স্মৃতিতে অম্লান ময়ূরপঙ্ক্ষী নৌকা
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার বয়স তেমন বেশি নয়। তবে অনেক কিছুই স্মৃতির আয়নায় মাঝে মধ্যে উঁকি দেয়, এই যা। দিনক্ষণ মনে না পড়লেও স্পষ্টই মনে পড়ে, যুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনে বিশাল একটি আয়োজন হয়েছিল। আর এ উপলক্ষে তৈরি করা হয়েছিল বিশাল একটি মঞ্চ, যা ছিল ময়ূর আকৃতির। তাই ময়ূরপঙ্ক্ষী নৌকা হিসেবেই এটি পরিচিতি পেয়েছিল। নদীমাতৃক বাংলাদেশে ময়ূরপঙ্ক্ষী নৌকা নিয়ে আছে নানা কল্পকাহিনী, আছে বাস্তব ঘটনাও। ময়ূরপঙ্ক্ষী নৌকা আমাদের সংস্কৃতিতে মিশে আছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বাঙালি জাতির জনককে বাংলার ঐতিহ্যে বরণ করা হয়েছিল খুব সম্ভব এ কারণেই। সে সময়ে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন অনেকের মধ্যে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। কারণ স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন ভারত বাংলাদেশের মিত্র হিসেবে কাজ করেছে।
ময়ূরপঙ্ক্ষী নৌকাটি তৈরি করা হয়েছিল বর্তমান শিশুপার্কের দক্ষিণ পাশটায়। কালের সাক্ষী হিসেবে শিশুপার্কের ভেতর আজো দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বটগাছটি। ওইদিন রেসকোর্সের এ আয়োজনে নেয়া হয়েছিল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এ লক্ষে সমাবেশে অভ্যাগতদের দেহ তল্লাশির ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল প্রতিটি প্রবেশমুখে। এতো নিরাপত্তা সত্ত্বেও অস্ত্র বা গোলা নিয়ে ঢুকতে গিয়ে ধরা পড়েছিল কয়েকজন। যারা ধরা পড়েছিল, তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বটগাছটির আড়ালে। পরের ঘটনা জানা নেই।
ওই মহাসমাবেশটি দেখতে আমিও গিয়েছিলাম আমার অগ্রজ সহোদর মোহাম্মদ আলীর হাত ধরে। নিরাপত্তা তল্লাশি এড়াতে পারেনি আমার মতো শিশুরাও। সবার মতো শিশু বা নারীদের গোপনস্থান ছিল তল্লাশির তালিকায়।
তরুণ বয়সে বা ধ্যান-জ্ঞান বাড়ার পর অনেকবার সে ময়ূরপঙ্ক্ষী নৌকাটি খুঁজেছি; কিন্তু তা আর উদ্ধার করতে পারিনি। আজো মনে আছড়ে পড়ে এ স্মৃতি। বয়সের এ পর্যায়ে এসে দেখলাম, রেসকোর্স ময়দানের নাম বদলে হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এখন এখানে দিনের বেলা যেমন চলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও ললনাদের ডেটিং-ফিটিং আর রাতের বেলা হাট বসায় নষ্টারা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির সাথে যে উদ্যানের নামটি জড়িয়ে আছে, তা কি কোনোভাবেই এ অপবিত্রতার কবল থেকে মুক্ত রাখা যায় না? এ জন্য কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী সরকারের কোনোই দায়িত্ব বা কর্তব্য নেই।
ঢাকা শহরে অনেক দর্শনীয় স্থান আছে, যেখানে ইচ্ছা করলেও যখন-তখন প্রবেশাধিকার নেই। তবে ঐতিহাসিক এ উদ্যানটি সংরক্ষিত রাখতে কি কোনো পদক্ষেপ নেয়া যায় না। এর অর্থ এই নয় যে, আমি দর্শনীয় ফি নেয়ার কথা বলছি। এ উদ্যানের মর্যাদা রক্ষায় সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা অর্থাৎ নোংরামি মুক্ত রাখতে বিশেষ প্রহরার বিষয়টি সরকারের ভাবা উচিত। যাতে সুস্থ মস্তিষ্ক ও নির্মল আনন্দের মানুষ এখানে এসে একটি পরিচ্ছন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।
হাতিরপুল, ঢাকা
১৪.১২.২০১৩
"সবার মতো শিশু বা নারীদের গোপনস্থান ছিল তল্লাশির তালিকায়।" এ রকম অনৈতিক ও অমানবিক সে সময় দেদারছে হয়েছিল । ধন্যবাদ ।
সম্ভবত নিরাপত্তার স্বার্থেই এটা করা হয়েছিল,
with
মন্তব্য করুন