তাদের আশ্রয় ও খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থাও করলেন। তার কাছে চিকিৎসাসেবা প্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় বৃহত্তম গেরিলা বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন ফাদার মারিনো সম্পর্কে বলেন- '১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে এক সম্মুখযুদ্ধে আমার মুখমণ্ডলে গুলিবিদ্ধ হয়। শত্রুর বুলেট আমার মুখের বামপাশ দিয়ে ঢুকে চোয়ালের দাঁতসহ ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। জিহ্বার একটি টুকরাও সেই সঙ্গে উড়ে যায়। দলের চিকিৎসকদের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা পাওয়ার পর আমি আরও ভাল চিকিৎসার জন্য চলে যাই ফাদার রিগনের চিকিৎসাকেন্দ্রে। ফাদার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমার শরীরে অস্ত্রোপচার করান। সে সময় আমার চিকিৎসা করতে গিয়ে ফাদার নিজের জীবনের যে ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তার ঋণ কোনোদিন শোধ হওয়ার নয়। তখন ওপরে ছিল ঈশ্বর, নিচে ফাদার রিগন। হয়তো তার কাছ থেকে চিকিৎসা সেবাটা না পেলে বাঁচতেই পারতাম না। শুধু আমার নয়, তিনি অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছিলেন। তাই ফাদার রিগনও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন সহযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পরম বন্ধু।'
বিপদে প্রকৃত বন্ধু চেনা যায়। মিশন থেকে ছুটির প্রস্তাব আসলে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি বলেন-বাঙালির দুঃসময়ে তিনি তাদের পাশে থাকবেন না, তা তো হয় না। তিনি যেন আর সবার মতোই জড়িয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইতালীয় ও ইংরেজি ভাষায় লেখা তার দিনলিপিতে উঠে আসে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের খণ্ড খণ্ড চিত্র। অন্যসব ধর্মযাজকের মত তিনি শুধুমাত্র ধর্মীয় কর্মকাণ্ডেই নিয়োজিত থাকেননি, সেইসাথে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন শিল্প, সংস্কৃতি আর শিক্ষামূলক বহুমাত্রিক কাজে। তার হাতেই ইতালিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিসহ প্রায় ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, লালন সাঁইয়ের ৩৫০টি গান, জসীম উদ্দীনের নকশি কাঁথার মাঠ, সুজন বাদিয়ার ঘাট, নির্বাচিত কবিতা ছাড়াও এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের অসংখ্য কবিতা। তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এদেশের মুক্তিযুদ্ধে, সৃজনশীল ও শিক্ষামূলক কাজে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাঁকে প্রদান করেছেন বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য সম্প্রতি তিনি অর্জন করেছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা'।
চলবে ....
দারুন একটা কাজ করতেছেন ভাইয়া!
এখানে আমার কোন কৃতিত্ব নেই শান্ত, আমি শুধু তথ্যগুলো এক জায়গায় করে উপস্থাপন করছি..
সিরিজটি এবির জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ হয়ে থাকবে।
লেখার তথ্যসূত্রগুলো যদি উল্লেখ করে দিতেন তাহলে বিস্তারিত পড়াশোনার দরকার পড়লে কাজে দিতো।
ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।
সিরিজের শেষ পর্বে থাকবে
এমন মহৎ ব্যাক্তিদের কথা পড়লে মাথা নুয়ে আসে শ্রদ্ধায় ।
এমন মহান মানুষের অবদানের কথা ছড়িয়ে দিতে হবে তরুণদের মাঝে
চলুক বন্ধু।
চলছে, চলবে..
রেফারেন্স হিসাবে থাকলো, ভাল উদ্যোগ
ধন্যবাদ মাসুম ভাই।
মন্তব্য করুন