বর্ষণের মেধা-মনন ও মুরগি কাহিনী
মেধা ও মনন
ছেলে আমার সেন্ট গ্রেগরী উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে। পড়াশোনায় ভালো, কি খারাপ তা বলার উপায় নেই। তবে কোনো বিরতি ছাড়াই প্রতিটি চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ওপরের ক্লাসে প্রমোটেড হয়েছে। তার সম্পর্কে বলার বিষয় হচ্ছে, ও যখন গেন্ডারিয়ার স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে কেজিতে পড়ে, তখন সেন্ট গ্রেগরী স্কুলে এডমিশনের জন্য ওই স্কুলের এক শিক্ষকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। শিক্ষক মহোদয় জানি না কি কারণে তাকে দেখে পরের বছর চেষ্টা করতে বললেন। অগত্যা কি করা, ছেলের মেধা যাচাইয়ে কোনো কোচিং বা স্পেশাল টিচিংয়ের ব্যবস্থা না করে ভর্তিযুদ্ধের জন্য ওর মা নিজেই শিক্ষকের দায়িত্ব নিলো। স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী ছেলের সাথে মা-বাবা দুজনকে ইন্টারভিউর জন্য নির্ধারিত তারিখে প্রধান শিক্ষকের (ব্রাদার রবি পিউরিফিকেশন) কাছে হাজির হতে হলো। ইন্টারভিউর পর ঘোষিত তারিখে ফরম সংগ্রহ করা হলো।
২৪০টি আসনের বিপরীতে ওই বছর ২ হাজার ৬০০ শিশু ভর্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। বিশাল সংখ্যার শিশুরা নির্ধারিত দিন ও সময়ে পেন্সিল, রাবার, শার্পনার আর ক্লিপবোর্ড সাথে নিয়ে পরীক্ষার জন্য হাজির হলো। পরীক্ষা শেষ, এবার ফলাফল প্রকাশের অপেক্ষা। এ নিয়ে আমাদের তেমন টেনশন ছিল না। কারণ শিক্ষকের পরামর্শের জন্য একে আমরা ছেলের জন্য বোনাস সময় ধরে রেখেছি। এ যাত্রায় না হলে পরের বছর কোচিংয়ে দেয়া হবে। যথারীতি রেজাল্টের অপেক্ষা। রেজাল্ট প্রকাশের পর উত্তীর্ণদের তালিকায় রোল নম্বর খুঁজতে গিয়ে প্রথম ৫০ জনের মধ্যেই তার নম্বরটি দেখে চোখ স্থির হয়ে গেলো। প্রথম অবস্থায় বিশ্বাস হচ্ছিল না, ফরমের সাথে নম্বরটির মিল আছে তো...। কোনো ভুল হচ্ছে নাতো...। মনে নানা খটকা। অবশেষে এ চোখ দুটিকে বিশ্বাস করতেই হলো। ‘এবার নয়, আগামীতে’Ñ শিক্ষকের এ ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে ওই বছরই (নো কোচিং, নো প্রাইভেট, নো এক্সট্রা অর্ডিনারি) গ্রেগরিয়ান হিসেবে নাম লিখালো বর্ষণ (মাহফুজ আহমেদ)।
মুরগি কাহিনী
ঘটনাটি মাস তিনেক আগের। মাঝে-মধ্যেই সন্তানদের এ ধরনের আচরণের শিকার হতে হয় মা-বাবাকে; কিন্তু সেদিনের ব্যতিক্রম ঘটনাটি ওর জীবনে ভালো কাজের একটি উদাহরণ হয়ে থাকলো। বাসা থেকে টিফিন নিতে আপত্তি করায় অগত্যা তার হাতে ১০ টাকার দুটি নোট গুঁজে দেয়া হলো। ছেলে আমার টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে স্কুল ছুটির পর ১৫ টাকায় একটি দেশী মুরগির বাচ্চা নিয়ে বাসায় ফিরলো। এ বাচ্চা নিয়ে কি যে টেনশন তার। কোথায় রাখবে, কি খাওয়াবে ইত্যাদি। শেষে ঘরে খুঁজে পেলো কাগজের তৈরি একটি বাক্স। ছোট ভাই বর্ণের সাথে সে বাচ্চাটি লালন-পালনের বিষয়টি শেয়ার করলো। যখন যে বাসায় থাকবে, সে এর যতœ-আত্তি করবে। তাই এর যতেœ ছোট ভাই বর্ণও কম যায় না। সে এটির নাম দিয়েছে চিকু, এ নামে ডাকলেই বাচ্চাটি শব্দ করে তার কাছে আসে, খাবার খায়। বর্ণ রাতে ঘুমানোর আগে বাথরুমে যাওয়ার ছুঁতোয় বাচ্চাটিকে দেখে নেয়, ঠিকভাবে রাখা আছে কি না, বক্সটির ওপর কাঠ চাপা দেয়া হয়েছে কি না। কারণ কাঠ চাপা না দিলে লাওয়ারিশ বিড়ালটি তাকে আক্রমণ করতে পারে। বিড়ালটি একবার এ রকম করেছিল বটে; সেদিন বাচ্চাটি বাক্স থেকে লাফিয়ে পড়ে রান্নাঘরের এক কোনায় নিজেকে রক্ষা করেছিল। এরপর থেকে বর্ণ ও বর্ষণ বাচ্চাটির বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা করেছিল। বাচ্চাটি দুই ভাইয়ের আদর-যতœ ও সান্নিধ্যে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠলো। একে যখন খাওয়ার সময় বাক্স থেকে বাইরে আনা হয়, তখন সে মানবসন্তানের মতো লালনকর্তাদের হাত বেয়ে কখনো ঘাড়ে, কখনো মাথায় গিয়ে ওঠে। ফলে এর প্রতি দুই ভাইয়ের ভালোবাসা যেন আরো বেড়ে যায়। দিনে দিনে কেটে যায় দেড়-দুই মাস। বাক্সটি তার থাকার অনুপযোগী হয়ে যায়। এখন দরকার বড় একটি বাক্স। বর্ষণের ঘনঘন তাগাদায় শেষে ২০ টাকার বিনিময়ে ফলের একটি কাঠের বাক্স এনে তাকে খোয়াড় বানিয়ে দেয়া হলো। একমাত্র খাওয়ার সময় ছাড়া এর ভেতরেই বাচ্চাটির দিনরাত কাটে। এভাবেই ৫তলা বাসায় কোণঠাসা হয়ে বাচ্চাটি একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। হঠাৎ সেদিন (১৫ ফেব্র“য়ারি ২০১২) সকাল বেলা এর মলে রক্ত আবিষ্কার করলো বর্ষণ। ওর মা বললো হয়তো কোথাও কোনো আঘাত পেয়েছে, এর ফল এটি। আমি ওকে মুরগিটি জবাই করার পরামর্শ দিলাম। বুঝাতে চেষ্টা করলাম, আলাহ আমাদের জন্য এসব পশুপাখির জবাই করা মাংস হালাল করেছেন। প্রথমে রাজি না হলেও পরে এ প্রস্তাবে রাজি হয়। শেষে বাপ-বেটা দুজন মিলে একে হালাল উপায়ে জবাই করলাম। বর্ষণের মনে ভীষণ কষ্ট। তাই ওর মাকে বললো, এর রান্না করা মাংস যাতে ওকে না দেয়া হয়। মুরগি নয়, আসলে এটি ছিল বড় জাতের একটি মোরগ। জবাইয়ের পর এটি নিশ্চিত হওয়া গেলো। জবাই করা ডেকি মোরগটির ছাল খসানোর পর বোঝা গেলো, মোরগটির আসলে কিছুই হয়নি। ধারণা করা হলো, ওর নির্ধারিত ফিডের বদলে অন্য খাবার খাওয়ানোয় সমস্যাটি হয়েছিল। সাড়ে ৩ মাসের যতেœ বেড়ে ওঠা এ পূর্ণাঙ্গ মোরগটির বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ২০০ টাকা। ফ্ল্যাট বাড়িতে থেকেও যে মোরগ-মুরগি পোষা যায়, ওরা দুই ভাই তা প্রমাণ করলো। বর্ষণ ও বর্ণের জীবের প্রতি ভালোবাসা আমাকে আবগাপ্লুত করেছে। তাই ওদের জন্য সবার আশীর্বাদ কামনা করছি।
পুনশ্চ : মাহফুজ আহমেদ (বর্ষণ) ও মারুফ আহমেদ (বর্ণ)- দুই ভাই সেন্ট গ্রেগরি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। বর্ষণ সপ্তম ও বর্ণ প্রথম শ্রেণীতে অধ্যয়ন করছে।
১৭.০২.২০১২
ওরা বেঁচে-বর্তে থাকুক এই অস্থির সময়ে...
~
বর্ষণ ও বর্ণের জন্য অজস্র শুভকামনা। উদারমনা মানুষ হয়ে বেড়ে উঠুক ওরা দু'জন।
ধন্যবাদ মি. মীর।
শুভকামনা
ধন্যবাদ।
বর্ষণ ও বর্ণের জন্য অজস্র শুভকামনা।
অশেষ ধন্যবাদ...
বর্ষণ ও বর্ণের জন্য অজস্র শুভকামনা। উদারমনা মানুষ হয়ে বেড়ে উঠুক ওরা দু'জন।
ওদের জন্য আপনার শুভ কামনা ফুল-চন্দন হয়ে উঠুক।
মন্তব্য করুন