ইউজার লগইন

চিকিৎসকের অধিক

আমার চিকিৎসক গুলজার আহমেদ পেশাগত শল্যচিকিৎসক হলেও তিনি রোগী দেখেন পেশাগতির চেয়ে অনেক নিবিড়ভাবে। একবার তাকিয়ে আর দুবার প্রশ্ন করেই দুষ্পাঠ্য অক্ষরে খসখস করে ব্যবস্থাপত্র লিখতে শুরু করেন না। রোগীকে যেন তিনি রোগী হিসেবে দেখেন না, ভাবেন একজন ‘মানুষ’ বিপদে পড়ে তাঁর কাছে এসেছে সাহায্যের জন্যে। তাই নিছক টাকার চিন্তা মাথায় থাকে না। তিনি পরম মমতা নিয়েই মানুষকে সাহায্য করেন। সেজন্যেই আমি তাঁকে বলেছি: ইউ আর অ্যা ডক্টর অ্যান্ড মোর দ্যান অ্যা ডক্টর।

অস্ত্রোপচারের পরদিন। গভীর রাত। হাসপাতাল নীরব, নিভৃত। তীব্র ব্যথা উঠল আমার। পাঁচতলায় দায়িত্বরত চিকিৎসকের কথাবার্তা প্রলাপের মতো লাগল। অগত্যা রাত তিনটায় খুদে বার্তা পাঠালাম গুলজার সাহেবকে। তিনি তখন তাহাজ্জুদে মগ্ন। উদ্বেগ নিয়ে ফজরও পড়লেন। ভোরের আবছা আলো ফুটফুট করছে। হরতাল। পিকেটাররা রাস্তায় নামছে। এরই মধ্যে গাড়ি নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। ৫১৬ কেবিনে এসে ঘুমের ওষুধে অবসন্ন আমাকে ডেকে তুললেন। বললেন: ‘মানসিক উৎকণ্ঠায় ভুগছেন বলেই আপনার ব্যথাটা এমন তীব্র। আসলে এ কোনো সমস্যাই না।’ তারপর নার্স ডেকে যন্ত্রপাতি-ওষুধপত্তর নিয়ে লেগে গেলেন কাজে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ক্ষতটা পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত করে দিলেন। পরদিন ছাড়া পাব হাসপাতাল থেকে। বলে গেলেন, বিল শোধের আগে যেন তাঁকে একবার ফোনে কল করি।

তা-ই করলাম। তিনি ক্যাশ কাউন্টারে কথা বললেন। ম্যানেজারকে টাকার অঙ্ক থেকে তাঁর সমস্ত ভিজিট বাদ দিতে নির্দেশ দিলেন। আরো কী বললেন, তখন বুঝি নি। বিলের কাগজ হাতে পেয়ে দেখলাম আরেক দফা কাটাকুটি। ১৬৩২ টাকা বাদ। বাবত: ডিসকাউন্ট বাই চেয়ারম্যান।

ক্লিনিং ও ড্রেসিঙের জন্যে গতকাল ফের গিয়েছিলাম গুলজার সাহেবের কাছে। ইতোপূর্বে আরো একদিন তিনি ভিজিটের টাকা রাখেন নি। তাই কাল আমার প্রস্তুতি ছিল দ্বিগুণ। পাঁচ শো টাকার দুটা নোট আমি টেবিলে রাখলাম। তিনি বললেন, ‘দু শো টাকা দিন।’ অনুনয়ের সুরে বললাম, ‘স্যার, আজকের মতো টাকাটা রেখে দিন।’ আবারো, ‘উঁহু, আমার দু শো চাই।’ অগত্যা একটা নোট সাধলাম। হলো না। বললেন, ‘ভাংতি না থাকলে পরে দেবেন।’ কী আর করা, ব্যর্থ হয়ে খুঁজেপেতে দু শো টাকাই দিলাম। মনে মনে বললাম: “স্যার, ইউ আর অ্যা ডক্টর অ্যান্ড মোর দ্যান অ্যা ডক্টর।”

এ সুন্দর আচরণ আমার প্রতি বিশেষভাবেই করা হয়েছে এমন নয়। আমি মোটেও বিশেষ কেউ নই। অন্যদিকে, আর্থিকভাবে আমি তৈরী হয়েই গিয়েছিলাম, সাহায্যপ্রার্থী ছিলাম না। কাজেই সুন্দর ব্যবহার ও আর্থিক আনুকূল্যের কারণ আমি নই, তিনিই। তিনি সুন্দর মানুষ। বিশেষ মানুষ। তাই তাঁর সবকিছুই সুন্দর ও বিশিষ্ট। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সকল রোগীর প্রতিই তিনি সদয় ও আন্তরিক।

আমাদের রুগ্ণ সমাজে কেউ চিকিৎসক হতে চাইলে মেধার আগে চলে আসে টাকার প্রশ্ন। অঢেল অর্থ ভাঙিয়ে যারা ডাক্তার হন, ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিয়ে যারা পদোন্নতি পান, পেশাগত জীবনে স্বাভাবিকভাবেই সেবার চেয়ে তাঁদের কাছে বড় হয়ে ওঠে অর্থ। ফলে দরিদ্র রোগীদের কাছে লোভী ও স্বার্থপর ডাক্তারের অভিধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কশাই। অতি দুঃখজনকভাবে, আমাদের সমাজে ডাক্তারের চেয়ে কশাই বেশি এবং সেবাবৃত্তির চেয়ে শোষণবৃত্তিই প্রবল। এর মূল কারণ মানবিক মূল্যবোধের অভাব। আমাদের শিক্ষাক্রম আমাদেরকে সেই বোধটি যোগায় না। যোগায় অনেক তথ্য, শেখায় কেবল পেশাগত দক্ষতা। সে কারণেই আমরা ভালো চিকিৎসক হতে পারি, ভালো প্রকৌশলী হতে পারি, ভালো অধ্যাপক হতে পারি – কিন্তু ভালো মানুষ হতে পারি না। ইসলাম ছাড়া মানবিক নৈতিকতার পূর্ণ ও স্থির কাঠামো আর কেউ ধারণ করে না। অতএব মুসলিমপ্রধান বাঙলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সকল স্তরকে ইসলামী নৈতিকতার আলোকে ঢেলে সাজানো ছাড়া সুন্দর মানুষ ও সৎ নাগরিক তৈরির কোনো উপায় নেই। গুলজার সাহেবের মতো দু-একজন মানুষ বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে থেকেও যে মহৎ ও সৎ মানুষ হয়ে ওঠেন, তার কারণ প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় শিক্ষা ও জীবনাদর্শের অধ্যয়ন। আমরা বিস্মৃতিপরায়ণ, কিন্তু মহাকালে এমন আদর্শনিষ্ঠ মহৎ মানুষদের আসন উন্নত, অক্ষয়। মহত্তম মানুষ ও সত্যতম মনুষ্যত্বের প্রতি সালাম!

–––––––––––––––––––––––––––––––
তথ্য: ডা. গুলজার আহমেদ; এমবিবিএস; এমএস (সার্জারি); সহযোগী অধ্যাপক, সার্জারি : নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট; প্রাক্তন বিশেষজ্ঞ কলোরেক্টাল সার্জন : স্কয়ার হাসপাতাল ও পিজি হাসপাতাল, ঢাকা; চেম্বার : ইবনে সিনা হাসপাতাল, সোবহানিঘাট, সিলেট;
ফোন: ০১৭১৪১৩৮৪৯২; ইমেইল: dr.guljar@gmail.com

পোস্টটি ১৪ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

তানবীরা's picture


গুলজার সাহেবের কথা জেনে ভাল লাগলো।

ইসলাম ছাড়া মানবিক নৈতিকতার পূর্ণ ও স্থির কাঠামো আর কেউ ধারণ করে না।

কি করে জানলেন সেটা? অন্যে ধর্মের প্রতি এই মনোভাব কি মুসলমানের পরিচয়?

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.