টুটুল ভাই, লিনা আপু ও আহমদ মোস্তফা কামাল ভাই এর জেমকন সাহিত্য পুরস্কার ’১৩ লাভ। (পর্ব-২)
আমার লেখার প্রথম সমজদার হইলো আমার ক্লাসের বন্ধুরা। ছাত্র জীবনে যা লেখতাম তা কিছু বন্ধুর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন কমন ই-মেইলের কল্যাণে সাড়া দুনিয়াতে রুয়েটের সকল বন্ধু, বড় ও ছোট ভাইয়েরা ছাড়াও আরও কয়েকটি গ্রুপ মেইল ও ব্লগের বন্ধুরা পড়ে।আমি বাহরাইনে অবস্থান কালীন কিছু লেখা ইংরেজীতে লিখি। তার কারন দুটি, প্রথমত তখন সেখানে কি বোর্ডে বাংলা ফন্ট না থাকা এবং আমি বাংলা টাইপে পারদর্শী না হওয়া, দ্বিতীয়ত ইউ এস নেভীর ভিতর আরবী ও ইংরেজী ছাড়া অন্য ভাষায় লেখা নিষিদ্ধ হওয়া। যদিও হিন্দি বাংলাসহ যে কোন ভাষায় কথা বলা যেত। আমার রুমমেট ও একই কম্পানির সহকর্মীদের মাধ্যমে কিছুটা পরিচিতি পেলে, আমার ইন্ডিয়ান, ফিলিপিনো, পাকিস্তানি, বাহরাইনই কলিগ ও কয়েকজন আমেরিকান বন্ধু আমার লেখা পড়ত। আর লেখায় উৎসাহ দেবার জন্য ছিল বাংলাদেশ স্কুলের সন্মানিত সভাপতি ও আল আহলী ব্যাংকে কর্মরত জনাব শাফখাত আনোয়ার, ভাবি আর আমার বাংগালী সহকর্মীরা। দুই তিনটা অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা আবৃতি করার পর একটা পরিচিতি চলে আসে। অন্য দেশের অবস্থা জানিনা তবে বাহরাইনে ১৬ই ডিসেম্বর, ২৬সে মার্চ, ২১ সে ফেব্রুয়ারী ঈদে মিলাদুন্নবী, শবে বরাত এই অনুষ্ঠান গুলো প্রায় সব সংগঠনেই করত। রাজনৈতিক বাদেও বিভিন্ন জেলা সংগঠক ছিল। এসব সংগঠন কোন অনুষ্ঠান করলে সব সংগঠনের সভাপতি,সহসভাপতি, সাধারন সম্পাদক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দাওয়াত দিত।
জনাব শাফখাত আনোয়ার, ম্যাডাম নাশিদ কামালের বন্ধু। ঊনার আমন্ত্রণেই ম্যাডাম নাশিদ কামাল, ম্যাডাম ফেরদৌসি রহমান বাহরাইনে আসেন। সে অনুষ্ঠানে ম্যাডাম নাশিদ কামাল বারটি ভাষায় গান গেয়েছিলেন, কারন বারটি দেশের রাষ্ট্র দুত সে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন। অনুষ্ঠানে ম্যাডাম ফেরদৌসী রহমান বেশী গান গাননি, কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। তবে নাশিদ কামাল কত গান গেয়েছিলেন তার হিসেব ছিল না। উনি যখন ক্লান্ত শ্রান্ত তখনও দর্শকরা অনুরুধ করছিলেন, আরও গান গাওয়ার জন্য।পরে জনাব শাফখাত আনোয়ার সাহেবের অনুরুধে দর্শকরা শান্ত হন। এমন একটা জমকালো প্রথম শ্রেনীর হোটেল আমি না প্রকৌশলী, না কোন সংগঠনের সহ সভাপতি হিসেব, আমার আমন্ত্রণ পত্রে লেখা ছিল, কবি ও লেখক জনাব আহসান হাবিব।
আর সেই কার্ডটি জনাব আনোয়ার নিজে আমার বাসায় দিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন আর কিছু না হউক এটা বুঝতে পেরেছিলাম, প্রকৌশলী হবার চেয়ে একজন লেখক হওয়া অনেক বেশী সন্মানের। তাই আজ লেখক হতে না পারার জন্য বড়ই আফসোস হয়।
আমি বাহরাইনে যখন ছিলাম আমার স্ত্রীর সরকারি চাকরির কারনে তাকে আমি নিয়ে যেতে পারিনি। দেশে আসার পর আমি প্রথম একা ঢাকায়, এখন ছেলে মেয়ে পড়াশুনার জন্য আমার সাথে থাকে। আমার লেখালেখির সময়টার বেশীর ভাগ কেটেছে মেরিট ব্যাচলর হিসেবে। তাই আমার লেখালেখির প্রধান উৎস বধূহীন বিরহে একা একা থাকা, এটা আমি বিশ্বাস না করলেও আমার এখনকার বন্ধুদের প্রায় সবারই কংক্রিট ধারনা। কিন্তু আমার টুনটুনি বা কাঠঠুকরা পক্ষি আমার জীবনে আসার আগেও আমি গল্প না লিখলেও কবিতা তো অনেক লিখেছি। আর সেসব কবিতার দুচারটা আমার টুনটুনির ভাল লেগেছিল এটাও আপনাদের বলতে পারি।
আমার লেখা পড়ে আমার সবচেয়ে ভদ্র ও শান্ত শিষ্ঠ ৪৫ বৎসর বয়সের বন্ধুটি যখন ২০-২৫ বছরের যুবক হয়ে যায় তখন আমার যারা জিগ্রী বন্ধু ওরা বলে, এখন ভাবি তো দুরে থাকে তাই এত রক্ত গরম করা কবিতা গল্প আওড়াচ্ছ। ভাবি আসুক, তখন দেখবোনে এই সাহিত্য টাহিত্য কোথায় থাকে? তাই গতকাল আহমদ মোস্তফা কামাল ভাইয়ের সুখবরের পাশাপাশি আমার টুনটুনি পাখির বদলির অর্ডারে এত খুশি হতে পারি নাই। আচ্ছা সত্যি সত্যি যদি আমার এ ব্লগর ব্লগর লেখা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এই যে প্রতিদিন শত শত বন্ধুর সাথে ভাল মন্দ ডাল ভাত খাওয়া হয় তার কি হবে। আজ একে অপরের সুখে সুখী অপরের দুঃখে দুখি, তখন হয়ত কেউ খুজবেও না। তরুণ প্রজন্ম ব্লগের নজরুল যে আমার লেখা পড়ে কিনা জানি না,নইলে পোস্ট করার এত অল্প সময়ে লাইক দেয় কি করে। আমি কোন পন্থি আমি নিজেও ঠিক বুঝি না। যখন যা মনে আসে তাই লিখি বা করি। কিন্তু নজরুলের লেখা পড়ে ওকে একজন পরহেজগার মানুষই মনে হয়েছে, অথচ আমার গাওয়া গানের ভিডিওতে ওই প্রথম লাইক ও কমেন্টস করে।
আমার রুয়েটের বন্ধু মশিউর আমার সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। আমার অফিসের ৪টা বিল্ডিং এর পর ওর অফিস। তাই ওর সাথে যোগাযোগটা একটু বেশী। হেরে ফোন করলে হের প্রথম কথা এতদিন বহুত মজায় ছিলা এখন টের পাইবা। আমি কইলাম তুই একটা মেইল দিয়া দে সকলে জানুক। মামু (মশিউর) আমার মস্ত বড় একটা কোম্পানির জি,এম হেয় উল্টা আমারেই কইল তুই দে আমি ওর মধ্যে পিন ঢুকাব। কইলাম লেবু হালায় ফেঞ্চু মার্কা দাড়ি দিয়া বহুত গুতাইছে হেরে কি করুম। তুই অহন হের দাঁড়িতে মই চালায়া দে। এমন এক দুইডা ফাটাফাটি কবিতা ছাড় যাতে ওর আধা পাকা দাড়িতে যৌবন রস লাইগ্যা পুড়াই সফেদ অইয়া যায়।
তয় কথা যাই হউক,
আজ কাউকে না হলেও তোগো দুজনকে আঁর মন থাকি কিছুতেই ফেলাবার পারছি না। তোরা দুজনই শুধু আঁর দুসক্ষ টা বুঝতি। আই ছাড়া ষাড়ের মত সাড়া ঢাহা শহর ঘুরি বেড়াইছি। আর আল্লাহ্র দেয়া চোখ দুইডারে সঠিক এস্তেমাল করি করি কত কইন্যাক নিয়া কত কবিতা আওড়াইছি। নেবু আইজকা একখান হাছা কতা কই, তোর থুক্কু মার্কা যে দাঁড়ি গুলান আছে না, হে গুলারে আই কখনো দাঁড়ি মনে হরি ন। আঁর কাছে হে গুলানরে শরতের কচি ঘাস মনে অইত, আর আই কত দিন হেই ঘাসের মধ্যে গড়াগড়ি খাইছি আর ওগো কইন্যার মত কবিতা লিখছি।
আর মশিউর তুই আঁর সবচেয়ে নজদিক প্রতিবেশি। তোর গুতা গুলা আঁরে কবিতা গল্পের খোয়ারে ঢুহায় দিত। আর খোয়ারে ঢুহি আই দেখতাম গইদ্য পইদ্যর ছড়াছড়ি। অইব না কেন, নববর্ষে হাঁমরা তোর ফেবুতে যে স্ট্যাটাস দেখনু তাতে আই ডিউকের মত কইবার সাহস না পাইলেও গইদ্য পইদ্যর রসদ মেলা পাইছিনু। নিকবো নিকবো কইরা আর নেকা হয় ন। তাই তোর ভাবি আইলে অন্য কোন ভাবটাব খুপড়িতে না আইলেও ওই যে রসের হাড়ি পাইছি তার থেকে দুই চাইর ফোঁটা নিয়া ছাইড়া দিলেই লেবু মিয়ার কেল্লা ফতে। ওড়ে আর বিমান উড়ানোর লেকচার ছাড়তে অইব না। যাওগ্যা, সময়তে দেইখ্যা লইব।
আমি আমার লেখাটা এক পর্বেই শেষ করতে পারতাম কিন্তু আহমদ মোস্তফা কামাল ভাইয়ের মৃদঙ্গ বাদক, প্রতিমা শিল্পী ও কীর্তন শিল্পীদের হারিয়ে যাবার কথা পড়ে আমি আমার নিজেকে ৩৬-৩৭ বৎসর আগের জীবনে দেখতে পাচ্ছি। আমার গ্রামের বাড়ি আমার উচ্ছল চঞ্চল জীবনের এক চারন ভূমি। আমার চঞ্চলতার কাহিনী অনেক গল্পে লিখেছি। বাকি যা আছে তারি দু একটা আজ তুলে ধরব। আমাদের গ্রামের বাড়ির পূর্ব দিকে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা আর পশ্চিম দিকে ছিল সাওতাল, ওড়াও উপজাতি। তখনকার দিনে এসব এলাকায় উচ্চ শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ছিল না বললেই চলে। যেমন আমাদের বাবুর হাটের প্রাইমারি স্কুলের টংক স্যার ও নরদেব স্যারের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল যথাক্রমে, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণী পাশ। নরদেব স্যার উনার ছেলের সাথে ৭২ সালে এস,এস,সি পরীক্ষা দিয়ে ৭২রা পাশ দিয়ে উনার চাকড়ি বজায় রাখিতে পারিলেও টংক স্যার দেশ স্বাধীন হবার পর প্রাইমারি শিক্ষক হতে হলে কমপক্ষে এস,এস,সি পাশ লাগবে এই খড়গে কাটা পড়লেন। আমাদের আশ পাশের বেশীর ভাগ ছেলেরা প্রাইমারির গণ্ডি পার হলেও বেশীর ভাগই অষ্টম শ্রেণী বা বিয়ের বাজারে নন মেট্রিক ডিগ্রীর উপর জোড় দেয়া হত।
এই অষ্টম শ্রেণী বা নন মেট্রিক শিক্ষাগত যোগ্যতার শিক্ষিত ব্যক্তিরা এত সুন্দর সুন্দর পালা,পালাগান বা যাত্রা রচনা করত আর পুরুষরা নারীর ভূমিকায় অভিনয় করে প্রত্যন্ত এই গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে পুড়ো শীতের মৌশুমে মানুষকে কত আনন্দ দিত তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। অর্ধেক ভাদ্র, আশ্বিন,কার্তিক এই সাড়ে দুই মাস গ্রামের মানুষের তেমন কাজ থাকত না। তাই এই সময়টা তারা এই নির্মল আনন্দের ভাগ লইত। আমি সন্ধ্যার সময় লুকিয়ে চলে যেতাম হিন্দু পাড়ায় আমার বন্ধুদের বাড়িতে। ওদের হারমোনিয়াম, তবলা, বাঁশি, কন্সার্ট, বেহালা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের সুরে মুগ্ধ হতাম। বহু ঘটর মটর করে হারমোনিয়াম কিছুটা আয়ত্বে নিতে পাড়লেও বড় ভাইয়ের বেত্রাঘাতে তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। যদিও পরে আমি আমার সাথ পুরন করেছি।
অষ্টম শ্রেণী বা নন মেট্রিক শিক্ষাগত যোগ্যতার অতীব মেধাবী সেই লেখক, যন্ত্রী, অভিনয় শিল্পী ওরা আজ দারিদ্রের কষাঘাতে কোথায় হাড়িয়ে গেছে যাও দু,একজনের সাথে কথা হয় বুঝতে কষ্ট না জীবনের ভার যে আর বইতে পারছে না।আর মানুষজন সেই সব পালাগান, যাত্রাগানের বদলে টিভিতে ডিসের কল্যাণে নিত্য নতুন বাংলা হিন্দি সিনেমা দেখে নিত্য নতুন মজা নিচ্ছে।
আমার বাড়ির পশ্চিম দিকে যে উপজাতিরা থাকত তারা অনেকে আমার সাথে পড়ত। ওদের গায়ে ছিল প্রচুর শক্তি। ওরা আমাদের সাথে হা-ডু-ডু খেলতো আমরা যখন নিজেরা খেলতাম, তখন উপজাতি ও আমাদের মাঝে ভাগাভাগি খেলা হত। এমনও হয়েছে একটা গেম দুই তিন দিনেও কোন রেজাল্ট হত না। আর যখন বাইরে খেলতে যেতাম তখন দুই দলের সেরাদের নিয়ে টিম গঠন করতাম। কখনও জিততাম, কখনও হারতাম, কিন্তু জাতি ধর্মের ভেদাভেদ হীন বন্ধুত্ব কখনও হারাতাম না। আজ আমার সে সব উপজাতি বন্ধুরা ওদের জমি জমা হাড়িয়ে, হাড়িয়ে মানে অপ্রিয় হলেও সত্য আমরাই বিভিন্ন ছলে বলে কৌশলে ওদের সম্পত্তি দখল করে নিয়েছি। ঝাড় জঙ্গল না থাকায় শিকার করার সুযোগও নেই। তাই অভাবের তাড়নায় কেউ বা ধর্মান্তরিত হয়ে কোথায় হাড়িয়ে গেছে। ঈদে বা কখনও গ্রামে গেলে আমার বয়সের অনেককে আর দেখি না। যে কয়েকজনের সাথে দেখা হয় ভীষন কষ্ট হয় ওদের দেখলে। একই জমিনে ওদের ও আমাদের জন্ম ওদেরকে বলা হয় আদিবাসি। কিন্তু আদিবাসিদের আজ বাসস্থান নেই। আমরা সভ্য সমাজের সভ্য মানুষেরা ওদেরকে সভ্য না বানিয়ে উলটা শিখিয়েছি কি করে মানুষের সম্পদ হরণ করতে হয়। দীর্ঘদিন পর ওরা আমাকে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়, জড়িয়ে ধরতে চায় আমরা কজন তাদের সে সুযোগ দেই। আমি ওদের জড়িয়ে ধরলেও আমার মনে জাগে আমার এ শরীরে ওদের জমিতে উপন্ন ফসলের খাদ্যে খাওয়া রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। (চলবে)
২৪/০৬/২০১৩ খ্রীঃ
চমৎকার ... চলুক
ধন্যবাদ, কেম্ন আছেন ভাইয়্যা?
আম্রা ভালু
আপ্নে কিরমাছেন?
হা হা হা, আমি বালা আছি। আফনে বালা আছুইন হুইন্যা দিল ডাত অনেক সুখ পাইলাম
টাইটেলের মাজেজা বুঝলাম না
প্রথম পর্বটা পড়েছেন কিনা জানিনা।
বড় হয়ে অনেক বড় লেখক হন। এই দোয়া রইলো।
===================
চলছে চলু্ক।
পড়ছি। চালিয়ে যান।
খুব সত্যি কথা
মন্তব্য করুন