পায়ের ধুলো নেই-১০
হৃমায়ূন আহমেদ: যে ছিল এক মুগ্ধকর। এটি স্থপতি শাকুর মজিদের বই। হুমায়ূন আহমেদকে যেভাবে দেখছেন তার বর্ণনা। আমার ভালো লেগেছে। বইটি পড়া শেষ হতে না হতে হাতে নেই হুমাযূন আহমেদ স্মারকগ্রন্থ।পড়ি আর আমার একটা ধারণা গলে গলে মন থেকে বেরিয়ে যায়। আমার মনের গভীরে একটা হাহাকার তৈরি হয়। একটা ভাবনাকে আঁকড়ে থেকে আমি দুর্দান্ত কিছু স্মৃতি তৈরি থেকে বঞ্চিত থেকেছি। বঞ্চনার কথা বলার আগে ধারণার কথা বলি। আমি মনে করতাম লেখকের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক ব্যক্তিগত নয়। ব্যক্তি মানুষটার কাছাকাছি যাওয়ার কোন মানে নেই। লেখক অনেক দিন বেঁচে থাকুন এই কামনা করি তাঁর অনেক লেখা পড়ার আ্গ্রহ থেকে। কিন্তু বই দুটি পড়ে মনে হলো হুমায়ূন আহমেদের কাছাকাছি হলে জ্ঞানের রাজ্যে আরো সাবলীল হতে পারতাম।
হুমায়ূন আহমেদের লেখার সঙ্গে পরিচয় সূর্য়ের দিন বইটি দিয়ে।মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক। সেটা পেয়েছিলাম উপস্থিত বক্তৃতায় প্রথম হবার পুরষ্কার হিসেবে।তখন আমি পঞ্চম শ্রেণি। পড়ি রায়পুরা প্রাইমারি ট্রেনিং ইন্সটিটিউট সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে। ট্রেনিং নিতে আসা অল্প বয়সী শিক্ষকরা ক্লাস শেষ করার আগে আমাকে দাঁড় করিয়ে নানা বিষয় বলার ফরমায়েশ করেন । আমি যা মনে আসে বলি।তাতে শিক্ষক মহলে আমার জনপ্রিয়তা বাড়ে।শুধু গুল্লাছুট খেলায় ব্যথা পাওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেল। বন্ধুদের হাতে শক্তি বাড়লো কিংবা কে জানে, আমার হয়তো সহ্য ক্ষমতা কমেছিল!
ক্লাস সিক্সে আবারো হুমায়ূন আহমেদ।ভাইদের হাত ধরে। বড় ভাই একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, অপর জন কলেজে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের হাতে নানা বই ঘুরে। সেগুলোই পড়তে শুরু করি। বাছ বিচার নেই। বিপত্তি ঘটলো অমানুষ পড়তে গিয়ে। তার লেখক হুমায়ূন আহমেদ। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সাগর ভাই বললেন, পড়ুক। অসুবিধা কী? কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া শাওন ভাই বললেন, যে বই আমি স্কুল পাস করে পড়ছি, সে বই এখনি কেন ওর পড়া লাগবে? আর তাছাড়া বোঝারওতো একটা বিষয় আছে, তাই না? সিক্সের ছাত্র নাও বুঝতে পারে। পরে জেনেছি হুমায়ূনের বই পড়া নিয়ে এমন মধুর পারিবারিক স্মৃতি অনেকেরই আছে।কারো কারো বাড়িতে এক বই কয়েক কপি কিনতে হয়। কার আগে কে পড়বে সে প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে।
এইচ এস সি পরীক্ষার পর বেশ একটা লম্বা ছুটি হলো। সুযোগ এলো হুমায়ূন আহমেদের অনেক বই পড়ার। সংখ্যায় তা সেঞ্চুরি হবেই। বই পাওয়ার গেলো ঝংকার সংষ্কৃতিক সংগঠন এর প্রধান অলিদার ঘরে। তিনি হঠাৎ করেই হুমায়ূন আহমেদকে আবিষ্কার করেন এবং সে পর্যন্ত প্রকাশিত সব বই সংগ্রহ করেন। আমি অলিদার ভক্ত।তাঁর যাবতীয় কর্মকাণ্ড আমাকে যার পর নাই মুগ্ধ করে।সেই মুগ্ধতার শুরু প্রথম দেখা থেকেই। তখন আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি। রেডিওর জন্যে নাটক করবেন শহীদ উদ্দিন চৌধুরি অলিদা।তাতে দুজন শিশু শিল্পী লাগবে। কে যেন আমাদের দুজনকে খুঁজে বের করে, তা আমার আজ মনে নেই। আমি গেলাম আর ইকবাল গেল। প্রতিদিন বিকালে যাই। নারিকেল গাছের নিচে বসি, মুড়ি- চানাচুর-সিংগারা খাই, সংলাপ মুখস্ত করি। উচ্চারণ ভুল হয়। অলিদা ঠিক করে দেন। আমি মুখস্ত করি। তা ক্যাসেটে রেকর্ড করা হয়। কিন্তু মনমত হয় না অলিদার। এভাবে একসময় একটা নাটক শেষ হয়। তা প্রচার হয় কি না তা আমার জানা হয় না। ইকবাল ঝরে যায়। আমি নিয়মিত যেতে থাকি। আবৃত্তি শিখি। সারেগামা না শিখেই হারমোনিয়ামে তুলে নিই কয়েক লাইন গান। মায়াবন বিহারিনী হরিণী…
এরইমধ্যে বিটিভিতে অলিদার আনাগোনা শুরু হয়। আমি হয়ে উঠি ঝংকার সাঙ্কৃতিক সংগঠনের সবচেয়ে ছোট সদস্য।বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে নানা অনুষ্ঠান হয়। সে সব অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করি। নানা প্রতিযোগিতায় যোগ দেই। সার্টিফিকেট জমা হয়। বিতর্ক করি পুরষ্কার জমা হয়। পারিবারিক বইয়ের সংগ্রহে আমার একচ্ছত্র অধিকার জন্মে।
স্নেহ পাই অলিদার। এবার জেলা ভিত্তিক একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে অংশ নেবে ঝংকার।তা প্রচার হবে বিটিভিতে থাকবে একটা নাটিকা। লেখক আলাউদ্দিন আল আজাদ। রিহার্সেল চলছে পুরোদমে। অলিদা গান লিখে সুর দিলেন।
মেঘনার শাখা আকাবাঁকা পথে এনেছে সজাগ সাঁড়া
সূর্য বলয়ে চেতনার ছোঁয়া , সে আমার রায়পুরা ।
আমাদের সে কী উত্তেজনা! প্রতিদিন রিহার্সেল। তারপর একদিন জেলা সদর নরসিংদীতে ফাইনাল রিহার্সেল। উপস্থিত হলেন বিটিভির উর্ধ্বতন। সব ঠিক হলো। শুধু বাদ পড়লাম আমি। কারণ নাটিকার মূল চরিত্র যদি হাসি হাসি মুখ করে থাকে তবে বিপদ। বাদ পড়ল নাটিকা।
অভিনয় ছাড়লাম। অলিদাকে ছাড়া হলো না। একটা করে বই আনি-পড়ি-ফেরত দেই।আমার চরিত্র বদলে যেতে থাকে। এক মাঝদুপুরে হাজির হলাম আমার বন্ধু মফিজের বাড়িতে। তারা অবাক। অবাক হবে জানা কথা। হুমায়ুনের বইতেও এমনি চরিত্র দেখে অনেকেই অবাক হয়।আমারও মানুষকে অবাক করতে ভালো লাগলো। কিন্তু এর পরের ঘটনা আমার জন্যে অবাক করার।এই দুপুরে আমাকে না খাইয়ে ছাড়বে না মফিজের মা। তার ভাই বোনেরা। এই দুপুরে কারো বাড়িতে কেউ এলে তাকে না খাইয়ে ছাড়া নিয়ম মানে ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না।এই সময়ে কেউ হাজির হলে বুঝতে হবে তার উদ্দেশ্য না খেয়ে যাবে না। আমার লজ্জা লাগলো। কিন্তু এমনি হুট হাট কারো বাসায় চলে যাওয়াসহ নানা কাণ্ড করে বেড়াতে লাগলাম।
আমার বন্ধুদের ছোট ভাই-বোনদের কাছেও হুমায়ূন আর অপরিচিত নেই। টিভির নাটক আর ছাপা বই দুইয়ে মিলে তিনি পরিচিত, যেন প্রতিবেশী।তাদের কেউ কেউ বলতে লাগলো, ভাইয়্যা তো দেখি পুরা “নি”। ভাইয়্যাতো অমুক তমুক। শুনি ভালোলাগে। এই তুমুল ভালোলাগায় কেটে যায় দিন। সে বছর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলাম না। হতাশ না হয়ে আবারো গল্পের বই পড়া শুরু করলাম।
পরের বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম আইনে। অলিদার সঙ্গে যোগাযোগ কমতে লাগলো।বন্ধে বাড়ি গেলে দেখতাম তিনি ওষুধ বানানোর কাজে মনযোগ দিয়েছেন।ওনার ইচ্ছে ছিল বড় কারখানা করার, তা হয়নি। দিন যেতে লাগলো। আমি চ্যানেল আইতে যোগ দিলাম। খবর পেলাম অলিদার একটা হাত অবশ হয়ে গেছে। একদিন দেখা করতে গেলাম। খুব চেষ্টা করছিলেন অবশ হাতটা নাড়ানোর। যেন আমাকে বুঝাতে চান, ওই হাতটা ঠিক আছে। জানালেন দুইটা উপন্যাস লিখেছেন। হুমায়ূন আহমেদ প্রভাবিত। কথাও বলছেন হুমায়ূন আহমেদের মতো। বললেন, ওগুলো নাটক হলে খুব খুশি হবেন। আমি টিভিতে কাজ করি । চেষ্টা করে দেখবো কিনা? থাক অলিদার গল্প আর নয়। ওনি আর আমাদেরে মাঝে নেই। ওনার গল্পও তাই আপাতত বন্ধ থাক। বরং তাঁর প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের কথা বলি।
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার দেখা হয় ২০০৪ সালে। বই মেলায়। চ্যানেল আই থেকে মেলার খবর সংগ্রহ করার দায়িত্ব আমার। লাইভ করি, সাক্ষাৎকার নেই। হুমায়ূন আহমেদ অন্যপ্রকাশে বসে থাকেন। তাঁকে ঘিরে থাকে অটোগ্রাফ শিকারীরা। মেলার প্রবেশ পথে র্যা বের সতর্ক প্রহরা। আর্চওয়ে পার হয়ে মেলায় ঢুকতে হয়।কেমন লাগছে? হুমায়ূন আহমেদ বললেন , বন্দি বন্দি মনে হচ্ছে।
ছড়াকার ওবায়দুল গনি চন্দন বাংলাভিশনের রিপোটিং টিমে যোগ দিলে, তাঁর কাছে হুমায়ূন আহমেদের গল্প শুনি। তৎকালীন বার্তা সম্পাদক বায়জীদ মিল্কী একদিন তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে এলেন নুহাশ পল্লী। বাংলাভিশনে প্রচার হলো প্রতিবেদন। আমরা দেখলাম হুমায়ূন আহমেদের গাছের ঈর্ষণীয় সংগ্রহ। বাংলাভিশনের কাজের জন্য নানা সময়ে ফোন করা হলে তা ধরতেন হুমায়ূন আহমেদ।
যাহোক, বিয়ের পর বইমেলায় বউ নিয়ে গেলে ভিড় ঠেলে অন্যপ্রকাশের স্টলে যেতেই হয়। নিজের বই অন্যের হাতে তুলে দিয়ে ঘরে ফিরি হুমায়ুনের বই হাতে নিয়ে।বইয়ের কপি রাইট দেই বউয়ের নামে। তা দেখে এক চৌকস সংবাদ উপস্থাপক বলেন, ভাই, কপি রাইট দেখে ভয় পাচ্ছি। একসময় হুমায়ূনের সব বইয়ের কপি রাইট ছিল গুলতেকীনের নামে। আপনারও কপি রাইট পরিবর্তন হবে না তো? সংবাদ উপস্থাপক বললেন, মায়েরা এক সময় নিজের মেয়েদের পড়ে শুনিয়েছে হুমায়ূনের বই। হুমায়ূন ছিলেন মধ্যবিত্তের ঘরের মানুষ। তাই হুমায়ূনের দ্বিতীয় বিয়ে মধ্যবিত্ত মেয়েদের মনে ভয় ঢুকিয়েছে অনেক। লুবনাও মাঝে মাঝে বলে, ক্রমাগত লেখেন। হুমায়ুন আহমেদের মতো জনপ্রিয় হন। তারপর সে থামে। কীযেন ভাবে, বলে, এতো জনপ্রিয়তার দরকার নাই। কষ্ট করে সংসার করছি, তারপর কার না কার সঙ্গে ঘর বাঁধেন। এখন চলেন ঘুরতে যাই।
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনে কোন সম্পর্ক গড়তে যাইনি, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন থেকে হুমায়ুন আহমেদকে দূরেও রাখা গেল না। লেখক যে মানুষের মনে বাস করে। তার ব্যক্তিজীবনের একটা ঘটনা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে কেন বারবার উচ্চারিত হয়?
১৪.০৪.১৩
দারুন বর্ননা ভংগি আপনার দারুন পোষ্ট!~
:)অনেক অনেক ধন্যবাদ। অনেক ভালো থাকুন।
আপনে নিয়মিত লেখেন না ক্যান?
দূর্দান্ত হইছে বস...
:এখন থেকে নিয়মিত লেখবো, আশা করি। স্বাগত জানানোয় অনেক ধন্যবাদ, ভাই।
ব্যক্তিগত জীবন ব্যক্তিগতই থাকুক । লেখক তার লেখা নিয়ে বেচে থাকুক পাঠকের হৃদয়ে ।
প্রিয় লেখককে নিয়ে অসাধারণ পোষ্ট । প্রিয়তে রাখলাম ।
দারুণ লেখা
অনেক ধন্যবাদ,
মাসুম ভাই।
চমৎকার লিখেন আপনি,
কিন্তু এত কম লিখেন কেন?!
মন্তব্য করুন