ডোম (পর্ব-১) সংগৃহীত
তিনি পেশায় একজন ডোম। মৃত মানুষের শরীর কেটে তার থেকে প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করাই তার কাজ। সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে মৃতের মৃত্যুর কারন নির্ণয় করা হয়। খুবই গুরুত্ব পূর্ণ ও ভয়ের একটি কাজ। ভয়ের কাজ আমাদের কাছে হলেও যে এ কাজ করেন তার কাছে নাকি ভয় নয়, বরং আনন্দই লাগে।
তাকে একটি মফস্বল শহরে বদলী করা হল। তখনকার দিন মফস্বল শহর গুলো এত উন্নত ছিল না। শহরে বাসা ভাড়া পাওয়া বেশ কষ্ট সাধ্য ছিল। কারন মফস্বল শহরে তেমন দালান কোঠা গড়ে উঠেনি। ভাড়া নিতে হলে টিনশেড ঘর, তার উপর রান্না বান্না করা, থাকার জন্য খাট টাট হাবি জাবি কত কিই না লাগে। তাই এত ঝক্কি ঝামেলা ও খরচ বাচানোর জন্য তিনি শহর থেকে একটু দূরে একজন প্রভাবশালী কৃষকের বাড়িতে লজিং থাকার ব্যবস্থা করলেন। এ বাড়িটির খানিক দুরে ছিল একটি শ্বশানঘাট বা চিতাশাল। কিন্তু এদিকে তিনি তেমন কোন নজর দিলেন না।
তখনকার দিনে এস এস সি বা এইচ এস সি পরীক্ষা দিতে গ্রামের স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের কারও না কারও বাড়িতে থেকে পরীক্ষা দিতে হত। তিনি আসার কদিন পর এক রাতে বাড়িতে এসে দেখেন তেমনি এক পরীক্ষার্থী এইচ এস সি পরীক্ষা দিতে উনার রুম মেট হিসেবে রুমে জায়গা করে নিয়েছে। ডোম মনে করল হয়ত বাড়ি ওয়ালার আত্নীয় টাত্নীয় হবে তাই কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। ছেলেটি ছিল বেশ পরহেজগার। দুইজন খুব মিলে মিশে থাকতে লাগল। বয়সের পার্থক্য তাদের মধ্যে কোন কিছুর বাধা হয়ে দাড়াল না। সকাল ও রাতে এক সাথে খাওয়া হলেও দুপুরটা দুজনকে আলাদাই খেতে হতো। কারন একজন সে সময় অফিসে থাকে আর একজন বাসায় থাকে।
জনাব ডোম সাহেবের প্রতিদিন অফিসে যেতে হলেও প্রতিদিন তার কাজ থাকত না। একদিন তার ডাক পড়ল একটি লাশ পোষ্ট মর্টেম করার জন্য। তবে এখন নয় লাশটির যাবতীয় সরকারি কাজ শেষ হতে এবং তার কাজে হাত দিতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। লাশ রাখার নির্ধারিত কক্ষে সে তার প্রয়োজনীয় যন্ত্র পাতি নিয়ে প্রবেশ করছে। ধীরে ধীরে সে এগিয়ে যাচ্ছে সফেদ কাপড়ে ঢাকা লাশটির দিকে। সাধারণত অস্বাভাবিক মৃত লাশেরই পোষ্ট মর্টেম করা হয়। তাই লাশ বিকৃত হবে। এটাই স্বাভাবিক।
সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশটির ঢাকনাটা উঠানোর পর কেমন জানি একটা ধাক্কা খেলেন। জীবনে কত লাশের পোষ্ট মর্টেম করেছেন কিন্তু এমন বীভৎস লাশ কখনও দেখেন নি। এটি একটি মার্ডার কেসের লাশ। বুকের মাঝে চারটি গভীর গর্ত, দুটি হাতের কব্জি নেই। একটি চোখ কোটের হতে বের হয়ে যেন হা করে তাকিয়ে ঝুলছে। গলাটা সামনের দিক থেকে ৮৫% কাটা তাই বসালে পিছনে ঝুলে যায়। অনেক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে মারার সময়। যেহেতু তার পেশাই এটা তাই তেমন কিছু মনে না করে তিনি তার প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করে নিলেন।
সকল কাজ সমাধা করতে রাত প্রায় দশ কি সাড়ে দশটা বেজে গেল। উনি বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। সেই শ্বশান ঘাটের পাশ দিয়ে যাবার সময় আচমকা এক বাতাস এসে যেন উনাকে ধাক্কা মেরে প্রায় রাস্তা থেকে ফেলে দিচ্ছল। উনি সামলে নিয়ে এগিয়ে চলছেন। কেন জানি নজর গেল শ্বশানের দিকে, দেখেন কতগুলো মস্তকবিহীন কঙ্কাল একে অপরের সাথে ভীষন যুদ্ধে লিপ্ত,আর কাই মাই শব্দ। উনি ছিলেন প্রচন্ড সাহসী। তাই কিছু মনে না করে, বাড়ির পথে চললেন।
লজিং বাড়িতে গোসল করার জন্য ছিল পুকুরের পানি। উনি এসে পুকুরে আরাম করে গোসল সেড়ে ঘরে গিয়ে রাতের খাবার খেলেন। সাথে উনার রুম মেট ও খাবার খেল। খেয়ে শুয়েছেন খুমানোর উদ্দেশ্যে। ছেলেটি তখনও পড়ছিল। ঘুম ঘুম ভাব, কিন্তু ঘুম আসছিল না। লাশটার কথা বার বার মনে পড়ছিল। আহা কি নির্দয় ভাবেই না বেচারাকে মারা হয়েছে। কোন ওয়ারিশ ও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর মাঝে উনার রুম মেট রুম থেকে বাইরে গেলেন। অনেক ক্ষন হল ফিরে আসার নাম নেই। হঠাত একটি বিকট চিৎকার শুনে উনার ঘুম ঘুম ভাব কেটে গেল। উনি বাইরে বেরিয়ে এলেন। কৈ রুম মেট কোথায়? আস্তে আস্তে পুকুর পাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। যেতে যেতে একেবারে পুকুর ঘাটে চলে এসে আধো আলো আধো আধারিতে রুমমেটকে আধা পানি আধা পুকুর পাড়ে পড়ে থাকতে দেখলেন। উনাকে তুলে নিয়ে এসে রুমে কাপড় বদল করে কিছুটা শশ্রুষা করার পর উনার জ্ঞান ফিরে এল। যেহেতু রাত একটু বেশী হয়ে গেছে তাই কাউকে আর ডাকার প্রয়োজন মনে করলেন না।
উনাকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন কেন কি দেখে উনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। উনার শরীর থর থর করে কাঁপছিল। উনি কিছু বলতে পারছিলেন না। খানিক স্তম্ভিত ফিরে এলে উনি বলতে লাগলেন। আমি যখন পুকুর পারে গেলাম অজু করে তাহাজ্জুত নামাজ পড়ব। পিছন দিকে কিসের একটা শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকাতেই দেখি তিনজন লোক, আমার দিকে তেড়ে আসছে। তাদের দুজন স্বাভাবিক মানুষ হলেও একজন মানুষ রীতিমত ভয়াবহ। তার খালি গা, বুকের মধ্যে চারটি গভীর ক্ষত যেন বল্লম দিয়ে কেউ আঘাত করেছে, আর সে আঘাত থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। তার দুটি হাতের কব্জি নেই। গলাটা সামনের দিক থেকে ৮৫ ভাগ কাটা, একটি চোখ কোটর হতে বের হয়ে আসছিল। তিনজন লোক একসাথে আমাকে উঠিয়ে পানিতে ছুড়ে মারে। আমি পানি থেকে উঠে আবার তীরের দিকে আসতে চাইলে, রক্তাক্ত লোকটি আমাকে এক লাথি মারে, লাথি মারার পর আমি আর কিছুই মনে করতে পারছি না।
জনাব ডোম সাহেব যত শুনছিলেন ততই উনার ভিতরের অন্তরাত্মা খাঁচা ছাড়া হবার উপক্রম হচ্ছিল। আমি যে লাশের পোষ্ট মর্টেম করেছি, এই ছেলের তো তা জানার কথা না। আর একটি মৃত লাশের পক্ষে কি করে এখানে এসে ছেলেটিকে আক্রমণ করবে? ছেলেটিকে কিছু না বলে জনাব ডোম নির্ঘুম রাত কাটালেন। (চলবে)
চলুক
চলবে
লেখাটা ভাল লাগলো। চলুক...
লেখাটা খুব ভাল লাগলো। চলুক...চলবে
মন্তব্য করুন