আমি আকাশ যাব( দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)
আমি আকাশ যাব
দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব
জোকটাকে ছাড়ানোর জন্য ধরছি তো পিছলে যাচ্ছে।শালার বেটা এত শক্ত করে কামড়ে ধরছে যেন ওর বাবার পৈতৃক সম্পত্তি, কিছুতেই ছাড়বে না। হাত দুটা মাটিতে ঘসে নিয়ে ধরলামতো বেটা কুপোকাত। হেচকা টানে জোকটাকে ছাড়ালাম,কিন্তু অনেক রক্ত ঝড়ছে। দেখে কান্না পেল। মনকে শক্ত করলাম। পেন্টটা দিয়ে রক্ত পড়ার জায়গাটা চেপে ধরলাম।
আবার হাটতে লাগলাম। রক্ত এখন ও ঝড়ছে। হঠাত ওয়াহাব ভাই, আমাদের বছর মারি কাজের ছেলেটার কথা মনে পড়ল। তাকে দেখেছি কোথাও কেটে গেলে দুর্বাঘাস চিবিয়ে কাটা জায়গায় লাগিয়ে দিত। এক সময় ভাল হয়ে যেত।
আমিও কিছু দুর্বাঘাস তুলে চিবিয়ে লাগিয়ে দিলাম।চিবানোর সময় কেমন যেন লাগছিল,মনে হচ্ছিল বমি করে দিব।
আবার হাটতে লাগ্লাম। এবার বড় সড়কের কাছে চলে এসেছি। বড় সড়ক পার হলেই তো বিশাল বড় সরকারি ইক্ষু খামার। এই খামার পার হলেই আকাশ ধরা যাবে। আহ কি মজা খামারের এক্টা জায়গাতে অনেক বড় এক্টা রাস্তা মনে হয় সোজা চলে গেছে আকাশটা যেখানে মাটিতে এসে থেমেছে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম কোন মানুষজন দেখা যায় কি না। পরিচিত কেউ দেখে ফেললে আমার আপুকে দেখার এত বড় অভিযানটাই শেষ হয়ে যাবে।না কাউকে দেখা যাচ্ছে না।আস্তে আস্তে নিচ থেকে সড়কের উপর উঠে ভৌঁ দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে ঢুকে গেলাম ইক্ষু ক্ষেতে। কিছুক্ষন দম নিয়ে হাটতে লাগ্লাম।হাটছি তো হাটছিই। রাস্তা তো শেষ হয় না। এর উপর আর এক উপদ্রব। মাঝে মাঝে বড় বড় শিয়াল আবার শিয়ালের চেয়ে একটু ছোট কি জানি রাস্তার এপার থেকে ওপারে নাদুস নুদুস চালে পার হয়ে যায়। কেউ কেউ আবার আমার দিকে আড় চোখে চায় যেন ভিংচি কাটছে। ওরা হয়ত মনের সুখে বা কোন মতলবে ভেংচি কাটছে জানিনা, তবে আমার অন্তরাত্না মাঝে মাঝ খাচা ছাড়া হবার জোগার।
আচ্ছা বাড়ি থেকে যখন বেরহই তখন মনে হচ্ছিল, আকাশটা ইক্ষু ক্ষেতের মাঝা মাঝি বা শেষ প্রান্তে এসে মাটিতে মিশেছে। এতটুকু রাস্তা চলে এলাম কিন্তু এখনও মনে হচ্ছে, ততটুকু দুরেই। আচ্ছা আমি কি আকাশ যেখানে মিশেছে সেখানে যেতে পারব? না এতদুর এসে ফিরে যাব না। তা হলে কোন দিনই আপুর দেখা পাব না। শামছুল স্যার বড় ভাইয়াকে পড়ানোর সময় যে বলে একবার না পারিলে দেখ শতবার।আমি তো একবারও শেষ করলাম না।মনের জোড় বাড়িয়ে আবার চলতে শুরু করেছি। অনেক আগেই পানি পিপাসা লেগেছে কিন্তু কৈ পানির কোন দেখা তো কোথাও নাই। আস্তে আস্তে রোদ বাড়ছে।
আমিও বিশাল ইক্ষু খামারের শেষ প্রান্তে এসে পৌচেছি। কিন্তু কৈ আকাশ মনে হয় আরো দূরে সরে গেছে। পিপাসা তো বেড়েছেই অনেক ক্ষুদাও লেগেছে। কিন্তু সামনে বিশাল মাঠ, নাই কোন বাড়ি ঘর শুধু ক্ষেতের পর ক্ষেত, ধানের ক্ষেত।
ওই দূরে একটা বাড়ির মত কি যেন দেখা যায়। হাটতে লাগ্লাম। কিছুদুর গিয়ে বুঝতে পারলাম সত্যি সত্যিই বিশাল এক বাড়ী। কিন্তু এই সব বড় বাড়িতে বিশাল বিশাল আকারের কুকুর থাকে। আর এই সব কুকুর একবার কামড় দিলে ১৪টা ইঞ্জেকশন দেবার আগেই জান শেষ। তবে এখন কি করব।ফিরে যাব না কি করব ভেবে পাচ্ছি না। ফিরেই বা যাব কি করে। একে তো ক্ষুধা পিপাসা তার উপর ধানের পাতায় ঘসা খাওয়া জায়গাগুলো রোদ যত উঠছে ত্তই অসহ্য যন্ত্রনা করছে।আর জোকে কামড়ানো জায়গাটা ভীষন ব্যথা করছে ও রক্ত জড়ছে। আপু তুমি কোথায়?? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।
রাস্তার পাশে একটা পুকুরের মত দেখতে পেলাম। এগিয়ে গিয়ে দেখি সত্যি সত্যি এটি একটি পুকুর। পানিও আছে। পুকুরের পানি পান করা তো নিষেধ হুজুর বলেছে,তাতে মস্ত অসুখ হয়, তবে কি করি। না গায়ে আর জোড় নাই। চোখ দুটা কেমন যেন ঝাপ্সা হয়ে আসছে।একটা গাছের নিচে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। আহ্ কি যে শান্তি। এখন আর ক্ষুদা তৃষ্ণা তেমন কষ্ট দিচ্ছে না।বুবুর মুখটা চোখের সামনে, আরে এ তো বুবুই। তুমি আগে কেন আসনি, আকাশের উনি খুব পাজি, শুধু ধোকা দেয়, দেখ আকাশটা ক্ত কাছে একটু হাটলেই ধরা যাবে কিন্তু উনি শুধু সরিয়ে নেয়, এখন তার যা খুশি তাই করুক তুমিও এসে গেছ, আমার আর কিছু লাগবে না।এতক্ষনে মার কথা বাবা, ভাইয়া, অন্য আপুদের কথা বড় আম্মার কথা এক্টু এক্টু মনে পড়ছে।
আচ্ছা আমার চোখ দুটো ঝাপ্সা লাগছে কেন? চোখের সামনে সব কেমন জানি ছোট হয়ে আসছে।আপু তোমাকে এত ঝাপ্সা দেখছি কেন? তুমি এত ছোট কেন?কিন্তু আমার যে অনেক সুখ।কেমন জানি একটা তৃপ্তি আমাকে ঘিরে ধরেছে। আহ কি সুখ কি সুখ!!!!
যখন চোখ খুললাম, হাস্পাতালের বেডে শুয়ে আছি।সবার প্রথমে চোখ পড়ল ছালাম ভাইয়ের মুখে ।উনি আমাদের পাশে সরকার বাড়িতে লজিং থেকে মাদ্রাসায় পড়েন।উনার গ্রামের এক জেলে আমাকে পুকুর পাড়ে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার চেচামেচি শুরু করলে ছালাম ভাই ওখানে হাজির হয়ে আমাকে চিন্তে পারেন। সাথে সাথে আমাকে হাস্পাতালে নিয়ে আসেন এবং লোক মারফত আমাদের বাড়িতে খবর দেন।এদিকে দুই দিন আমাকে খুজে না পেয়ে আশপাশের স ক্ ল আত্নীয় স্বজনের বাড়িতে খোজ করা হয়, হাটে মাই কিংও করা হয়, আর বাড়িতে চলে কান্নার রোল।
ছালাম ভাইদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় বিশ মাইল দূরে। এতটুকু রাস্তা হাজার হাজার একর ইক্ষু খামার পাড়ি দিয়ে এতটুকুন বয়সে কি করে গেলাম কেও আর হিসাব মিলাতে পারছেলন না। কেউ বলছেন জ্বিনের আছর আছে। কেউ বলছে পেত্নীর আছর আছে, আরে ছেলেদের জ্বিন না পরী নেয়। কেউ বলছে ভুত বা পেত্নী।তবে ভুত পেত্নী, জ্বিন পরী যেই হউক খারাপ কিসিমের অইব। নাইলে রক্ত খাইব কেন?
আমি যখন সুস্থ মা ও বড় আম্মা আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করেন। তুই কেন ও কেমনে গেছিলি।
আপুতো আকাশে থাকে, আপুর সাথে দেখা করতে আকাশে চড়তে গেছিলাম।
শুন কাশেমের মা (বড় ভাইয়ের নাম কাশেম)পোলারে আমার শক্ত জ্বিনে ধরছে। দেখছ না বাহানাটা কি ধরছে।ওর মরা বইনের ছুরত নিয়া আয়, যাতে সহজেই বাইর করতে পারে। কই কাশেমের বাপ এক্ষনি বড় হুজুররে ডাইক্যা আনেন। পোলারে আলগা রাখুন যাইব না। সেই রাতেই আমার গলা কমড় মাধুলীতে ভড়ে গেল। খবর পেয়ে মার অতি দুরের অতি আপন এক মামা মস্ত বড় কবিরাজ ছুটে এলেন। তুমি এহনও বইয়া রইছ। তোমার পোলা আগে না টাকা পয়সা,এই ব্লে মার কাছ থেকে কিছু মালপানি বাগিয়ে নিলেন, আর বাড়ির চার কোনায় বড় বড় চারটা লোহার রড পুতে দিলেন।
আমার ভুলের মাসুল তাবিজ কবজ আর নানা নিয়মের বেড়াজাল স্কুলের গন্ডি পার না হওয়া পর্যন্তই বয়ে বেড়াতে হয়েছিল।
ভুল শুদ্ধ জানি না, আপু আজো তোমার প্রতি আমার আকর্ষন বিন্দু মাত্র কমেনি । আজো বৃদ্ধ বয়সে মনে হয় এই তো আমি গাছ থেকে আম কাঠাল পারছি, তুমি নিচে দাঁড়িয়ে আছ। আমি মাছ ধরছি তুমি খালুই হাতে পুকুর পাড়ে বসে আছ। একা রাতে ঘুমালে আজো বালিশ ভিজে যায়। আমিও তো একদিন আসব, তবে তুমি তো নিষ্পাস অবস্থায় পৃথিবী থেকে গিয়েছিলে। আমার জীবন তো জানা অজানা না জানি কত পাপে
পঙ্কিল। তুমি এই পাপি ভাইটা তোমার পাশে স্থান দিও। (শেষ)
মোঃ আবুল হোসেন
মার্চ,২৫,২০১৫ খ্রী;
উত্তরা ঢাকা
মন্তব্য করুন