ইউজার লগইন

একটি পাঞ্জাবীর আত্মকাহিনী

‘জন্মই যার আজন্ম পাপ’
কথাটা কে বলেছেন জানিনা,তবে এই কথা আমার প্রায়ই মনে হয় যখন পকেটে রান্নাঘর থেকে চুরি করা দিয়াশলাই কিংবা সিগারেটের প্যাকেটের আশ্রয় হয় খুবই যত্ন সহকারে।সেটা লাইটারের স্থান হলে তো বেশ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়।অবশ্য এগুলো শারীরিক চাপ।মানসিক চাপ টা এর চেয়ে অনেক বেশী ভয়ংকর।পূজার দিনে আমাকে উদ্দেশ্য করে অনেক কথাই বলা হয় যখন আমার মালিক মুসলিম।আবার ঈদের দিন একই ঘটনা ঘটে সত্ত্বাধিকারী সনাতন ধর্মাবলম্বী বলে।অথচ জন্মের সময়ত কেউ আমার ধর্ম বিবেচনা করেনি।আমার জন্মদানে অবদান তো সবারই আছে।যিনি ডিজাইন করেছেন তিনি হয়ত খ্রিস্টান,শরীরটা যিনি তৈরী করেছেন তিনি মুসলিম, আবার আমার আকার দানকারী হিন্দু।আমি জানিনা কে কোন ধর্মের,তবে সবাই আমার জন্মদাতা-জন্মদাত্রী।

আমি এক সামান্য জড়বস্তু,বাংলাদেশের বিখ্যাত কোন কোম্পানীর তত্ত্বাবধানে কোন এক গার্মেন্টসে যার জন্ম।কোম্পানীর নাম বলছিনা,বিজ্ঞাপনের দায়িত্ব আমার না।আমি খুবই ভাগ্যবান বাংলাদেশে জন্মে,জন্মের পর থেকে মায়ের আদর পেয়েছি।জানিনা অন্যান্য দেশে কি হয়!একটি শিশু যেমন সারা জীবন তার মায়ের কোলে থাকতে পারেনা,আমিও পারিনি।কাজের উদ্দেশ্যে নেমে পরতে হয়েছে মায়ের মমতাকে তুচ্ছ করে।সঙ্গী আমারই মত আরও কিছু হতভাগা।কারো জায়গা হয়েছে ফুটপাতে,কারো ছোট-খাটো দোকানে।আবার কারো ভাগ্য তাদের নিয়ে গেছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শপিং মলে,আমি এই ভাগ্যবানদের একজন।কোন এক ঈদের মৌসুমে আমার জন্ম।মায়ের কোলে বেশীদিন থাকতে পারিনি।জন্মের পর খুব দ্রুত পথে নামতে হয়েছে।সে তুলনায় অফ-সিজনে যাদের জন্ম তারা অনেক সুখি।

তো যাই হোক,যার জন্মই পথে নামার জন্য,তার আবার এত সুখ-দুঃখ ঘেঁটে কি হবে!আমাকে যে পথে নামতে হয়নি সেটা আবারও বলি।মানুষের সাথে থাকলে তাদের মত গর্ববোধ একটু আধটু চলেই আসে!শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শো-রুমে থেকে এই বদ অভ্যাসটা আমার হয়েছে।কত মানুষ দেখলাম বাইরে কত সাজগোজ,অথচ গায়ের কাপড়টা সরালে আসল রূপটা দেখা যায়।ট্রায়াল দেয়ার সময় ঘৃণায় দম বন্ধ হয়ে আসত,কিন্তু করার কিছুই নেই।আমার ক্ষমতা শুধু নগ্ন মানুষের শরীর ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ।

এসির বাতাসে মাঝে মধ্যে বিরক্ত লাগত।মনে হত ছুটে বেড়িয়ে যাই।তার উপর আছে জনগণের অত্যাচার।অবশেষে এক সন্ধ্যায় আমার মুক্তি মিলল ওই হাজতখানা থেকে। আমি পেলাম আমার প্রভুকে।আমাকে পেতে তিনি কতটা অর্থ ব্যয় করেছেন সেটা আমার কাছে কোন বিষয় না,কতটা সময় ব্যয় করেছেন সেটাই মুখ্য বিষয়।আমার প্রভু সময় বেশ ব্যয় করেছেন সেটা আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি।এখন আমরা দুজনই আনন্দিত,প্রভু আমাকে পেয়ে আর আমি এসি থেকে মুক্তি পেয়ে।

মায়ের আদর ছেড়ে এখন আমি আমার প্রভুর আদরে।তবে শূন্যতা থেকেই যায়। এখানেই নারী পুরুষের পার্থক্য।সময় ভালোই কাটতে লাগল নতুন ঠিকানায়।প্রথম দিনটা মনে থাকবে সারাজীবন।কত মানুষের সাথে কোলাকুলি,কুশল বিনিময়,কত সুগন্ধির স্পর্শ!এদের সকলে আবার একই ধর্মের নয়,এই বিষয়টাতে আমি আমার প্রভুকে নিয়ে গর্ববোধ করি।বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ছোঁয়ায় জন্ম কিনা!সেদিন মনে হয়েছিল আমার জন্ম সার্থক।
ভয়ের ব্যাপারটা আমি এড়াতে পারিনি।রান্নাঘর থেকে চুরি করা দিয়াশলাই কে জায়গা দিতে না হলেও সিগারেটের প্যাকেট,লাইটারের জন্য জায়গা রাখতে হয়েছে ঠিকই।প্রভুকে নিয়ে আমি বেশ সন্দিহান।তাঁর অদ্ভুত আচার-আচরণ আমাকে ভাবিয়েছে বেশ।সেটা আলোচনা করা অবশ্য আমার অধিকারের মধ্যে পরে না।মধুর সময়গুলো আমার মনে দাগ কেটে রেখেছে।বিশেষ করে রাস্তা পাড় হওয়ার এক দিন।আমাকে গায়ে জড়িয়ে রাখা মানুষটি তখনও বুঝতে পারেননি আমার শরীরের কোনটি শক্ত করে ধরে আছেন একজন বৃদ্ধা।হঠাৎ পেছনে টান পরায় ঘুরে তাকান তিনি।ভেবেছিলাম বিরক্ত হবেন কিনা!কিন্তু আমার তুচ্ছ ধারণাকে তুচ্ছ করে তিনি যত্ন সহকারে পাড় করে দিলেন বৃদ্ধাকে।কিংবা সেই দিনটি,যেদিন উষ্ণ ভালোবাসার বাক্য বিনিময়ে কেটে গিয়েছিল কয়েক ঘণ্টা!আসলেই,সুখস্মৃতি বলে শেষ করা যায়না!

প্রভুর সাথে কেটেছে দীর্ঘ তিনটি বছর।
সেদিন শারদীয় উৎসবের সপ্তম দিন।বাড়ি থেকে বেড়নোর সময় একটু কটু কথা শুনতে হলেও তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি কথাটা।রাস্তার ভীড়ে জায়গা হল বন্ধুর বাইকে।বেশ খানিকটা সময় পাড় হয়ে গেলেও অনুভূতি হয়নি কোনই।মানুষের সাথে থেকে থেকে মাঝে মধ্যে অনুভূতিহীন হওয়ার গুণটা ভালো মতই রপ্ত করে ফেলেছি।সম্বিত ফেরার পরের ঘটনাটা কখনই মনে করতে চাইনা।
এভাবেই যে একটি পাঞ্জাবীর অপমৃত্যু হবে ভাবিনি!!

পোস্টটি ৯ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

সামছা আকিদা জাহান's picture


জন্মই আমার আজন্মের পাপ লিখেছেন দাউদ হায়দার। আপনার পোস্টটি চমৎকার। ভাল লাগলো।

মারুফ প্রতীক's picture


ধন্যবাদ Smile
আমার খুব প্রিয় একটা পাঞ্জাবী ছিড়ে যাওয়ার কষ্টে এটা লিখে ফেললাম।।

তানবীরা's picture


আপনার পোস্টটি চমৎকার। ভাল লাগলো।

দূরতম গর্জন's picture


এবার পাজামারটা লিখে ফেলুন

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


ভাল্লাগছে।

মারুফ প্রতীক's picture


জিনস এর টা লিখতে পারি!! Wink

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মারুফ প্রতীক's picture

নিজের সম্পর্কে

নিজের সম্পর্কে আমি নিজেও খুব একটা জানি কিনা সন্দেহ আছে