আমার আমি : কিছু এলোমেলো স্মৃতি
জীবন থেকে প্রতিটি ক্ষণ হারিয়ে যাচ্ছে। মানবিক জীবন, সংসার জীবন, ব্যক্তি জীবন এমনকি পেশা জীবনও বাদ পড়ছে না এ গৎবাঁধা সময়সূচি থেকে। মহামনীষীদের লেখায় এ সত্যটি প্রকাশ পেয়েছে ঠিক এভাবে- ‘Time and Tide wait for none’- সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। কেবলই বয়ে চলে।
পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর সাথে সময়ের এ কঠিন নিয়মে আমিও আবদ্ধ। একে একে জীবন থেকে ঝরে গেছে চারটি যুগ, ৪৮টি বছর (নভেম্বর ১০, ১৯৬৫-২০১৩)। এ দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় কী পেয়েছি, কী পাওয়া উচিত ছিল- এ নিয়ে এখন কোনো অনুযোগ, অভিযোগ বা আক্ষেপের সুযোগ নেই। তবে গুণীজনেরা অকপটে লিখে গেছেন- ‘মানুষ যা চায় তা কখনো পায় না; যা পায় তা ভুল করেই পায়’। আমার চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
জন্মেছি এ বাংলার মাটিতে রাজা বিক্রমাদিত্যের বিক্রমপুর পরগনার (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলা) লৌহজং থানার কুমারভোগ গ্রামে। বিক্রমাদিত্য ছিলেন হিন্দু পুরাণের রাজা। তার নামানুসারেই বিক্রমপুরের নামকরণ হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বেশ কয়েকজন শাসক ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত-২, ধর্মপাল, সম্রাট হেমু প্রমুখ বিক্রমাদিত্য পদবি গ্রহণ করেছিলেন। ‘বিক্রম’ অর্থ সাহস বা বীরত্ব এবং ‘পুর’ অর্থ নগর বা এলাকা।
‘বিক্রমপুরে বাপের বাড়ি ছিল একদিন পদ্মার পাড়...’। তবে এখনো আছে ভিটেবাড়ি। দাদার নাম মরহুম মো. আকবর আলী, বাবার নাম মরহুম মো. আদম আলী এবং মায়ের নাম মরহুম সমিরন নেসা। চার ভাই আর চার বোনের মধ্যে আমার অবস্থান সর্বকনিষ্ঠ।
জন্মের এক বছর বয়স থেকে আমি বেড়ে উঠেছি পুরোনো ঢাকার লালবাগে। লালবাগের আলো-বাতাস এখনো আমার স্মৃতি বহন করে চলেছে। লালবাগ এলাকার প্রতিটি রাজপথ, গলিপথ, নদী-নালা, ফসলি জমি, বাগ-বাগিচা, মাঠঘাট, মন্দির-মসজিদ, স্কুল-মাদ্রাসা, ক্লাব-পাঠাগার, পুল-সাঁকো, মাটি-পানি এখনো আমাকে হাতছানি দেয়।
কামরাঙ্গীরচরের ছাতা মসজিদের সে ছাতাটি আজ আর নেই। কালের গর্ভে হারিয়ে তা অন্য রূপ ধারণ করেছে। শৈশবে কত দিন যে, বুড়িগঙ্গার স্বচ্ছ পানি পাড়ি দিয়ে কামরাঙ্গীরচর ছাতা মসজিদ ঘাটে সাঁতরে গিয়েছি তা আজে স্মৃতিকে তাড়িত করে। কাজী রিয়াজ উদ্দিন রোডের ব্যায়ামাগার (মজিদগঞ্জ) পাকাঘাটের উঁচু বেদি থেকে বর্ষার পানিতে এরি (এরো ধরনের লাফ), বোটকির (বসা আসনে লাফানো) আনন্দ এখন খুঁজে পাওয়া ভার। ভরা বর্ষায় ইসলামবাগের (তৎকালীন চর) কাঁচা সড়কের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ¯স্রোতের স্বচ্ছ পানি মাড়িয়ে এপার-ওপার করার আনন্দ প্রকাশের ভাষা নেই। শুষ্ক মৌসুমে খেলার সাথীদের সাথে মনের উল্লাসে ভাটার সময় হাঁটুসম কাদা ডিঙিয়ে নদী পার হতে গিয়ে কখন যে শামুকে পায়ের আঙুল কেটেছে টের পাইনি। মায়ের বকুনি থেকে বাঁচতে পাশের উদ্যান থেকে গাঁদা ফুলের পাতা হাতে পিষে প্রাথমিক চিকিৎসার কাজটি সেরেছিলাম।
রাজনারায়ণ ধর রোড কেল্লার মোড়ের দিলুদের গাছের মিষ্টি কুল (এখন আর নেই) ঢিল ছুড়ে পাড়তে গিয়ে ধাওয়া খাওয়া এবং ফজর ওয়াক্তে লালবাগ কেল্লার মসজিদে নামাজ শেষে বাগান থেকে গোলাপ, বেলিসহ নানা ফুল ও গাছ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে তা রেখে আসার স্মৃতি আজো নাড়া দেয়।
শৈশবে স্কুলে গিয়ে কত যে বাল্যশিক্ষা আর আদর্শলিপি বই হারিয়েছি এর হিসাব নেই। মাটির শ্লেট-পেন্সিলে বাসায় শিক্ষাজীবনে হাতেখড়ি হলেও বেশ কয়েকবার ভর্তি হয়েছি স্কুলে। লালবাগ কেল্লার মোড়ের স্কুলটি (বর্তমানে লালবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নং-২) শুরু করা হয়েছিল একতলাবিশিষ্ট ৩-৪টি কক্ষ নিয়ে। মনে পড়ে, সে সময় স্কুলে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হতো ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ...’। আমরা তখন স্কুলের কাছেই একটি বাসায় (ভোলা হাজীর বাড়ি) ভাড়া থাকতাম। এ স্কুলে যেতে ভালো লাগতো না। মাঝে মধ্যে স্কুলে টিকাদান কর্মসূচি চলতো। স্কুলে টিকা দেয়া হবে এমন সংবাদ ক্লাস শুরুর আগে কোনাভাবে জানতে পারলে, সেদিন টিকা নেয়ার ভয়ে স্কুলে যাওয়া হয়নি। তখন জোর করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে টিকা নিতে হতো। এ টিকা নেয়ার ফলে অনেককে জ্বরে ভুগতে হতো।
দেশ স্বাধীনের পর ভর্তি হলাম লালবাগ শাহী মসজিদের পাশের একটি স্কুলে- ১নং লালবাগ পৌর (বর্তমান সরকারি) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাবা ৫ টাকা ভর্তি ফি দিয়ে স্কুলের খাতায় নাম উঠালেন। এখান থেকেই শিক্ষাজীবন শুরু। তারপর বকশিবাজার নবকুমার ইনস্টিটিউশন। সর্বশেষ সরকারি জগন্নাথ কলেজ।
টিকার ভয়ে আর সে স্কুলে যাওয়া হলো না। পরে মেজো ভাই মরহুম আব্দুল হক স্থানীয় একটি নাইট স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। এখানে ক্লাস শেষে টেলিভিশন দেখার সুযোগ দেয়া হতো। টিভি দেখার লোভে আর কোনো দিন স্কুল ফাঁকি দেয়া হয়নি। নাইট স্কুল পরিচালিত হতো ছাত্রদের দিয়ে এবং সামাজিক ক্লাবগুলোই মূলত নৈশ বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হতো। একদিন জানতে পারলাম, পাঠরত স্কুলের চেয়ে গণি সরদার স্কুলে (লালবাগ গৌরে শহীদ মাজারের মোড়) ক্লাস শেষে বেশি সময় টিভি দেখার সুযোগ দেয়। পরদিন ওই স্কুলে গিয়ে ভর্তি হলাম। ওই স্কুলে বেশ আনন্দ পেলাম। এর কারণ স্কুলটি ছিল দোতলা এবং বিশাল জায়গা নিয়ে। এছাড়া সামনে একটি খোলা মাঠও ছিল।
এক সময় দেশে নানা আন্দোলন-সংগ্রাম দানা বেঁধে ওঠে। একদিকে চলে হরতাল-অবরোধ, অন্যদিকে কারফিউ বা ১৪৪ ধারা। সে সময়ের হরতাল-অবরোধ এখনকার মতো এতোটা ধ্বংসাত্মক ছিল না। হরতালে কেউ রিকশা-স্কুটার নিয়ে বের হলে বড়জোর গাড়ির হাওয়া ছেড়ে দেয়া হতো। তখনকার আন্দোলন কর্মসূচি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। হরতাল মানে পিকেটারদের উপস্থিতি টের পেয়ে দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া। রিকশা-স্কুটার আড়ালে নিয়ে যাওয়া। ফাঁকা রাস্তায় লোকজনের উপস্থিতিও তেমন লক্ষ করা যেতো না। এমনকি নদীপথে নৌকা-লঞ্চ চলাচলের কথাও শোনা যেতো না।
১৯৭১ সাল। দেশে একটি স্বতন্ত্র ভূ-খণ্ডের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে। আমরা ছিলাম কাজী রিয়াজ উদ্দিন রোডে নিজবাড়িতে। বাড়িটি ছিল সেমিপাকা। চারপাশে ইটের দেয়াল আর টিনের চাল। তখন লালবাগ থানাটি ছিল কেল্লার ভেতর উত্তর-পূর্ব কোণে। দিনের বেলা সড়কগুলোতে পাকসেনাদের বেশ পদচারণা লক্ষ করা যেতো। কেল্লার মোড় বাজারের শেষদিকটায় ছিল একটি শ্মশান (বর্তমানেও বহাল)। এর পাশে ছিল একটি ক্লাবঘর। একে তারা আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করতো। দিনের বেলা সাধারণ লোকজন দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করলেও সন্ধ্যার পর কেউ ঘরের বের হতো না। এদিকে কাজী রিয়াজ উদ্দিন রোডে ছিল একটি অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি। এর মালিক ছিল পাকিস্তানি। এখানে তৈরি হতো হেলিকপ্টার ব্র্যান্ডের হাঁড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র। যুদ্ধ-উত্তর ফ্যাক্টরির মালিক হিসেবে জানলাম ইউনুস মেম্বার গং। এর মধ্যে নূরউদ্দিন নামে এক ঢাকাইয়া ভদ্রলোকও ছিলেন। বিশাল সম্পত্তির আরো দু’একজন অংশীদার ছিলেন। বলতে গেলে সম্পত্তিটি দখলে নিয়ে এলাকার প্রভাবশালীরা তা আত্মসাৎ করে।
এখানে ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি মন্দির। স্বাধীনতা-উত্তরকালেও লালবাগ কেল্লার উঁচু বেদিতে গিয়ে দক্ষিণে চোখ ফেরালে মন্দিরটি নজরে আসতো। কালের গর্ভে নয়, প্রভাবশালীদের ক্ষমতায় মন্দিরটি এখন দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেছে। মন্দিরের নিচে ছিল একটি আইসক্রিম ফ্যাক্টরি। এক পয়সা, দুই পয়সা দিয়ে পাওয়া যেতো মালাই আইসক্রিম। অনেক সময় ফ্যাক্টরিতে গেলে ফাও ফাও দিয়ে দিতো দু’একটি।
বর্তমান কেল্লাটি তখন এতো গোছানো বা পরিপাটি ছিল না। পাহাড়ের মতো টিলাটিও ছিল এবড়ো-থেবড়ো। সামনের বিশাল বাগিচাটি খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সকাল-বিকাল বা সময়-অসময় নেই, যখন-তখন ঘুরে বেড়াতাম কেল্লায়। তবে শর্টকাট যাওয়ার পথটি ছিল কেল্লার পশ্চিম পাশে বটতলার কাছ দিয়ে পরিত্যক্ত ড্রেন। বিশাল ড্রেন দিয়ে ঢুকে পড়তাম কেল্লায়। বের হতাম ভেতরে মসজিদের পাশ দিয়ে। এখন আর ড্রেনটি নেই, নিরাপত্তার স্বার্থে মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। কেল্লার অভ্যন্তরে পুকুরটিও সংস্কার করা হয়েছে। পুকুরের দক্ষিণ দিকটায় এক সময় একটি কূপ ছিল। কূপের ওপর ছাতার আদলে একটি ছাদ ছিল। ছোটবেলায় মায়ের সাথে এখানে কাটিয়েছি অনেকটা সময়। বর্তমানে প্রধান ফটক থেকে দক্ষিণ দিকটায় ভারতের লালকেল্লার অনুকরণে নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকটি কুঠরি। যাতে একটি ঝরণাধারাও স্থাপন করা হয়েছে। এটি ছিল মূলত সুড়ঙ্গ পথ। এ সুড়ঙ্গে যাওয়ার জন্য দেয়ালের একটি অংশ ভেঙে দেয়া হয়েছিল। তা দিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকতাম। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সুরঙ্গের ভেতর দিয়াশলাই (ম্যাচ), মোম বা টর্চের আলো বেশি দূর ছড়াতো না। এসব আলো স্থির হয়ে থাকতো। তাই ভেতরে গেলেও ভয়ে বেশি দূর যেতে পারতাম না।
১৯৭৮ সালের দিকে লালবাগ কেল্লাকে আধুনিকায়নে উদ্যোগ নেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আজকের আধুনিক কেল্লার রূপকার হিসেবে তার নাম উল্লেখ করা যায়। কেল্লার পুকুরটিও এ পরিকল্পনার অংশ। পুকুরটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করার কথা ছিল, যাতে দূর থেকে বর্তমান দুর্গ জাদুঘর ও বিবি পরীর মাজারকে মনে হবে আগ্রার তাজমহল। যে কারণে কেল্লার ভেতরে থাকা লালবাগ থানাটি সরিয়ে নেয়া হয় চকবাজার এলাকায়। তার পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত না হলেও আধুনিকায়ন হয়েছে কেল্লার। যা দেশী-বিদেশী পর্যটকদের নজর কাড়ে। বাগান আর ফোয়ারা এক অপরূপ শোভা বর্ধন করেছে লালবাগ দুর্গের।
ঢাকা, ডিসেম্বর ১, ২০১৩
ভাল লেগেছে পড়তে ............... পরেরটি তাড়াতাড়ি আসুক
ধন্যবাদ আর অপেক্ষার...
ভালো লেগেছে এলোমেলো স্মৃতি....
ধন্যবাদ ভালো লাগার জন্য...
মন্তব্য করুন