সময় বয়ে যায় ধু ধু কংক্রিট অঞ্চলে!
এবারের বই মেলায় আমার একটা সিরিজ বই কেনা হয় নাই মাওলা পাবলিকেশন্সের কারনে। তা হলো মুনতাসীর মামুনের ঢাকা স্মৃতি সিরিজ, ১৬ খন্ডের। আমি যখনই তাঁদের স্টলে গিয়েছি তখনি জবাবঃ ভাইয়া এক খন্ড নাই, ৭ আর দুই নাই, আরেকদিন আইসেন, শেষ দিন যখন কিনতে উদ্ধত হলাম তখন দুই নাম্বারটা নাই। রাগে ক্ষোভে তাই আর ১৫০০ টাকা দিয়ে আর কেনাই হলো না সিরিজটা। আমাকে বাংলা বাজারে যেতে বললো সেলসম্যান। যাই হোক এখন মনে হচ্ছে ঢাকা নিয়ে পড়ে লাভ কি? রাজধানীর এই ইট কংক্রিটের জঙ্গলে রুপান্তর হবার আগের ইতিহাস জেনে তেমন কিছুই হবে না ফায়দা। খালি মানুষকে বলার জন্যই পড়তে হবে। গত বিশ ত্রিশ বছরে এই ঢাকা শহরকে যেভাবে চিড়িয়াখানা বানানো হয়েছে তাতে কাকে দোষ দিবো। জাতি হিসেবে আমাদের ফেইলর তো আর কম না, একটা ভালো নগর বানাতে পারি নাই, আর যে ছবির মতো সুন্দর মফস্বল গুলো ছিলো সেগুলোকে নষ্ট করেছি। তাই ঢাকা শহর দিন যত যাচ্ছে তত তলানীতে গিয়ে ঠেকছে নুন্যতম বসবাসের সু্যোগের দিক দিয়ে। সবাই এই শহরেই থাকে- কার্য সাধনের আশায়। সাধন শেষে কাউকেই থাকতে দেখলাম না চেনাজানা। আমার এক বন্ধু ছিল, বলতো ঢাকাতে সবাই থাকবে, কেউ কেউ চিটাগাং থাকবে আমি চলে যাবো গ্রামের বাড়িতে। সেই বন্ধু এখন ইংল্যান্ডে। আমি মাঝে মাঝে খোচা দিয়ে বলি কিরে গ্রামের বাড়ীতে থাকবা না আর? ও বলে উঠে 'দোস্ত আর এই জীবনে গ্রামের বাড়ীতে থাকা হবে না'। তখন আমাকেও খোচা দেয়, তোর না জামালপুরে গিয়ে ব্যাবসা করার কথা, ঢাকাতে পড়ে আছোস কেন? আমি বলি কেউ কথা রাখে না, তাই আমরাও কথা রাখি না। মরার শহরে পরে আছি, ফ্যান্টাসাইজ হই এই শহর নিয়েই! বিরক্ত হই নানান কিছুতেই তবুও দিন চলে যায় এই কংক্রিটের ধু ধু অঞ্চলেই!
তবুও মানুষজনকে দেখি ভালোই আছে। আগে সমমনা অনেক মানুষ পেতাম এখন পাওয়া দুরুহ, কারন সবাই ভালোই আছে। খাচ্ছে দাচ্ছে ঘুমোচ্ছে, আয়েশেই দিন কাটাচ্ছে সবাই। সব কিছুই সহ্য করে নেবার যে কিংবদন্তীতুল্য ক্ষমতা আমাদের আছে তা খালি দিন দিন হিমালয়ের মতোই উঁচুতে উঠছে। আমিও হয়তো এমনই। কিন্তু ইদানিং শহরবাসীর সব রাগ ঝারার জায়গা দেখি রিকসাওয়ালার সাথে। রিকসাওয়ালা বেশী ভাড়া চাইবে কারনে অকারনে, আর খাবে মাইর। আমি মাইর দেয়ার পক্ষে না, কারন বাপ মা এত কষ্ট করে পড়াশুনা করিয়েছে কি রিকশাওয়ালাদের অভিশাপ কামানোর জন্য। আমি আবার এইসব অভিশাপ তত্ত্বে খুব বিশ্বাস করি, কখন কে কি বলে যদি লেগে যায় তাহলে আরেক বিপদ! আমার বন্ধু অমিত রায় ছিল আমার বিপরীত। গায়ে হাত তোলা ছাড়া তার আর কোনো কাজ নাই। কত রিকশা চালক যে তার হাতে মার খেলো হিসাব নাই। বেশী ভাড়া চাইলেই রাম চটাকানা মারাই তার একমাত্র কাজ। কিছুদিন আগে দেখা হলো টিএসসিতে, না চাইতেই। খুব সুখে আছে, এফজেড বাইক কিনেছে, বললো তোর জন্য সুখের খবর এখন আর রিকশা চালক মারা হয় না, লেগুনা ড্রাইভার আর প্রাইভেটের চালক এই তার এখন চটকানা মারা লিস্টে। আমি হাসি, কাউকে গালে কষে থাপ্পড় মেরেও যে যৌন উত্তেজনা প্রশমনের মতো সুখ হয় তা আমার জানা ছিল না।
অনলাইনে এখন প্রচুর ফ্ল্যাশ মবের ভিডিও নিয়ে আলাপ দেখি। নানান বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছেলেমেয়েরা নাকি স্পোটেনাসলি মব করছে, তাল মিলিয়ে মানুষ হটিয়ে ধেই ধেই করে ব্যাস্ত জায়গায় নাচছে, ২০ টা ক্যামেরায় তা ধারন হচ্ছে, এডিট হচ্ছে, তা সমানে শেয়ার দিচ্ছে নিজেরাই, নানান লোকজন তা নিয়ে মতামত দিচ্ছে। কি এক অদ্ভুত কান্ড! আমার গতকালকেও এইসব ফ্ল্যাশ মব টব নিয়ে ভালো ধারনা ছিল না। পরে মনে হল খারাপ কি? বাংলা সিনেমার এক্সট্রায় নাচার মতো এখন অনেক পড়াশুনা করা ছেলেমেয়েদের দেখতে পাওয়া যাবে। সেই সাড়ে তিনশো টাকার বিনিময়ে নিম্নবিত্ত মেয়েদের ধরে আনার দিন শেষ হবে একদিন। আর ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ক্রিয়েটিভিটির। কারন আমি বাল্যকালে খুব নাচানাচির দিওয়ানা ছিলাম, খুব নাচতামও অন দ্যা ডিমান্ড, কিশোর বেলা থেকেই নাচানাচি আমার কাছে ছ্যাবলামি মনে হওয়া শুরু হলো। এমনকি আমি কোনো গায়ে হলুদেও নাচি না, নিজের একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে ভাবীর গায়ে হলুদেই যাই নি উনাদের বাসায়। ভার্সিটির প্রোগ্রামেও পোলাপান খুব জুরাজুরি করতো, আমি বুঝিয়ে দিয়েছি আমার টাইপ ভিন্ন। আমি চিরটাকালই বোরিং টাইপের মানুষ। তাই আজ সিদ্ধান্ত নিলাম ফ্ল্যাশ মব জিনিসটা ভালোই। এই দেশে যে নিরানন্দময় উচ্চশিক্ষা, তাতে এইসব নাচানাচির দরকার আছে। গবেষনা কিংবা পড়াশুনার মানে তো আমরা পিছিয়ে থাকতে পারি, কিন্তু ফ্ল্যাশ মবের হুজুগে কেনো পিছিয়ে রবো? তাই যা হচ্ছে ভালোই। আমি অবাক হচ্ছি স্কুলের ছেলে মেয়েরা কেন পিছিয়ে আছে? ফ্ল্যাশ মব জিনিসটা আমি প্রথম জানি 'ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিট' সিনেমাটা দেখতে বসে। মিলা কুনিসরে দেখতে এত ব্যাস্ত ছিলাম যে ঠিক মতো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারি না। আমি যখন সিনেমাটা দেখি মিলা কুনিস তখন এস্টন কুচারের গার্লফ্রেন্ড, আহা বেচারা কি ভাগ্যবান। আমাদের কপালে তো ডেমি মুরও নাই, মিলা কুনিস তো দুর কি বাত! যাই হোক ফ্ল্যাশ মব জিনিসটা ভালো করে বুঝি গ্যাং নাম স্টাইল নামক গানে এক উদ্ভট নাচে। এখন জানিলাম শুধু গ্যাং নাম নয়, নানা কিছুতেই উদ্যোগ নিয়ে মানুষ এইসব করে। তবে ঠিকই আছে টিটুয়েন্টি ক্রিকেট যেমন উদ্ভট এক ক্রিকেট ভার্সন, তেমন ফ্ল্যাশমবও তার কাছাকাছি মানের এক উদ্ভট জিনিস!
এবার নিজের কথা বলি। আমাদের জীবন চলছে ঠেলাগাড়ির মতোই ঠেলেঠুলে। বইপড়ি, সিনেমা দেখি, সস্তা টাইমপাস আড্ডা মারি, ভার্সিটি যাই, দিন চলে যায়। আজ মনটা ভালো, কারন এক বন্ধু অঞ্জন দত্তের ফুল ডিস্কোগ্রাফী পেনড্রাইভে গিফট দিলো। খুব আনন্দ পাচ্ছি, অনেক মুখস্থ কিন্তু শুনি না খুব একটা সেইসব গান শুনে। আবদার জানিয়ে রেখেছি কবীরসুমন, রেনেসা আর চন্দ্রবিন্দুর ডিসকোগ্রাফীও যেন পেনড্রাইভে দিয়ে যায় মানে মানে। চাইবার কোনো শেষ নাই আমার। এতদিন ধরে সতীনাথ পড়ে শেষ করলাম- একটা মাত্র উপন্যাস নাম 'জাগরী'। দুর্দান্ত একটা লেখা। আমি মুগ্ধ। তার সাথে সাইড ভাবে এখন পড়া হচ্ছে খালেদ মোশারফের কে ফোর্স নিয়ে একটা বই, পড়তে বড়ই বোরিং কিন্তু টেকার কথা ভেবে পড়ি, ৩২০ টাকা দিয়ে বইটা প্রথমা থেকে কেনা। বইটা ভালোই লাগে না তাও পড়ছি মুক্তিযুদ্ধের অতি নিম্নমানের বর্ণনা। 'খাকি চত্তরের খোয়ারি' পড়লাম, শাহদুজ্জামানের, টাইমপাসের জন্য ভালো। পরিচিত কিছু ক্যাডেট কলেজ নিয়ে গল্প নতুন ভাবে বলা। আমরা যে স্কুলে পড়েছি তাতে প্রতি ব্যাচে ২০-২৫ জন নানান ক্যাডেট কলেজে চলে যেত। তাই আমাদের জন্য নতুন কিছু নাই বইতে। এখন পড়ছি ময়ুর সিংহাসন, শাহীন আখতারের, তেমন টানছে না। সিনেমা কি আর দেখবো, মজনু নামের এক কলকাতার মাসালা মুভি দেখলাম। বালের সিনেমা। রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামের এক সিনেমা দেখলাম, ভালো না মোটেও। কলকাতার বানিজ্যিক ছবিগুলো হিন্দির সিনেমার চেয়েও বেশী লেইম, রাজত্ব কিংবা শুনতে কি চাও এখনো দেখা হলো না হলে গিয়ে। ভুড়ি বাড়ছ, সময় যাচ্ছে, আমার দিন গুলো শুধু হারিয়ে যাচ্ছে!
তবু কেমন যেন টানে শহরটা !
হুমম!
ঢাকা একটা নেশা!
ফ্ল্যাশ মব আর টি টুয়েন্টি নিয়া লেখা প্রতিটা লাইনে পাঁচ তারা।
দুনিয়াটাই দিনকে দিন ফরম্যাট মারা ব্ল্যাংক মেমোরি কার্ড মার্কা পানসা হৈয়া যাইতাছে, এই জমানায় বোরিং থাকাই ভালো।
যেমন আছেন, ভালো থাকেন।
দোয়া নিও এন্ড দোয়া কইরো!
মফস্বঃলে বসে দেখি কত কি জানি কিন্তু পাই না। কিন্তু ঢাকায় সবই পাই। গত সাত বছর ঢাকার বাইরে। এই সাত বছরে বইমেলায় যাই নি। বই পেয়েছি রকমারি অথবা অন্য কারো/ কোন মাধ্যমে। কিন্তু বইমেলা সেতো প্রানে টান। বানিজ্য মেলা, রমনা বটমূল বড় কাদায়।
আহারে আপু!
এই ঘিঞ্জি শহরটাকে আমি খুব ভালোবাসি।
আমিও মানিয়ে নিয়েছি এই শহরটাকে!
সেই ছেলেবেলায় গ্রামের মায়া কাটিয়ে পা রেখেছি এই শহরে, ধীরে ধীরে আপন করে নিয়েছি এখানকার সবকিছু। এখন আর ঢাকাকে ছেড়ে থাকা সম্ভব না।
ভাল লাগলো লেখা।
থ্যাঙ্কস ভাইয়া!
লেখা মজা লাগছে পড়তে বিশেষ করে ফ্ল্যাশমব অংশটুকু।
হাইওয়ে দেখছো? ভাল আছে
দেখছি তো সেই কবেই, মোটামুটি লাগছে! তবে আলিয়া ভাটরে মনে ধরছে
আপনার বই আর সিনেমা বিষয়ক লেখাগুলো পড়ে কিছু না কিছু নতুন বই সিনেমার খোঁজ পাই। অনেকদিন পর এসেও পেলাম।
প্রিয় লেখকদের মুখে প্রশংসা শুনতে মেলা শান্তি পাওয়া যায়।
কেমন আছেন ভাইয়া?
মন্তব্য করুন