ইউজার লগইন

আমার ঘরের অর্থনৈতিক গল্প

জন্মেছি তো অনেক অনেক বছর আগে প্রায় ৩৫ -৪০ বছর হতে চলল। দাদা ছিলেন জাত চাষা। তার ভাই বেরাদার পাড়া প্রতিবেশি সবাই চাষা। কোন স্কুল ছিল না ঐ ইউনিয়ন এ। চার দিকে মেঘনা র থৈ থৈ পানি। বর্ষায় চলার একমাত্র বাহন নৌকা বা সাতার। এই পাড়া ঐ পাড়া যাও তো হয় নৌকা ছাড় ঘাট থেকে না হয় এক সাতারে ঐ পার চলে যাও। সবার ই পেশা কৃষি। গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু। এটা কোন উপন্যাসের গল্প নয়। সুদূর কোন অতীত ইতিহাস নয়। এটা আমার গল্প, আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির গল্প। কোন নারী ব্লাউজ পড়তো না। ঘরে কখনও দরজা লাগিয়ে ঘুমাতো না কেউ। প্রত্যেকের কানে কান পাশা বা বালি, হাতে সোনা রুপার চুরি, গলায় রুপার হাঁসুলি বা সোনার মাদুলি, হাতে বাজু বন্ধ। ঈদে যখন বাড়ি যেতাম দাদীর এই সব গয়না পরে আমরা ও ঘুরতে বের হয়ে যেতাম। কেউ কখন ও ভাবে নি যে চুরি হয়ে যাবে, বা কেউ ছিনিয়ে নিবে। কোরবানি ঈদে করবানির মাংস বিতরণের জন্য গরিব পাওয়া যেত না। এই এলাকার মানুষ লবণ ছাড়া কিছু কিনে খেত খুব ই কম। তাই বাজার ও খুব বেশি গড়ে উঠেনি। এতো বড় ইউনিয়নে দুইটা মাত্র ছোট আড়ং বসত। দূর দুরন্ত থেকে ফকির আসতো ভিক্ষার জন্য। এলাকায় ফকির ছিল না। এই নদীর জলে আর পললে বেড়ে উঠা মানুষ গুলো ও মাঝে মাঝে নদী পার হয়ে শহরে যায়। শিক্ষার আলো পায় ২ ইউনিয়ন হেঁটে পার হয়ে। পুরা ইউনিয়নে হাতে গুনা কিছু মানুষ চাকরী করে। এলাকায় একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়। একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও হয়। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা আরেকটু ভালো হয় যখন তারা বুঝতে শিখে আদের উদ্বৃত্ত ফলন চাইলে ই বাইরে বিক্রি করতে পারে। তারা ব্যবসায়ি হয়ে উঠে। আমার দাদা চাচাদের প্রজন্ম সেই প্রথম ব্যবসায়ি প্রজন্ম। কিন্তু কৃষি ই তাদের প্রধান সম্বল। ২ জন ছেলে হলে এক জন পড়াশুনা করলে আরেকজন কৃষি কাজের জন্য বাড়িতে ই রেখে দেয়। আমরা ধিরে ধিরে বড় হলাম। কৃষি শুধু ই বছরের খাবার দিতে পারে। ব্যবসাকে আরেকটু বেশি আঁকড়ে ধরতে হচ্ছে সবার ই। আরও সময় যায়, জমি থেকে বছরের খাবার আসে, কিন্তু পরের বছর খেত করার আর পয়সা উঠে আসে না। খেতি করার খরচ গিয়েছে বেড়ে। এই অবস্থায় ব্যবসা বা চাকরী দরকার হয়ে পরে ঘরে ঘরে। ক্যাশ টাকার অভাবে মানুষ এখন আর ক্ষেতি করার সাহস পায় না। কিন্তু এই মাটি ই তাদের জীবন। এটা ছেড়ে ও দিতে পারে না। খেত করার পয়সা জোগান, বাচ্চাদের পড়াশুনা খরচ চালানোর জন্য হলে ও ক্যাশ টাকা দরকার। কোন পারিবারের একজন কে পাঠায় চাকরিতে, কেউ যায় বিদেশ, কেউ বা শহরে এসে ফেরি করে, কেউ নদীতে মাছ ধরে শহরে নিয়ে বিক্রি করে। জাত কৃষক আজ কেউ মাঝি, কেউ জেলে, কেউ মুটে কেউ শ্রমিক বা কেউ জমি বিক্রি করে সৌদি বা মালয়শিয়া। কিছু মানুষ পড়াশুনা করে চাকরী। অথচ আমার বাবা যখন শহরে বাড়ি কিনার জন্য জায়গা দেখে আমার দাদা কে দেখাতে নিয়ে আসছে, তখন আমার দাদা নাক ছিটকে ব্লেছিল এই সব জংল দিয়ে কি করবি, এর চেয়ে গ্রামে কিছু জমি রাখলে লাভ আছে। দাদা বেঁচে নেই। তার জমিতে এখন মার্কেট করে ভাড়া হয়। প্লট করে বিক্রি হয়। সে বেঁচে থাকলে ও আত্মহত্যা করতো হয়তো। আমার বাবা র যেই ভাইটি কৃষি র জন্য বাড়ি থেকে গেল জমি দেখবে বলে তার পরিবারের সন্তানদের দুর্দশা ই সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে দেখা দিল। আমি আমার সেই ভাইদের ই দেখি গয়না বিক্রি করে, জমি বিক্রি করে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করতে। ।

যে সব নৌকা নদীতে ভাসছে, বা যেই সব গণকবরে কে বা কারা শুয়ে আছে আমরা জানি না, সেই সব অচেনাদের ভীড়ে আমি আমার ঘরের মানুষকে দেখি। আমার ভাই, বা চাচা কে দেখি। হয়তো খবর নিলে কাউকে না কাউকে আমি খুজে পাব যে আমার বাবা কে চাচা বা জ্যাঠা ডাকতো ।বা মামা ডাকতো। আমারে বুবু ডাকতো।।

পোস্টটি ৯ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

তানবীরা's picture


লেখাটি খুবই হৃদয়বিদারক .----- একটানে লিখে গিয়েছেন হয়তো, বানান ভুলগুলো পরে দেখে নিয়েন

আরাফাত শান্ত's picture


এই লেখাটা ভালো হইছে আপু!

মীর's picture


ওই সময়টা আমার অনেক প্রিয় এবং প্রায়ই আক্ষেপ করি ওই সময়টার জন্য।

উচ্ছল's picture


সহজ জীবনের চমৎকার বর্ণনা...... লেখা পড়ে কিছুক্ষনের জন্য মনটা উদাস হয়ে গেল.....

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.