মায়াকানন
ময়মনসিংহ জেলা। এ জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদী। নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে হাজারও শহর বন্দর জনপথ যেমনটি সকল নদীর ক্ষেত্রেই ঘটে, কারন এক সময় যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল নদী। নদী থেকে পাওয়া যায় কত রকমের মাছ যা তীরবর্তী জনপদের ভোজের রসনা মেটায়। নদীর উপর দিয়ে দুরন্ত বেগে ছুটে চলে ইঞ্জিন চালিত নৌকা, বড় বড় ব্যবসায়িক বজরা আরও চলে চিত্যবিনোদনের নিমিত্য নোকা বাইচ। আর এসব নদী নৌকা, মাঝি মল্লাকে নিয়ে কত হৃদয় জুড়ানো গান তৈরী হয়েছে তা কি লিখে শেষ করা যাবে। দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়া এ নদী দুইপাড়ের বাসিন্দাকে দিন রাত ২৪ ঘণ্টা বিনে পয়সায় দিয়ে যায় নির্মল বাতাস যা শরীর ও মনকে নিষ্কলুষ করে পবিত্র করে তোলে। তাই বলে সকল মানুষ কি এ নিষ্কলুষতার ছোয়া পায়। না পায় না, যদি পেত তা হলে এমন কি কখনও হত।
এ নদী তীরে বাস করে এক দম্পতি। তারা কে, কোন বংশের, কি তাদের পরিচয় বা কি ভাবে তাদের বিয়ে হয়েছিল তার কিছুই জানি না। শুধু জানি তাদের ছোট্ট সংসারে আছে আলো ঝলমল করা একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান। যার মুখের দিকে তাকালে দুনিয়ার সবকিছু ভুলে থাকা যায় এবং পৃথিবীতে এ রকম অনেক নজীর আছে। নিজের কেন, কুড়িয়ে পাওয়া কোন সন্তানকে নিয়ে কতজন নিজের ভোগ বিলাস তুচ্ছ করে সে সন্তানকে মানুষ করেছে। আমরা “দি ফাদার” যে ছবিটি দেখেছিলাম সে ছবিটা বা সে ছবির সেই বিখ্যাত গানটি যদি কোথাও বেজে উঠে,
কাটে না সময় যখন আর কিছুতে
বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না
জানলার গ্রীলটাতে ঠেকাই মাথা
মনে হয় বাবার মত কেউ বলে না।
আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়।
আয়রে আমার সাথে গান গেয়ে যায়
নতুন নতুন সুর নে শিখে নে
কিছুই যখন ভাল লাগবে না তোর
পিয়ানোয় বসে তুই বাজাবি রে
আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়।সিনেমা যখন চোখে জ্বালা ধরায়
গরম কফির মজা জুরিয়ে যায়
কবিতার বই গুলি ছুড়ে ফেলি
মনে হয় বাবা যদি বলত আমায়
আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়।আয়রে আমার সাথে আয় এখনি
কোথাও ঘুরে আসি শহর ছেড়ে
ছেলে বেলার মত বায়না ধরে
কাছ থেকে নে না তুই আমায় কেড়ে।
আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়।দোকানে যখন আসি সাজব বলে
খোঁপাটা বেঁধে নেই ঠাণ্ডা হাওয়াই
আরশিতে যখনি চোখ পরে যায়
মনে হয় বাবা যেন বলছে আমায়
আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়।
আমার মত দুর্বল চিত্তের মানুষেরা কত জন আঁখি জল ধরে রাখতে পারি।
কিন্তু কিছু মানুষ আছে রিপুর তাড়নার কাছে পরাস্ত হয়ে আল্লাহ্ প্রদত্ত এ অমুল্য সম্পদকে ফেলে ছুটে যায় রিপুর পুজা করতে। আর আল্লাহ্ প্রদত্ত এ অমুল্য সম্পদটি অনাদর অবহেলায় মুল্যহীন ও কারও কারও হাত সাফাই ও হাস্যস্কর ক্রীড়ানকে পরিণত হয়। যা কিনা আইনের দৃষ্টিতে যেমন অপরাধ, মানবিক দৃষ্টিতে মনুষ্যত্ব পেরিয়ে পশুত্বের পশুত্বকেও হার মানায়।
মা-বাবা ও ছোট্ট মেয়ের সংসারে থাকার কথা অফুরন্ত সুখ। না সুখ কোথায়, প্রতিদিন চলে স্বামী স্ত্রীতে ঝগড়া। ঝগড়ার বিষয় বস্তু আমার জানা নেই, তবে তার একটি কারন ছয় কি সাত বছরের এ মেয়েটিকে পরের বাড়িতে ঝি এর কাজে দিতে মায়ে ইছুক হলেও বাবা তা চান না। নিত্য নৈমিত্তিক ঝগড়ার এক পর্যায়ে একদিন বাবা বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কিছুদিন পর নানির কাছে রেখে মাও ঢাকা শহরে চলে যায়। মায় কিছুদিন পর আর একটা বিয়ে করে ফিরে আসে মেয়েটিকে নিয়ে যাবার জন্য। মেয়েটি বলে আমি যদি চলে যাই তবে নানিকে কে দেখবে? কিন্তু মা নাছোর বান্ধা। মায়ে ইতিমধ্যেই মেয়েকে কাজে দেবার নাম করে অগ্রিম টাকা নিয়ে ফেলেছে। তাই তার কাছে মেয়ে বা বৃদ্ধা মা কিছুই না। টাকা,টাকার নেশা যে তাকে পেয়ে বসেছে।
আল্লার দুনিয়ায় আমরা ৭দিনে সপ্তাহ, ৩০দিনে মাস ৩৬৫দিনে এক বছর এভাবে সময় টাকে ভাগ করে নিয়েছি। এমন না করে অন্য ভাবে করলে কি ক্ষতি হত আমি জানি না। যাক এই ভাগাভাগির কোন একদিনে মা তার মেয়েকে নানির কাছ থেকে ছিনিয়ে রাজধানী ঢাকা শহরে নিয়ে চলল। বড় শহরে গেলে সবারই আনন্দ হয়। কিন্তু আমার গল্পের মেয়েটির ,মনে কোন আনন্দ নেই। কি করে আনন্দ হবে, সে যদি ঢাকা শহরে লেখা পড়া বা বেড়াতে যেত তা হলে না নয় তার আনন্দ হত। কিন্তু তার মা যে তাকে নিয়ে যাচ্ছে পরের বাড়িতে ঝি এর কাজ করাতে। সেই মেয়েটি এখন ঢাকায়, কদিন মায়ের কাছে থাকার পর মায় একদিন নিয়ে এল তার সেই অনাকাঙ্ক্ষিত বাড়িতে যেখানে তাকে ঝি এর কাজ করতে হবে। মা তাকে রেখে চলে গেল। গ্রামের ৭ বছরের একটি মেয়ে শহরের অত্যধুনিক জিনিস পত্র, গ্যাসের চুলায় রান্না, সিংঙ্ক, ক্যাবিনেট, ফ্রিজ, টিভি, কম্পিউটার, কমোড ,বেসিন,টাইলস লাগানো সব মেঝে ও বাথরুম। তাই প্রথম দিন হতেই তার উপর নতুন জিনিসের ব্যবহার না জানার অপরাধে আরম্ভ হল, মুখ এবং হাতের ব্যয়াম করা। কথায় কথায় খোটা আর গুতা কিল, থাপ্পড়। এটা শুধু বাড়ি ওয়ালির মাঝিই সীমাবদ্ধ থাকলো না। বাড়ির কর্তাও তার থেকে দুরে থাকেননি। নির্যাতনটা শুধু এর মধ্যেও সিমাবদ্ধ থাকলো না, খাওয়া ও না খাওয়ার মধ্যেও গড়াল। ৭ বছরের একটি শিশু সারাদিন কাজ করে নির্যাতন সহ্য করে আবার যদি না খেয়ে থাকে, আপনারা একটু ভেবে দেখুন তো আপনার ঐ বয়সের একটি সন্তানের কথা।
একদিন মেয়েটির মা এল, মায়ের কাছে মা গো আমার এখানে ভাল লাগে না তুমি আমাকে নিয়ে যাও। ওরা আমাকে মারে। খেতে দেয় না। কিন্তু পাষাণ মায়ের হৃদয় গলে না। পরের বাড়িতে কাজ করতে হলে একটু আধটু সইতেই হবে। মা চলে যায়।
চলতে থাকে মেয়েটির দিন তবে ঢেউহীন নদীর মত নয়,বরং ঢেউএ ঢেঊএ। এ ঢেঊ পানির ঢেউ নয়, এ ঢেউ নির্যাতনের ঢেউ। দিনকে দিন এ ঢেঊ বাড়তে থাকে। একদিন রান্না করতে গিয়ে হাত থেকে একটি কড়াই পড়ে যায়। কড়াই পড়ার শব্ধটি একটু জোরে হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই অত্যচারের মাত্রাটাও একটু বেশী হবে এটাও তো স্বাভাবিক। গৃহকর্তী রান্নার কাজে ব্যবহৃত চ্যাপ্টা হাতল খানি গরম করে অপরাধীকে শুইয়ে পেটের মাঝে দেয় ছেকা। চিৎকার করবি, মুখে গুজে দেয় কাপড়। হায় মাবুদ কত মেধাবী করে তুমি বানিয়েছ এ ডাইনিটিকে।
আগুনে ছেকার জ্বালা যন্ত্রনা আর যে সহ্য হয় না। কি করা যায়। পালাতে হবে। কিন্তু কোথায় পালাবে? মায়ের কাছে গেলে, মা তো আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে দুনিয়ার এ দোজখে। মা যে আমাকে বিক্রি করে আগেই টাকা নিয়ে গেছে।
তাই যে দিকে চোখ যায় চলে যাব। চাবি তো আমার হাতেই আছে। ভোর বেলায় কেউ ঘুম থেকে উঠার আগেই বেরিয়ে পরে বাড়ি থেকে। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এসে দেখে সাত সকালে এ জায়গায় হাজারও মানুষের ভীড়। আর কত রকমের শাক সবজি, মাছ আরও কত কি। কাউকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে এটা কাওরান বাজার। নামটা শুনা শুনা মনে হয়। তাতেই বা কি, কেউ তো আর জানা শুনা নাই। থাকলেও বা কি? নিজের বাপ মা থাকতেও যেখানে নেই সেখানে কার কে? এক সময় বেলা বেড়ে দশটা কি এগারটা হল। বাজারের সকাল বেলার ভীড়টা আর নেই। ক্ষিধায় জান যায় যায়। কিন্তু কোথা পাবে খাবার। এক সময় খনিক দুরে বসা বাবার বয়সী এক লোক তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে । অথৈই সমুদ্রে ভেসে যাওয়া কেউ একটা খড় কোটা পেলেও যেমন বাঁচার আশ্বাস পায়, মেয়েটির অন্তরেও তেমনি একটি ক্ষীন আশা জেগেছে, হয়ত বললে কিছু খাবার মিলবে।
তোর বাড়ি কই?
মমি সিং
কই থাক স
থাহার কোন জাইগা নাই। যেইহানে কাম করতাম পলাই আইছি।
খুব ক্ষিধা লাগছে।, কিছু খাইতে দেন।
এক রাইত আমার লগে থাকবি?
আমি ওর কাছে খাবার চাই, আর ও আমারেই খাইতে চায়। হায় খোদা, মরুভূমির বুকে ঝড় হয় ধুলি ঝর। কদাচিৎ সেখানে বৃষ্টি হয়। কাঁদতে কাঁদতে তো মেয়েটির সাড়া শরীর ইতিমধ্যেই মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ মরুভূমিতে এত পানি কোথা থেকে আসছে?
এত সুন্দর পৃথিবীটা এই লোকটির দিকে তাকালে এত কদর্য মনে হচ্ছে কেন? না আর এখানে এক মুহুর্ত নয়। আবার চলতে লাগল, অজানার উদ্দেশ্য। একজন লোক তার নজরে পড়ল। অবুঝ মন কেন জানি মনে করল তার কাছে হয়ত এক মুঠো খাবার পাওয়া যাবে। তাই সে তার কাছেই গেল। কিন্তু না উল্টা মিলল তিরস্কার।
আত্ন মর্যদা সবারই আছে, আমার গল্পের এ মেয়েটিরও আছে। তার ভাষায় বলি।
আজ থেকে আমি আর কারও কাছে কিছু চাইব না। যে দিন নিজে খাবার যোগার করতে পারব। সেদিনই খাব। এই বলে সে একটি বস্তা কুড়িয়ে নিয়ে শুরু করল অভিযান ভাংড়ি, ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট, কাগজ, পাতা কুড়ানো যাতে হয়ত মিলবে তার এক বেলা খাবার। আর মিলবে একটি নাম টোকাই বা পথ কলি।
খাবার হয়ত মিলবে কিন্তু তার নিজের শত্রু তার আগমনী যৌবন, তার মেয়ে সত্বা আর চার পাশে অসংখ্য নরপশু,নরশ্বাপদ, নর চামড়ালোভীর হাত থেকে কিভাবে বাঁচাবে? আকাশের এ তারা বা বাগানের এ কলি কতক্ষণ বা কতদিন পাড়বে তাকে আপন স্থানে গুছিয়ে রাখতে।
কয়েকজন মেয়ের সাথে তাঁর পরিচয় হল। তাদের সাথে সে চলে এল কমলাপুর স্টেশনে। সেখানে বিচিত্র অভিজ্ঞটায় কাটল তাঁর কিছুদিন। একদিন পরিচয় হল একটি ছেলের সাথে। সে তাকে প্রস্তাব দিল তার সাথে যেতে।
আমাকে ওখানে মারবে না তো?
না , মারবে না।
মেয়েটি চলল সে ছেলেটির সাথে। একজন মহিলার কাছে মেয়েটীকে রেখে ছেলেটি, আমি মাঝে মাঝে আসব বলে চলে গেল। কাওরান বাজারের যে লোকটিকে দেখে পৃথিবীতাই তার কাছে কদর্য মনে হচ্ছিল, আজ এ ছেলেটিকে দেখে পৃথিবীতাকে মনে হচ্ছে অনেক অনেক সুন্দর। আর এ পৃথিবীতে এমন ছেলের সাথে হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা হয়।
মহিলা তাঁর বাড়ি নাম ঠিকানা সব জেনে নিল। তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এখানে থাকবে? থাকব। মেয়েটি আজও ওখানে থাকে। আর মেয়েটি যেভাবেই হউক তার মাথা গোঁজার ঠাই পেয়েছে। আর আমিও আমার সৃষ্টি কর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করছি, মেয়েটিকে নিরাপদ আশ্রয় দেবার জন্য। যে আশ্রয় স্থল টির নাম” মায়াকানন”।
মন্তব্য করুন