ইউজার লগইন

বিষয়টা শোভনীয় না....তবুও....

সকাল ৭টা ৪৫…
আট টায় ক্লাশ।বাসা থেকে ভার্সিটি যেতে কম করে হলেও আধা ঘণ্টা লাগে।দেরি করলে হয়তো অনুপস্থিত থেকে যাব,তবু আমার মধ্যে কোন তাড়াহুড়ো নেই।ধীর গতিতে বাসা থেকে বের হলাম।ফুসফুসটা এখনও অক্সিজেনে ভরা,কিছুটা নিকোটিন খুবই জরুরী।সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়াতেই বৃষ্টি শুরু হল,যাকে বলে বিড়াল-কুকুর বৃষ্টি।কোন ধরণের পূর্বাভাস ছাড়া এমন বৃষ্টি কোনদিন দেখেছি বলে মনে হয়না।কি আর করা,রওনা দিলাম বাসার দিকে ছাতা নামের ঝামেলাটাকে সঙ্গী করতে।পেছন ফিরে দেখি দোকানী একটা বেনসন এন্ড হেজেজ হাতে শুকনো মুখে তাকিয়ে আছে,দিনটা তার শুভ হল না!!

কয়েক মিনিট পর আবার সেই দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম।উদ্দেশ্য ওই আগেরটাই,তবে এবার ফুসফুসের চাহিদাটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে।সিগারেটে একটা টান দিয়ে পা বাড়াতেই মনে হল কেউ ডাকছে।হাতে সময় কম,ডাকাডাকিতে কান না দিয়ে এগুতে থাকলাম।আবার সেই ডাক....

"এই যে ছাতা ওয়ালা দাদু!!"
গলার স্বরটা চেনা চেনা মনে হল।"দাদুভাই,এটা কিন্তু শোভনীয় না" কথাটা মনেহয় এই কণ্ঠেই শোনা,কিছু মনে করতে পারলাম না।পেছনে ফিরতে যাব সেই সময় আবার একই ডাক।
"দাদু,আমাকে একটু এগিয়ে দেয়া যায়?" ষাট-সত্তর বছর বয়সের একজন লোক কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সাত সকালে এই লোক রাস্তায় কি করে!!মেজাজটা খারাপ হল,তবু হাসি মুখেই বললাম,
"কোথায় যাবেন?"
"এইতো চার নম্বর রোড।তুমি কোথায় যাবে?"
"আমি তিন নম্বর দিয়ে বের হব।"

ততক্ষণে লোকটা আমার ছাতার নিচে চলে এসেছে,কাঁপা কাঁপা হাতে আমার বাম হাতটা ধরল।সময় কম,মেজাজ টা চটে আছে।তারপরও কাঁপা হাতের স্পর্শে কেমন একটা সহানুভূতি বোধ হল।বৃদ্ধ লোকটাকে ধরে এগুতে থাকলাম।ডান হাতের সিগারেটটা তখনও জ্বলছে।দু'জন চুপচাপ এগুচ্ছিলাম,

বৃদ্ধ লোকটা হঠাৎ বলে উঠল,"তুমি চালিয়ে যেতে পার।"বুঝলাম উনি সিগারেটের দিকে ইঙ্গিত করছেন।বিষয়টা শোভনীয় না।কোন উত্তর দিলামনা।

এক নম্বর রোড থেকে চার নম্বর রোড পর্যন্ত যেতে একমুখী অনেক কথা হল,কথাগুলো আমার কান দিয়ে ঢুকলেও মাথায় কিছুই ঢুকলনা।শুধু নিজের অজান্তেই একটা মিথ্যা কথা বলে ফেললাম।কেন বললাম জানিনা।বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি নামাজ পড়ি কিনা,আমি হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়েছি।এটা আসলে ঠিকনা।গত কয়েক বছর ধরে আমি নামাজ পড়িনা।বেশ কয়েক সপ্তাহ হল জুম্মার নামাজেও যাইনা।চিন্তা-ভাবনা নাস্তিক টাইপের হয়ে যাচ্ছে,তারপরও বললাম নামাজ পড়ি।

বৃদ্ধ লোকটাকে তার বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে হলনা,তার আগেই বৃষ্টি থেমে গেল।এই বৃষ্টির প্রয়োজনটা কি ছিল?শুধু শুধু আমার সময় নষ্ট!!ফেরত আসার সময় বুঝলাম উনি আমার আচরণের প্রশংসা করলেন। অনেকদিন কারো প্রশংসা শোনা হয়না।

তিন নম্বর রোড পাড় হতেই আবার বৃষ্টি শুরু হল।সাধারণত বৃষ্টির শব্দ ভাল লাগলেও আজ এই শব্দটা খুব বিরক্তিকর লাগছে।হেডফোনটা বের করে কানে গুঁজে দিলাম।র‍্যানডম সিলেকশনে গান শুরু হল,

“যদি দেখি নীল আকাশ,তোমার চোখে দেখি
সাদা মেঘদল,থাকে নীলিমা জুড়ে”

এই সময় নীল আকাশটা থাকা আমার জন্য অনেক জরুরী ছিল।ঘড়িতে ৮ টা ১৫....

ক্লাশে ঢুকলাম ৪৫ মিনিট পর।মনে হলনা স্যার কিছু মনে করেছেন,উনি নিজের মত উসাইন বোল্টের গতিতে এগুতে থাকলেন।ক্লাশের শেষভাগে গিয়ে সামনের বেঞ্চে বসে স্যারকে প্রশ্ন করাটা কোন দিক থেকেই শোভনীয় না,আমি এই অশোভনীয় কাজটা করে ফেললাম।এর ফলে উসাইন বোল্ট তাঁর গতিটা কমিয়ে ফেললেন।ঠিক তখনই বৃদ্ধ লোকটার সাথে প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে পড়ল।

প্রতিদিনের মত সেদিনও সকালের ক্লাশের জন্য দেরি করে বের হয়েছি।কোন কারণে সেদিন পকেটে দুইটা সিগারেট ছিল।বাড়ির পাশের দোকানীর অপেক্ষা উপেক্ষা করে তাই সামনের দিকে রওনা দিয়েছি।সিগারেটটা ধরিয়ে একটা টান দিতেই পাশ থেকে ভেসে আসল, “দাদুভাই,এটা কিন্তু শোভনীয় না।”সেদিন তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলাম,তাই আর ঘুরেও তাকাইনি।কিন্তু কণ্ঠস্বরটা থেকে গেছে অবচেতন মনে।

ক্লাশ শেষ হওয়ার ১০ মিনিট পর আবার আরেকটা ক্লাশ।ফুসফুস তো ভেতরে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ফেলেছে। মনকে থামানো যায়,তবু ফুসফুস কে না;জীবন তো তারই উপর নির্ভরশীল!!নীচে নেমে টঙ্গের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম।কিছু না বলতেই টঙ্গের ‘মামা’ হাতে একটা বেনসন ধরিয়ে দিয়ে বলল, “মামা,এইবার ৯টা ট্যাকা দেন।”প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি কথার পুনরাবৃত্তি করলেন।এবার সাথে যোগ করলেন, “কাইল রাইতে দাম বাড়ছে,করার কিছুই নাই।”

আশ্চর্য...সিগারেটের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে মানুষজন করবে কি?চুরি করে যখন সিগারেট খেতাম তখন একটা বেনসনের দাম ছিল সারে চার টাকা।কয়েক দফা দাম বেড়ে এখন তার দাম দিগুণ!!এর দুই দফা দাম তো এই সরকারের সময়ই বাড়ল।এদেরকে ভোট দেয় কে !!

মেজাজটা সারাদিন গরম হয়ে থাকল।প্রতিদিনের মত আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় ফুসফুস আবার সংকেত দিয়ে বসল।বলা বাহুল্য গত কয়েক ঘণ্টা নিকোটিন থেকে অনেক দূরে থাকতে হয়েছে।এই ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণ সিগারেট না খাওয়ার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে।শুনেছিলাম মেয়ারা নাকি তাদের ধূমপায়ী বয়ফ্রেন্ড পছন্দ করে।তার মানে কি ফ্রেন্ডদেরকে মানা করবে?নাকি কেউ আমাকে ভুল করেও বয়ফ্রেন্ড হিসেবে কল্পনা করেনা!!আর ছেলেগুলোর কথা কি বলব,সব অকর্মা।

সিগারেটের দোকানের সামনে যেতেই ডজন খানেক বাচ্চা-কাচ্চা হাজির,সবার মুখে একটাই কথা,“ভাইজান,দুইটা ট্যাকা দেন।সারাদিন কিছু খাইনাই।”
বরাবরের মত এদেরকে পাত্তা না দিয়েই বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।

সূর্যটা পশ্চিম আকাশে এখনও উঁকি দিচ্ছে।রৌদ্রস্নাত দুপুরের স্পর্শটা এখন আর মনে পড়ছে না,একটু পর পর কোত্থেকে যেন একটা ঠাণ্ডা বাতাস শরীরে এসে লাগছে।কি অপরূপ বিশুদ্ধ অনুভূতি!!

সেই বিশুদ্ধতার কলঙ্ক হয়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছি,দুই আঙ্গুলের মাঝের আলোটা অনবরত ওঠানামা করছে আর চারপাশের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অংশে ছড়িয়ে দিচ্ছে অভিশপ্ত আলোর অবয়ব।

পোস্টটি ৩ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

চিন্তক's picture


লেখার হাত তো বেশ আপনার, নামটাও গালভরা। লেখা পড়ে আরাম আছে। Smile

তানবীরা's picture


লেখার হাত তো বেশ আপনার, লেখা পড়ে ভাল লেগেছে।

মারুফ প্রতীক's picture


Smile

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মারুফ প্রতীক's picture

নিজের সম্পর্কে

নিজের সম্পর্কে আমি নিজেও খুব একটা জানি কিনা সন্দেহ আছে