ইউজার লগইন

কুয়াশা, মেঘ, পাহাড় ছুঁয়ে আসার ধোঁয়াশা গল্প

১.
চাঁদের গাড়ীটা যেখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে পথ ওখানেই শেষ। এর পরে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটাপথ মাইল খানেক। মাইল খানেকই হবার কথা। ম্যাপ তাই বলছে। শীতের বিকেলে রোদ বেশীক্ষণ থাকে না। রোদ থাকতে পৌঁছে যেতে হবে। নইলে পথ হারাবার সম্ভাবনা।
.
বাতাসে বুনো একটা মিষ্টি গন্ধ। অসংখ্য পাখির বিচিত্র কিচিরমিচির শব্দে কান ঝালাপালা হবার যোগাড়। খিদে তেষ্টা দুটোই আকড়ে ধরেছিল দীর্ঘ লক্কর ধক্কর যাত্রায়। কিন্তু এই পাহাড়ী বুনো পথে নামার পর কোথাও উধাও হয়ে গেল সব খিদে ক্লান্তি। এই জায়গাটা কত উঁচু এতক্ষন খেয়াল করা হয়নি। নীচের পাহাড়ের উপর ভেসে থাকা ধোঁয়াগুলো যে আসলে মেঘ তা বুঝতে পেরে চমকে উঠি। ওরা ঠিকই বলেছিল। এখান থেকে মেঘ ছোঁয়া যায়। কিন্তু শীতকালে মেঘ অত নীচে নামে?
.
পথটা ঢালু বলে দৌড়ে দৌড়ে নামছি প্রায়। কিন্তু দৌড়াতে গিয়ে ম্যাপে চোখ রাখা হচ্ছে না। পথ হারিয়ে ফেললে রাতে কি হবে? এই অঞ্চলে কোন লোক বসতি নেই। অন্তত কয়েক বর্গমাইল নিথর পাহাড় সারি। সেই কুটিরটা খুঁজে না পেলে জঙ্গলের জীব জন্তুদের সাথেই রাতটা কাটাতে হবে। শহরের ফুটপাতে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা থাকলেও এখানে তা কাজে আসবে না। চেনা শহরের ফুটপাত আর অচেনা পাহাড়ের জঙ্গল এক নয়। এখানে বুনো জন্তুর চেয়েও ভয়ংকর হলো মশা। যদিও এই মশাগুলোর ব্যবস্থা করার জন্য অডোমস ক্রীম আছে সাথে। শহুরে মশা ধারে কাছেও ঘেঁষেনা এটা গায়ে মাখলে। বুনো মশার জন্য কতোখানি কাবিল তা প্রমান করতে অপেক্ষা করতে হবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সবকিছু ঠিক থাকলে আধাঘন্টার মধ্যে খুঁজে পাবার কথা কুড়ে ঘরটা।
.
এটা একটা নিয়মিত হাঁটা পথ ছিল এককালে। ঝোপঝাড়গুলো দেখে বোঝা যায়। ঘাসের চাপড়াগুলোর সাইজ দেখে মনে হয় খুব বেশীদিন না, হয়তো বছরখানেক আগেও নিয়মিত যাতায়াত ছিল এই পথে। উপজাতি গ্রামগুলো এখান থেকে আরো গভীরে। এদিকে রাস্তাটা ঢাল বেয়ে নেমে গিয়ে কিছুদুরে খাড়া পর্বত উঠে গেছে। ওটার উল্টো দিকেই শংখ নদী বয়ে গেছে।
.
২.
অভীকদের দলটা ছিল ট্রেকার, আমার মতো অবকাশবিলাসী কেউ না। ট্রেকিং শেষে ফেরত আসার পথেই সেই নির্জন কুটিরের দেখা পায়। একটা গা ছমছমে রহস্যময় রাত কাটায় ওরা দলবেধে। রহস্যময় মানে ভয়ের কিছু ছিল না বরং সেই রাতটার বর্ণনায় কেমন একটা রহস্যময়তার গন্ধ ছিল। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যদি সুযোগ পাই অন্ততঃ একটা সপ্তাহ ওই কুটিরের নির্জনতায় কাটাতে হবে। ওদের কাছ থেকে পথের একটা ম্যাপ যোগাড় করে রেখেছিলাম তখন। আজকে সুযোগ পেয়েই বেরিয়ে পড়েছি। কেউ জানে না আমি এখানে আসবো। যোগাযোগ করার সমস্ত যন্ত্রপাতি রেখে এসেছি বাসায়। ক্যানভাসের ব্যাগে কটা কাপড়চোপড়, শুকনো কিছু খাবার, টুকটাক জঙ্গলে দরকার কিছু জিনিসপত্র আর একটা ডায়েরী ছাড়া আর কিছু নেই।
.
পাখির ডাকগুলো আস্তে আস্তে কেমন ঝিমিয়ে পড়ছে। যতই এগোচ্ছি জঙ্গল যেন ঘন হচ্ছে। ব্যাগের পকেট থেকে ছোট চাকুটা বের করতে হলো। ঝোপ ছেটে ছেটে এগোতে হচ্ছে এবার। ঠিক পথেই তো এগোচ্ছি মনে হয়। সূর্যের বিপরীতে হাঁটলে ডানদিকে নীলচে পাহাড়টা আর বামদিকে নদীর বাঁকটা দেখা যাবে। সব ঠিকই আছে মনে হচ্ছে। কিন্তু সোজা এগোনো যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে জঙ্গল এতটা ঘন যে চাকুটা কাজে আসছে না। ঘুরে পথ পেরোতে হচ্ছে। শিমুল গাছ নাকি এটা? সারা গায়ে কাটা কাটা? ওটার নীচে এসে দম নিতে থামলাম।
.
তখনই মনে হলো কি চরম বোকামী করতে যাচ্ছিলাম। ওরা যে পথে এসেছিল সেই পথে তো ঝোপঝাড় কাটা থাকার কথা। কিন্তু এই পথে সব আদিম জঙ্গল। ভুল হয়ে গেছে। ওরা এই পথে যায় নি। এত্ত বড় একটা গাছের বর্ণনা এড়িয়ে যাবার কথা নয়। এই সহজ কথাটা প্রথমেই মাথায় এলো না কেন? আবার উল্টো পথ ধরলাম। এটা কঠিন হয়ে গেল। ঢাল বেয়ে নামা যত সহজ ছিল, ওঠা তারচেয়ে দশগুন কঠিন। নামতে আধাঘন্টা লেগেছিল, উঠতে এক ঘন্টার কম না।
.
সূর্য দ্রুত নেমে যাচ্ছে। যেখানে একটু আগেও রোদ, এখন সেখানে ধোঁয়াটে ছায়া। দূরে নদীর ওপাশের উপত্যকায় কোথাও চুলোয় আগুন দিয়েছে কোন পাহাড়ী গিন্নী। তারই ধোঁয়াগুলো ভাসছে মেঘের মতো। কুয়াশা এসে ঘিরে ধরছে চারপাশ। এসব কি কুয়াশা? নাকি মেঘ? আমি কি মেঘ ছুঁয়ে উঠছি? দ্রুত উপরে ওঠার চেষ্টা করলাম। খিদেটা আবার মোচড় দিল। কিন্তু বসে খেয়ে নেবো উপায় নেই। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
.
৩.
হাচড়ে পাচড়ে অবশেষে যেখান দিয়ে নেমেছিলাম সেই জায়গায় পৌঁছালাম, তারপর ধপাস করে ঘাসের উপর বসে পড়লাম। গলা শুকিয়ে কাঠ। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে ঢকঢক করে পানি খেলাম। সূর্যটা নেমে গেছে। পুরো উপত্যকা জুড়ে ছায়ার মেলা। এই পাহাড়ের ছায়া ওই পাহাড়ে, ওই পাহাড়ের ছায়া তারো পরে। মাঝে মাঝে ছোপ ছোপ মেঘ বা কুয়াশা মাকড়সার জালের মতো ঝুলে আছে এখানে সেখানে। প্রচন্ড শীতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে হাতের তালুতে কিন্তু শরীরের ভেতরটা জ্বলছে বলে চামড়ায় হুল ফুটিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারছে না শীত।
.
বিস্কুট আর পানি দিয়ে খিদেটাকে একটু চাপা দিলাম। চিড়ে আর গুড় আছে ব্যাগে। ওগুলো রাতে খাওয়া যাবে। এখন বরং কুটিরে পৌঁছার সূচনা পথটা খুঁজে বের করি। কিন্তু এই সময়ে পথ খুঁজতে বেরুনো কি ঠিক হবে? আলো নিভে আসছে। অন্ধকার জঙ্গলে বাঘভালুক না থাক, সাপখোপ থাকতে পারে। নাহ, তার চেয়ে এখানেই রাতটা পার করি। কয়েক হাত সামনে মোটা গুড়ির একটা গাছ। ওটার সামনে আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। গাছটার দুটো শেকড় দুপাশে ছড়িয়ে মাঝে একটা খোপের মতো আসন সৃষ্টি করেছে। ওখানে লতাপাতা বিছিয়ে বসে পড়তে পারলেই সাক্ষাত বমজন হয়ে যেতে পারি একরাতের জন্য। বোধি বৃক্ষ হিসেবে অশ্বত্থের খ্যাতি প্রাচীনকাল থেকেই। এটা আসলে অশ্বত্থ তো? গাছটায় হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসলাম। এই আশ্রয়টা পেয়ে নিশ্চিন্ত লাগছে একটু।
.
৪.
আশ্রয়। অদ্ভুত একটা শব্দ। মানুষের জীবনটা অন্য প্রাণী থেকে একটা কারণে আলাদা। সেটা হলো আশ্রয়। মানুষের সব থাকলেও আশ্রয় না হলে চলে না। প্রত্যেক সুস্থ মানুষের দুটো করে আশ্রয় লাগে। একটা শারীরিক আশ্রয়, আরেকটা মানসিক। বেশীরভাগ মানুষ শরীরের জন্য আশ্রয় খুজে পায়, মনের আশ্রয়ের সন্ধানে সারাজীবন হন্যে হয়ে ঘুরে। তখন সে নিজেই জানে না সে কি খুজছে। ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে লাইটারে আগুন দিলাম। আয়েশে চোখ বুজে এল প্রায়। আহ পর্বতের নির্জনে অবশেষে।
.
কোথা থেকে যেন একটা আলো আসছে। মৃদু আঁচের আলোটা নেচে নেচে হাঁটছে। কে ওখানে? কেউ হাতে করে এক টুকরো আলো নিয়ে জঙ্গলের ঘন অন্ধকারে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কেমন একটা নেশা জাগালো আলোর ছন্দটা। আলোটার উৎস খুঁজতে খুঁজতে আরো গভীরে চলে গেলাম। কিন্তু আলোটা যেন লুকোচুরি শুরু করেছে। আমি যতই কাছে যাচ্ছি আলোটা ততই দুরে চলে যাচ্ছে। আলোটাকে আমার ছুঁতেই হবে এরকম একটা অনিবার্য নেশায় পেয়ে বসেছে।
.
জঙ্গলের লতাপাতা এড়িয়ে ছুটছি এলোপাথাড়ি। ঢালুতে পা পিছলে পড়ে যেতে গিয়ে একটা গাছের ডাল ধরে কোনমতে সামলে নিলাম। আলোটাও এখন স্থির। ডিমের কুসুমের মতো মসৃন আভার একটা আলো। কেবল নিজেকে আলোকিত করে রেখেছে। সাপের মনি টনি নয়তো? ভয় লাগলেও নেশা ছুটলো না। আবারো ছুটতে গেলে কোথা থেকে চিকন তারের একটা পিন এসে তীরের মতো গলায় আমুল ঢুকে গেল। বিষাক্ত তীর। ব্যথায় এবং মৃত্যুযন্ত্রনায় চীৎকার করে উঠি।
.
৫.
নাহ মরিনি। লেখাটা ব্লগে দেবার জন্য বেঁচে আছি। জেগে উঠে টের পেলাম ওটা ছিল সেরিব্রাল ম্যালেরিয়াবাহী হুলডোজার মসকুইটো।
.
রাতে আর কোন বিপদ হয়নি। আশেপাশে প্রচন্ড ভনভন করলেও অডোমাসের কল্যানে হুলডোজার তীর বর্শা ছোড়েনি। বোতলের পানি দিয়ে চিড়ে ভিজিয়ে গুড় দিয়ে রাতের ডিনার সেরে নিয়েছি। চায়ের বদলে কফিক্যান্ডি দিয়ে মুখের তিয়াস মিটিয়েছি। প্রচন্ড কুয়াশায় ভিজে যাবার দশা। ভাগ্যিস টাফেটা কাপড়ের একটা আউটওয়্যার ছিল, তা দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে নিয়েছিলাম। মাথায় চওড়া কার্নিশের ক্যাপটা খুব কাজে দিয়েছিল। তবে শীতের তীব্রতা টের পেয়েছে নাক আর চোখদুটো। ওগুলো ঢাকতে পারিনি কিছু দিয়ে।
.
রাতের পরিবেশটা আমার মতো লোকের জন্য বর্ণনাতীত। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস্য মনে হবে না। বিচিত্র শব্দগুলো ৩ ডি সাউন্ডের মতো মাথার চারপাশে বনবন করতে থাকে। খানিকক্ষণ শোনার পর ছন্দটা বোঝা যায়। হাজার লক্ষ পোকামাকড়ের আজব শব্দের তানে এমন একটা উল্লাস সৃষ্টি হয় যা পৃথিবীর মধুরতম সঙ্গীতকেও হার মানাবে। মুগ্ধ হয়ে সেই শব্দের মাঝে হারিয়ে যাই। ভয়, বিস্ময়, রহস্য এই ব্যাপারগুলোর একটা অদ্ভুত সমাহার ওই শব্দের গুঞ্জরনের মধ্যে খুজে পাওয়া যায়। প্রতিটি শব্দ আলাদা করে বোঝা যায়। ওরা নিজেদের মধ্যে কেমন একটা ঐক্যতান সৃষ্টি করে নিয়েছে।
.
৬.
ভোরে ঘুম ভাঙলে নিজেকে মেঘের রাজ্যে আবিষ্কার করি। আমি আর আমার আশ্রয়দাতা গাছ বাদে বাকী জগত অন্ধকার। না ঠিক অন্ধকার নয়। আলোর আভা আছে। এই আলোটা কেবল পাচ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত। তার বাইরে কোন জগতের অস্তিত্ব নেই। তবে এই জগতে আমি ছাড়াও আরো কিছু প্রাণি আছে। রাতের পোকামাকড়ের শব্দগুলো বদলে গিয়ে নানা জাতের হাজারো পাখপাখালীর শব্দ ভেসে আসছে অদৃশ্য কোন স্থান থেকে। ওরা আমকে দেখছে না, আমি ওদের দেখছি না। চারদিক কেবল সাদা সাদা সাদাময় জগত। নেই কেবল ছায়া। আমার ছায়া নেই আশ্রয়দাতা গাছের ছায়া নেই, ভুতরাজ্যের বাসিন্দা হয়ে হঠাৎ এক বিজাতীয় উল্লাসে চিৎকার করে উঠি। যে নির্জন একাকীত্বের বাসনায় এই পর্বতে আসা যেন সেটার সন্ধান পেয়ে গেছি।
.
পেছনে সরসর শব্দ শুনে গাছটির উল্টোপিঠে তাকাতেই দেখি গলায় লালের আভা নিয়ে একটা সবুজ গিরিগিটি আমার কাছ থেকে একফুট দুরে নিষ্পলক চেয়ে আছে। ছেলেবেলায় এই নিস্পলক চাউনিকে এত ভয় পেতাম যে গিরিগিটি দেখামাত্র গুলতির আদেশ ছিল। গলার ওই লাল রং নাকি মানুষের রক্ত থেকে আসে। গিরিগিটি চোখ নিয়ে মানুষের রক্ত গিলে খায় দুর থেকে এরকম একটা কঠিন বিশ্বাসে বহুকাল আবদ্ধ ছিলাম। আজ সেই রক্তচোষা গিরিগিটিকে এই অরণ্যে একমাত্র বন্ধুর মতো মনে হলো। পৃথিবীতে আমি আর গিরিগিটি বাদে আর কেউ নেই। সে তো এই অরন্যের নাগরিক আমি নিতান্তই ইমিগ্রান্ট।
.
বললাম, বন্ধু নেবে আমাকে তোমার সাথে? আমার কথা শুনেই যেন লজ্জিত গিরিগিটি সুরুত করে লাফ দিয়ে নেমে গেল গাছ থেকে। জগতে আবারো আমি একা। তখনই গাছের কান্ডে ছুরি দিয়ে কাটা দাগগুলো দেখতে পেলাম। কাছে গিয়ে দেখি ওগুলো দাগ নয়। ওটায় লেখা আছে AVIK.
.
৭.
তার মানে অভীকদের দলটা এদিকেই গিয়েছিল। গন্তব্যের খুব বেশী দুরে নেই ভেবে আনন্দে আরেকটা লাফ দিলাম। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে মেঘগুলো সরে গিয়ে সমস্ত উপত্যকাটা উন্মুক্ত হলো। সূর্যের দেখা নেই এখনো। চায়ের তেষ্টা পেয়েছে ভীষণ। ওই কুটিরে একটা স্টোভ কিংবা চুলো থাকার কথা। সাথে টিব্যাগ আর কফিপ্যাক আছে। চা কফি বানিয়ে আয়েশ করে খাওয়া যাবে।
.
পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে যাত্রা শুরু হলো। এবারে খুব বেশী খুঁজতে হলো না। ঠিক রাস্তায় এগিয়েছি। আধঘন্টা হেঁটেই পৌঁছে গেলাম সেই কুটিরে। ছোটখাট একটা বেড়ার ঘর। বাঁশের মাচার উপর বানানো। যেখানে পাহাড়টা ঝুপ করে নেমে গেছে অনেক গভীর খানে তার কিনারায় দুটো গাছের গুড়ির সাথে দড়ি দিয়ে আটকানো একটা ঝুলন্ত বারান্দার মতো ঘর। উপরেও বেড়ার ছাউনি। দরোজা বলে কোন বস্তু নেই। যে ফোকর দিয়ে কুটিরে প্রবেশ করতে হয় ওটা কেবলই একটা বাঁশের ফোকর। ঘরের এককোনে দুটো চাটাই। আরেক কোনায় সত্যি সত্যি একটা কেরোসিন স্টোভ।
.
কেউ কি থাকে এখানে? এই স্টোভ রাখলো কে? চাটাই আর স্টোভ ছাড়া আর কোন আসবাব নেই। যেদিকে শংখ নদী বয়ে গেছে অনেক নীচ দিয়ে সেই দিকটাতে আগাগোড়া বেড়ার চৌকোনো ফোকড়। চাইলে শুয়ে শুয়েও উপত্যকার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। কেবল একটা জিনিস অস্বস্তি লাগে, পায়ের নীচের বেড়ার মচমচ শব্দ। পর্বতের এই নির্জনতার গাম্ভীর্যকে একটু ক্ষুন্ন করছে এই শব্দ। নিথর নির্জন এলাকা বলেই ছোট্ট শব্দকেও বহুদুর বয়ে নিয়ে যায় বাতাস।
.
আপাততঃ নিরুপদ্রপ কয়েকটা দিন। খাবারদাবারে সমস্যা হবে বলে ইনস্ট্যান্ট খিচুড়ীর কয়েকটা প্যাকেটের সাথে, আচার, সস, বাদাম, টোষ্ট, পনির ইত্যাদি খিদে নষ্টকারক শুকনো খাবার এনেছি ব্যাগে করে। কেবল পানিটা সমস্যা হতে পারে। কিন্তু মাইলখানেকের মধ্যেই শংখ নদীটা। দুই লিটারের বোতলে করে দৈনিক একবার আনলেই হবে। আসার পথে বুনো জাম্বুরা আর পেপে গাছে ঝুলন্ত ভক্ষনযোগ্য ফল দেখা গেছে। কলাগাছের সন্ধান করেছিলাম, এখনো চোখে পড়েনি।
.
সারাদিন এখানে সেখানে আনাড়ী ট্রেকিং করে মতো কাটালাম। সন্ধ্যার পরপর কুটিরে ঢুকে গেলাম। খিচুড়ি রান্না করলাম। খেয়েদেয়ে আর সময় কাটে না। আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করছে না। যদিও মোম আছে। তারচেয়ে এই ঘরে জোনাকিটা ঢুকে আলো করে দিক। ‘গ্রেভ অব ফায়ারফ্লাইস’ ছবিটাতে ছো্ট্ট মেয়েটি লুকোনো বাংকারে মশারির ভেতর জোনাকীর আলো মেখে ঘুমিয়েছিল। দৃশ্যটা আমি ভুলতে পারি না। কিন্তু এখানে জোনাকীরা ঘরে আসছে না। অদুরে অন্ধকার জঙ্গলে লক্ষকোটি তারকার মতো জ্বলছে।
.
ক্লান্তিতে ঘুম এসে গিয়েছিল কখন। মাঝরাতে মচমচ শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভুমিকম্প হচ্ছে পাহাড়ে? এত নড়ছে কেন কুঁড়েটা? ভেঙ্গে পড়ে যাবে নাতো? কুঁড়ের চালের উপর যেন গজব নেমেছে।
.
.
[সময় পেলে চলতে পারে........]

পোস্টটি ১৬ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

টুটুল's picture


আল্লাহ আপনার হাতে অফুরন্ত সময় দেউক...

নীড় সন্ধানী's picture


আল্লাহ সময় দিছে, কিন্তু বান্দার জারিজুরিতে সময় শেষ

হাসান রায়হান's picture


ফাটাফাটি গুরু ফাটাফাটি! আমিতো ক্যামেরা নিয়ে চলে গিয়েছিলাম Smile

নীড় সন্ধানী's picture


আপনি হলেন সমঝদার মানুষ। এরপর গেলে একবার ফোন দিয়েন Smile

সাঈদ's picture


ফাটাফাটি বস , পপকর্ন নিয়া বসলাম ।

নীড় সন্ধানী's picture


পপকর্ণ নিয়া বসলে হবে না। চাঁদের গাড়ীতে উঠে বসেন Cool

নাজমুল হুদা's picture


এত সুন্দর বর্ণনা, আর এত সাবলীল ও আকর্ষণীয় ! আরও লিখবার সময় হোক অফুরন্ত, দোয়া করি সর্বান্তকরণে ।

নীড় সন্ধানী's picture


মুরব্বী, আপনার মন্তব্য এবং দোয়া মাথায় করে রাখলাম। Smile

নাজমুল হুদা's picture


মুরব্বী ? কেমন যেন মোরব্বা, মোরব্বা শুনায় ? শব্দটি অবশ্যই যুৎসই, তবু আমার পছন্দের নয় ।

১০

নীড় সন্ধানী's picture


হুদা ভাই, আপনার অপছন্দের মোরব্বা তুলে নিলাম। ভাইতে আপত্তি নাই তো?

১১

নাজমুল হুদা's picture


মোটেই না ।

১২

বকলম's picture


মনে হইতেছিল কোন ক্লাসিক বই পড়তে ছিলাম। আপনার লেখার পাংখা হইলাম নীড়দা।

৪ নং এ

আবারো ছুটতে গেলে কোথা থেকে চিকন তারের একটা পিন এসে তীরের মতো গলায় আমুল ঢুকে গেল। বিষাক্ত তীর। ব্যথায় এবং মৃত্যুযন্ত্রনায় চীৎকার করে উঠি।

পইড়াতো রীতিমত ঘাড়ের লোম খাড়া হইয়া গেছিল। মনে হইছিল পাহাড়ী কোন বুনো মানুষদের ছোড়া তীর নয়তো?! সকালে উইঠা দেখলেন আপনারে হাতে পায়ে বান দিয়া মাঝখানে বাঁশদিয়া কাপড় শুকানির মত ঝুলাইয়া রাখছে। Tongue Devil

১৩

নীড় সন্ধানী's picture


রীতিমত বিব্রত হইলাম এত প্রশংসা পেয়ে Tongue

১৪

সাহাদাত উদরাজী's picture


চালিয়ে যান।

১৫

নীড় সন্ধানী's picture


চালাবার মতো ক্যালরি সংগ্রহ করছি Glasses

১৬

মেসবাহ য়াযাদ's picture


ভ্রমনের এত অসাধারন বর্ণনা আমার আর পড়া হয়নি অতীত জীবনে...
ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক...
সমাজ আপনাকে অঢেল সময় দিক...
আমরা কিছু অমর সৃষ্টি পাই...
নাহ, যত দ্রুত সম্ভব আপনার সাথে বসে একাধিক চাপ চা
আর কয়েকটা বিড়ি না খেলেই নয়...

১৭

নীড় সন্ধানী's picture


আপনার পাহাড় কেনাটা হয়ে গেলে, সেখানে বসে অসংখ্যকাপ চা আর বিড়ি খেতাম Smile

১৮

মেসবাহ য়াযাদ's picture


পাহাড় কেনাটা হয়ে গেলে মানে কী ?
আপনাকে না বলেছি, পাহাড় কেনা হয়েছে। বাউন্ডারি দিয়েছি। পানির কূয়া করা হয়েছে। ২ টা ইলেকট্রিক পিলার সরানো হবে সহসাই... এবং আশা করছি ফেব্রুয়ারিতে রিসোর্ট বানানো শুরু করবো। আরও আশা করছি, নভেম্বর/ডিসেম্বরে সে রিসোর্টে গিয়ে চা খেতে পারবো... Big smile

১৯

সাঈদ's picture


দাদা , আমাকে নিয়ে যায়েন, পাহাড়ের ছবি তুলে দিবো ।

২০

হাসান রায়হান's picture


তুমিনা ২দিন আগে ঘুরে আসলা? Angry

২১

সাঈদ's picture


সেটাতো মেসবাহ ভাইয়ের পাহাড় ছিল না ।

২২

নীড় সন্ধানী's picture


রিসোর্ট তৈরী হয়ে গেলে একটা ঘোষনা দিয়েন। প্রথম পাঁচ দম্পতির হানিমুন ফ্রী। Tongue

২৩

নাজমুল হুদা's picture


কেমন পাহাড়; জোড় না বেজোড় ? সে পাহাড়ের উপত্যকা আছে ? গিরিপথ ? ঝরনা ? সাগরতীর ? সাগরতীরে নবীন দূর্বাদল ? সেই পাহাড়ী রিসোর্টে শুধু চা ? নাকি ধুমপানের বন্দোবস্ত থাকবে ? আর কি আছে বা থাকবে আমরা জানতে পাবো না ?

২৪

সকাল's picture


সহজ ভাষায় সাবলীল বর্ণনা পাঠে আটকে রাখে মুগ্ধতায়।

২৫

নীড় সন্ধানী's picture


আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সকাল।

২৬

শওকত মাসুম's picture


অসাধারণ। অসাধারণ।

২৭

নীড় সন্ধানী's picture


একক্ষেত ধন্যাপাতা Smile

২৮

তানবীরা's picture


কিশোরী বেলায় যেমন বুদ্ধদেব গুহের মধ্যে হারিয়ে যেতাম, ঠিক সেভাবে হারিয়েছি আবার। একবার পড়েছি আবার কয়েকবার পড়ব। অসাধারন বর্ননা নীড়দা। অসাধারন।

আপনার সিরিজ খেলাপী হওয়ার অভ্যাস আছে। প্রত্যেকবার এমন ঝাকি দিয়েই শুরু করেন তারপর মাঝ রাস্তায় এনে আমাদের ডুবিয়ে দেন।

আমার সারাজীবন আফসোস থাকবে, আমি কেনো এমন বর্ননা সমৃদ্ধ লেখা লিখতে পারি না?

একবার মাত্র লাইক দেয়ার সুযোগে ব্যথিত, মিনিমাম পাঁচবার লাইক হতে হয় এমন লেখা। প্রিয়তে রাখলাম।

২৯

নীড় সন্ধানী's picture


তাহলে তো মডুরে কইতে হয় একাধিক লাইকবাটন দিতে। কিন্তু সাথে ডিসলাইক বাটনও দিতে হবে। ভাগ্যিস ওটা ছিল না Laughing out loud

৩০

জ্যোতি's picture


অসাধারণ একটা লেখা পড়লাম।সুপার্ব।দুর্দান্ত।কেন নীড়দা লিখেন না নিয়মিত!

৩১

নীড় সন্ধানী's picture


এত ভাল কইয়েন না, মুখ লাগবে। পরের পর্বের শব্দগুলা আকাশে উড়াল দিতাছে Tongue

৩২

মীর's picture


আশ্রয়। অদ্ভুত একটা শব্দ। মানুষের জীবনটা অন্য প্রাণী থেকে একটা কারণে আলাদা। সেটা হলো আশ্রয়। মানুষের সব থাকলেও আশ্রয় না হলে চলে না। প্রত্যেক সুস্থ মানুষের দুটো করে আশ্রয় লাগে। একটা শারীরিক আশ্রয়, আরেকটা মানসিক। বেশীরভাগ মানুষ শরীরের জন্য আশ্রয় খুজে পায়, মনের আশ্রয়ের সন্ধানে সারাজীবন হন্যে হয়ে ঘুরে। তখন সে নিজেই জানে না সে কি খুজছে। ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে লাইটারে আগুন দিলাম। আয়েশে চোখ বুজে এল প্রায়। আহ পর্বতের নির্জনে অবশেষে।

দাদা, বেশি কিছু না বলে এরপরের পর্বের জন্য অপেক্ষা শুরু করে দিলাম।

৩৩

নীড় সন্ধানী's picture


হ এইটাই ভাল। মাস খানেকের মধ্যে পরের পর্ব চেষ্টা চলবে। Smile

৩৪

বাফড়া's picture


বস... এই আপনে কি করলেন... চমতকার, উমদা.. মার ইচছা করতাছে আপনের এইটারে নিয়া "ক্রিটিকাল কম এপ্রিসিয়েশন বেশী" একটা পোসট ই লিইখা ফেলি ..। নিজের মইঢ্যে আরেকটু বেশরমপনা যোগাড় কইরা ফেলতে পারলে লেইখা ফেলুম Smile

ফেবুতে শেয়ার ই মাইরা দিলাম.. লোকে পইড়া থান্ডারস্ট্রাক হোক Smile

আর আপনের "জয় হো" Smile

৩৫

নীড় সন্ধানী's picture


হা হা, আপনার মন্তব্য পড়ে খুব মজা পেলাম। ধন্যাপাতা Smile
ভাবি, যদি কখনো একটা লেখাও বাফড়ীয় কায়দায় লিখতে পারতাম..... Stare

৩৬

লীনা দিলরুবা's picture


কি অপূর্ব লেখা! শেষ লাইনের মোচড়তো অসাধারণ হয়েছে।
নেন Beer এইটা খেয়ে চাঙা হন আর পরের গল্প ছাড়েন।

৩৭

নীড় সন্ধানী's picture


এইটা কি দিলেন, সফট ড্রিংক নাকি? Steve

৩৮

জ্যোতি's picture


নীড়দা কই আপনে? পিলিজ লাগে, লেখাটা শেষ করেন জলজি।

৩৯

নীড় সন্ধানী's picture


রায়হান ভাইয়ের সাথে গিয়ে ঘুরে এসে বাকীটা শেষ করবো Cool

৪০

জ্যোতি's picture


Angry

৪১

নীড় সন্ধানী's picture


Laughing out loud Laughing out loud চেতেন কেন, রায়হান ভাই তো বললো ক্যামেরা নিয়ে গেছে। ধৈর্য ধরলে সচিত্র বর্ণনা আসবে।

৪২

হাসান রায়হান's picture


আমি তো আপনের গল্পের সাথে চলে গিয়েছিলাম। এখনতো আটকা পরে গেছি। আপনি এর পরের পর্ব না দিলে আমিতো নড়তে পারছিনা । Smile

৪৩

জ্যোতি's picture


ভালৈছে। এখন দুইজনেই আটকে বসে থাকেন। উদ্ধার করার জন্য ক্যাপ্টেন পাঠাতে হবে?

৪৪

মেসবাহ য়াযাদ's picture


ক্যাপ্টেন ?? Wink

৪৫

নীড় সন্ধানী's picture


ক্যাপ্টেন ববি? Cool

৪৬

জ্যোতি's picture


ক্যাপ্টেন ববি Laughing out loud

৪৭

মেসবাহ য়াযাদ's picture


তাইলে আর জঙ্গলে ঘোরা হৈবো না Wink
কামড়া কামড়ি লাগবো। নীড়ের মত নিরীহ মানুষের নির্ঘাত পরাজয় ঘটবে Tongue
আগাম সমবেদনা রইলো নীড়ের জন্য Big smile

৪৮

আবদুর রাজ্জাক শিপন's picture


লেখকের সঙ্গে চমৎকার একটা ঘুরান্তি হইয়া গেল !

নাগরিক যন্ত্রণা আর সবরকম যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিন্ন করে দুঃসাহসিক অভিযানে যাবার সাহস আপনার আছে !

বলতেই হবে,- 'আপনি পারলেন !'

৪৯

নীড় সন্ধানী's picture


আপনাকে আমন্ত্রন এডভেঞ্চার জগতে Smile

৫০

জেবীন's picture


নীড়'দা অসাধারন একটা লেখা পড়লাম, বর্ননা পড়তে পড়তে আটকে গিয়েছিলাম... দারুনের উপর দারুন আরকি... পুরা সিনেমা দেখলাম যেন Smile

সময় করে পরেরটুকু দিয়েন

৫১

নীড় সন্ধানী's picture


অনেক অনেক ধন্যবাদ। পরের পর্বেও সাথে থাকুন Smile

৫২

ঈশান মাহমুদ's picture


নীড় সন্ধানী, কুয়াশা-মেঘ ও পাহাড় আপনার সংগে যেন আমিও ছূঁয়ে এসেছি...।চমৎকার ভ্রমন কাহিনী...।

৫৩

ঈশান মাহমুদ's picture


নীড় সন্ধানী, কুয়াশা-মেঘ ও পাহাড় আপনার সংগে যেন আমিও ছূঁয়ে এসেছি...।চমৎকার ভ্রমন কাহিনী...।

৫৪

নীড় সন্ধানী's picture


ছুঁয়ে থাকুন। সাথে থাকুন আগামী পর্বেও Smile

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

নীড় সন্ধানী's picture

নিজের সম্পর্কে

ভুল ভূগোলে জন্ম নেয়া একজন অতৃপ্ত কিন্তু স্বঘোষিত সুখী মানুষ!