ফেলে আসা দিনগুলো
ফেলে আসা দিনগুলো...
(আমরা বন্ধুতে এটাই আমার প্রথম লেখা । যদিও এই এর ছিমছাম আঙিনায় উঁকি ঝুঁকি মেরেছিলাম অনেক আগেই । আমি মূলত পাঠক –ই, লেখালেখির দুরাশা সবার না করাই ভাল । এখানে অনেকের লেখা পড়ি, আনন্দ বেদনায় তাঁদের অজান্তেই তাঁদের সঙ্গী হই । শুধুই পড়ে যাব ভেবে ভেবেই লিখে ফেলা । যা অনেকটাই নিজের সাথে কথোপকথন । পড়ে ভাল মন্দ কিছু বললে আনন্দিত হব, হয়ত হাবিজাবি লিখবও )
হাইস্কুলের নিচের দিকের ক্লাসে পড়ি তখন । এখন আর দিন তারিখ ধরে সঠিক মনে নেই । আমার জগত ছিল আমার ছোট্ট পড়ার ঘরটিকে ঘিরে । অবশ্য কাজের পড়ার চেয়ে অকাজের পড়া হত হাজারগুণ বেশী । অকাজের পড়া মানে ‘আউট বই’ পড়া ।
বলার অপেক্ষা রাখেনা পড়তে হত লুকিয়ে । আশে পাশের সবাই ভাবে মেয়ে যেভাবে পড়াশোনায় মুখ গুজে থাকে সারাদিন, মাশাল্লা না জানি কোন হাতি -ঘোড়া হবে বড় হয়ে ! তাতে আমার বুক ফুলে ফেঁপে উঠলেও মনের ভিতরে পাপভাব রয়েই যায় । আমি ত জানি আমি সারাক্ষণ ওই ঘরের ভিতর কোন কর্মটা করি !
একটা মস্ত সুবিধা ছিল এই যে, াম্মার কড়া হুকুমের কারণে ওই ঘরে প্রায় সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল । মেয়ে রাত দিন পড়াশোনা করে এম্নিতেই কাহিল, কত বড় বিদ্যার জাহাজ-ই না হচ্ছে, তাকে বিরক্ত করা যাবেনা ! তিনি নিজে শুধু মাঝে মধ্যে উকি ঝুঁকি মারতেন । তাতে আমার তেমন কোন অসুবিধা ছিলনা অবশ্য । কারণ বাইরের বই পড়তাম সব সময় পড়ার বই এর ভিতর লুকিয়ে । তাছাড়া একটা লম্বা খাতা খুলে কলমটা হাতে নিয়ে এমন ভাবে ধরে রাখতাম, যেন শব্দ শুনা মাত্র খাতায় লিখতে আরম্ভ করতে পারি ।
ভাবখানা এমন আমি এতক্ষণ ধরে লিখতে লিখতে লিখতে ক্লান্ত আর তুমি কি না এখন এসেছো আমার খবর নিতে? যাই হোক, মা তখন সন্তষ্ট মনে যখন যা হয় আমটা, দুধটা পাঁঠিয়ে দিতেন কাজের মেয়ের হাত দিয়ে । আমি তখন মনের আনন্দে পা দুলিয়ে দুলিয়ে কিছুটা খাবার মুখে পুরে কিছু জানালার বাইরে ফেলে দিয়ে আরও কয়েক ঘণ্টার জন্য নিশ্চিন্ত মনে বাইরের বই পড়া চালিয়ে যেতাম । যাক, যা বলার জন্য এতো ধানাই পানাই তা এখনো শুরুই করিনি । এবার করা যাক । তখন বই কেনা, জমানো আর পড়া ছিল আমার একমাত্র নেশা ধ্যান জ্ঞান সব ।
এই অভ্যাসটা শুরু হয়েছিল এক্কেবারে ছোটবেলায় । কেউ কি চাই বললেই আমার একমাত্র বায়না ছিল বই বই আর বই । আমাদের স্কুলের লাইব্রেরীর সব বই চেয়ে চিনতে পড়ে ততদিনে শেষ হয়ে গেছে । মলুয়া, মহুয়া আর কী কী জানি সব জীবনী গ্রন্থ ছিল লাইব্রেরীতে । আমার আগে ওসব বই কেউ ছুঁয়ে দেখেছিল কি না সন্দেহ !
কয়েকটা তাকের উপর অনেকটা অযত্নে রাখা কিছু বই । ধুলো বালির স্তর জমছে তাতে, কেউ পড়ে না, তাও বই ধার দিতে কি আলস্য ! কি আলস্য !! শরীরের আড়মোড়া ভেঙ্গে তিনি এমনভাবে চাইলেন আমার দিকে, যেন বই চেয়ে আমি এমন উদ্ভট আবদার করেছি যা এর আগে কেউ কখনও করেনি ! এই থেকেই আমার ধারণা জন্মেছিল আমার আগে স্কুলে লাইব্রেরী নামে কোন বস্তু আছে , সেখান থেকে বই ধার করে পড়াও যায় এটা স্কুলের কারো ধারণাই ছিল না ।
কি আর করা, বহুত হাঙ্কি পাঙ্কি করে বইয়ের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক বই হাতে নিয়ে এদিক ওদিক উলটে পালটে দেখে, চেহারায় তাচ্ছিল্যের ভাব হেনে আমার হাতে তিনটা বই তুলে দিয়েছিলেন, এবং সেই থাকে অনেক অনেক কথা শুনিয়েছিলেন, আমি তার কিছুই অবশ্য শুনিনি উত্তেজনার বশে । শুধু সেই মুহুর্ত্যে এভারেস্ট জয়ের আনন্দ অনুভব করেছিলাম দিব্যি দিয়ে বলতে পারি ।
আমার ছোট্ট পড়ার ঘরে আমার জন্য বানানো হয়েছিল একটা তালাবন্ধ ডেস্ক । উদ্দেশ্য আমার বই খাতা পত্র আমি সযতনে রাখব সেখানে । কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন, পড়ার বই টই সব টেবিলের উপর রেখে ডেস্কের ভিতরে রাখতাম আমার সব ‘আউট বই’, আমার প্রাণ ভোমরা । অন্যান্য বইয়ের সাথে ছিল এক খন্ড শরৎরচনাবলী । আমার নিজের টাকা দিয়ে কেনা প্রথম কোন লেখকের রচনাবলী সমগ্র । তাছাড়া রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর ! মাসুদ রানা তখনো পড়িনি । তাই দস্যু বনহুর-ই তখন আমার ধান জ্ঞান । আহা কত রাত মশারীর ভিতরে ঘুমের ভান করে থেকে বন-হুরের সাথে পাহারে - জঙ্গলে ভয়ানক সব অভিযানে প্রাণ আটকে রেখে তাঁর সহযাত্রী হয়েছি । একটা বই শেষ হবা মাত্র প্রবল নেশাখোরের মত পরের বই যোগাড়ের দান্ধায় থাকতাম ।
রোমেনা আফাজ তখন আমার চোখে দস্যু বনহুরের চেয়েও দুর্ধর্ষ এক নারী । যিনি কিনা এরকম বই লিখতে পারেন, সৃষ্টি করতে পারেন বন-হুরের মত চরিত্র তিনি নিজে না জানি কেমন অতিমানবী ! ভাবতাম আর শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসত । তারপর অন্য অনেক বই ভালো লাগলেও (তখনও রবীন্দ্রনাথ পাঠ্যবইয়ের বাইরে পড়া হয়নি) শরৎচন্দ্র মশাই আমার মন প্রাণ কেড়ে নিলেন । তাঁর বই পাগলের মত পড়ি, পড়ি আর আকুল হয়ে কাঁদি । অমুক দিদি তমুক বউদির দুঃখে বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায় । মানুষ কেমন করে এতো পাষাণ হয়, হতে পারে ভেবে ভেবে কূল পাইনা ।
সেই সময় এক কু-ক্ষণে এলেন আমার এক ফুফু । যিনি ঢাকায় থাকেন । পড়াশোনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে । পড়াশোনায় খুবই ভালো । সবাই যখন তখন আমাদের কচি কাঁচাদের সামনে উদাহরণ হিসেবে তাঁকে ব্যবহার করেন । তো উনি অবশ্য গ্রামে আসেন ন'মাসে ছ'মাসে একবার । সেবার যখন গ্রামে এসে আমাদের বাড়িতে পদধূলি দিলেন, আমি ঠিকই করে রেখেছিলাম যেমন করে হোক উনার নজরে পরতেই হবে । কেন পড়তে হবে তা অবশ্য জানিনা ! যাহোক, নজরে পড়বার একমাত্র উপায় স্থির করলাম যদি কোনভাবে আমার বই’র ভাণ্ডারটি উনাকে একনজর দেখানো যায় !
এমনি অবস্থায় একদিন পড়ার ঘরে বসেই শুনতে পেলাম উনি এসেছেন দলবল সহকারে । কথা হাসি সবই শুতে পাচ্ছিলাম কিন্তু বই এ মুখ গুঁজে গ্যাঁট হয়ে বসে রইলাম । দেখাতে যে আমি কত বড় মাপের পণ্ডিত হব কালে কালে ! তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করা ছাত্রী হতে পারেন, আমিও এই টুকু বয়সে কম যাই না । সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি । এতো এতো বই পড়ি । এত কম বয়সেই নিজের পয়সা দিয়ে শরত রচনা বলী পর্যন্ত কিনে ফেলেছি ! হুহ! আমি কম কিসে । উনার কি আছে আমার মত এতো বই !?
সিদ্ধান্ত নিলাম আমি রুম থেকে বের হবোনা । না হলে বই দেখানোর আশা ফস্কে যেতে পারে । তক্কে তক্কে ছিলাম যদি কোন ভাবে এই রুমে তাকে এনে ফেলা যায় । নিশ্চয় আমাকে না দেখতে পেয়ে খুঁজতে আসবেন এদিকে । কিন্তু আমার মত পুঁচকে কে, পুঁছে কে ? অনেকক্ষণ চলে যাবার পরও যখন কারো এদিকে আসার কোন গরজ দেখা যাচ্ছিলনা,আমি তখন উপায়ন্তর না দেখে পড়ার বই একটা হাতে নিয়ে স্বর সপ্তমে চড়িয়ে পড়তে শুরু করলাম ।
নিজের একটা ঠনঠনে আত্মসম্মানবোধ ছিল সেই বয়সেই । নিজে গিয়ে গায়ে পরে ডেকে আনব তেমন ইচ্ছা ছিল না । হঠাত শুনি কয়েকটি পায়ের শব্দ আমার রুমের দিকেই এগিয়ে আসছে ! আমি তড়ি ঘড়ি করে উঠে ডেস্ক আধখোলা করে রাখলাম যাতে ডেস্কের ভিতরের কিছু বইয়ের নাম অন্তত পড়া যায় !
অবশেষে তিনি এলেন । ঢুকেই বিরাট হই চই করে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু টুমু খেয়ে একসা । আমি লজ্জিত মুখভাব করে গোবেচারার মত দাড়িয়ে রইলাম । তিনি কী কী সব বলে গেলেন আমি কিছু শুনলাম কিছু শুনলাম না । আমার মন চোখ তখন পড়ে আছে আমার বই এর ডেস্কের ভিতরে ।
কি করে জানি এখন আর ঠিক মনে নেই, হয়তবা আমার চোখ অনুসরণ করেই হবে আমার ডেস্কে রাখা থরে থরে সাজানো বইয়ের দিকে উনার চোখ আটকে গেলো । তিনি এগিয়ে গিয়ে একটা বই হাতে তুলার উপক্রম করবা মাত্রই আমি দৌড়ে গিয়ে শরৎরচনাবলী খানা তুলে নিয়ে বোকার মত একগাল হেসে উনার হাতে ধরিয়ে দিলাম। তিনি চোখ কপালে তুলে (হয়তবা আমার দেখার ভুল হতে পারে) জিজ্ঞেস করলেন,
এই বই তোর ?
হুম, কিনেছি !
পড়া হয়েছে ?
সেই কবে !
ওহ! পড়ে যখন ফেলেছিস এটা দিয়ে আর কি করবি? আমি এটা নিয়ে গেলাম !
বলেই তিনি আমার বইটি হাতে নিয়ে গট গট করে বেরিয়ে গেলেন ।
আমার আর হা না কিছুই বলা হয়নি । বললেও কেউ ফিরে তাকাত কিনা সন্দেহ !
শুধু মনে হয়েছিল কেউ আমার কলিজাটা ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে এই মাত্র উপড়ে নিয়ে চলে গেলো...
সেই কষ্ট বোধ বহুদিন ছিল আমার সাথে । এখনও মনে পড়লে চিনচিনে একটা ব্যাথা যেন টের পাই বুকের ভিতর, কোথাও...
স্বাগতম । আপনার লেখা ভাল লাগছে। লেখতে থাকেন ধুমায়া
আপনি দস্যু বনহুর আমলের লোক ! তারমানে বেশ প্রাচীন
দস্যু বনহুর অবশ্য আমার জন্মের আগের যুগ
ছোটবেলায় মা নিউমার্কেটে নিয়ে গেছে মায়ের আঁচল টান দিয়ে ধরে রাখতাম কমিকস কিনে দেয়ার জন্য। একটা দুইটা করে আড়াইশ টা কমিকস হইছিলো আমার। সবচেয়ে প্রিয় ছিলো টিনটিন আর নন্টেফন্টে। আমার স্কুলের বন্ধু (সে আবার ক্লাস টিচারের কিরকম ভাগ্নে ছিলো), সেই বেটা আমার 'আমেরিকায় টিনটিন' আর 'নীলকমল' বই দুইটা মাইরা দিছে পড়ার নাম করে। আমি কতবার চাইয়াও পাইলাম না, (স্যারের ভাইগ্না বলে কিছু করি নাই, নইলে ধইরা মাইর দিতাম, ততদিনে মারামারি করার বেশ একটা সুনাম কামাই করছিলাম )
সেই কমিকস দুইটার শোক আমি আজও ভুলতে পারি না

কেয়ামতের দিনেও আমি এর দাবি তুলুম
আপনার লেখা পড়ে সেই স্মৃতি মনে পৈড়া গেলো, আহারে আমার দুইখান টিনটিন

পড়ার জন্য এবং সুন্দর মন্তব্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ । হ অনেক প্রাচীন
কাচ্চা বাচ্চাদের ভীরে ঠেলেঠুলে যদি এক্টুস খানি জায়গা মিলে সেই আশায় লেখা আর কি
আমি কত বই যে হারিয়েছি । কত বই যে মানুষজন নিয়ে গেছে সে আর এখন হিসেব করতে যাইনা । ওটা প্রথম হারানোর দুঃখ ছিল ত,তাই ইনিয়ে বিনিয়ে লিখলাম
এবি তে সুস্বাগত, আপু।
লেখা ভাল লাগছে। পড়া আর লিখা দুইটাই চলুক।অনাগত দিনগুলোতে অসংখ্য শুভকামনা।
এই ফাঁকে বলে রাখি আপনি কিন্তু আমার পছন্দের একজন লেখক
থ্যান্ক্যু, আপু!
আরেকটা কথা,
এই ব্লগে আমার চেয়ে ছোট কেউ খুব বেশি নেই!
আর বড় দের কাছে 'আপনি ' একদমই ভাল লাগে না!
আমাকে তুমি করে ডাকলেই খুশি হব..
ঠিক আছে, তাই হবে । আগের কালের মানুষ ত সহজে তুমি আসতে চায়না মুখ দিয়ে
ছোটবেলায় আউট বই পড়ার বোধহয় সবারই একই কাহিনী। খাতার নিচে অথবা অন্য কোন বইয়ের নীচে লুকিয়ে আউট বই পড়া।
আহা সেই দিন সেই শৈশব, কৈশোর।
লেখা ভাল লেগেছে চালিয়ে যান। আছি সাথে।
ধন্যবাদ পড়ার এবং মন্তব্য করবার জন্য
এবি তে স্বাগতম
লিখতে থাকুন।
ভাল লাগল ।
লেখা ভালো লাগছে।
স্বাগতম বস্। অসাম লেখা! আপনে কম কমই লেইখেন। কারণ বেশি লিখলে এইখানে যারা নিয়মিত লিখে তাদের পেটে-ভাতে মারা পড়বার সম্ভাবনা আছে
কোন বাঁশটা দিলেন বস বুঝলাম না
ওরকম কিছু দেয়া হয় নাই। আমি ভালো ছেলে, ওইসব পচা জিনিস দিই না। আর শুনেন, নিয়ম করে লেখা দিবেন। এতো ভালো লিখেন, কিন্তু এতদিন লিখেন নি; এইজন্য আপনার জরিমানা হইসে।
যাক,তাইলে ভরসা পাইলাম
লেখা ভালো লেগেছে
ধন্যবাদ তানবীরা, আপনার লেখাও আমার খুব ভাল লাগে ।
মন্তব্য করুন