বড়দিনে ‘টপ সিক্রেট’
মনে পড়ে আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে। ১৯৮৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর দেশের একজন সুনাগরিকের সরকারি বাসায় গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য পরস্পরকে কাছ থেকে চেনা বা জানা। আমি তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। স্কুলজীবন থেকেই আমার লেখালেখির অভ্যাস। স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন দেয়ালিকা, সাপ্তাহিক স্বদেশ খবর, সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ, দৈনিক খবর, আজাদ এবং ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন পত্রিকায় নানা সমস্যা-সম্ভাবনা, অনিয়ম-দুর্নীতি, সামাজিক অনাচার-অবক্ষয় নিয়ে লিখতাম। এর মাঝে ১৯৮৭ সালের দিকে বাজারে এলো দৈনিক ইনকিলাব নামে একটি পত্রিকা। এ পত্রিকায় ’৮৮ সালে যৌতুকবিরোধী আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়। এ লেখার জন্য একটি অভিনন্দন চিঠি আসে অফিসের ঠিকানায়। সে সময় লেখালেখির সুবাদেই ইনকিলাবে যাওয়া হতো। এখান থেকেই ইনকিলাবের তৎকালীন সহকারী সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মফিজ ভাইয়ের (মরহুম মফিজ উদ্দিন আহমদ) সাথে আমার এক রকম হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তিনি আমাকে যারপরনাই স্নেহ করতেন। আমার ভালো-মন্দ খোঁজ-খবর করতেন। আমার প্রতি তার দাবি ছিল- আমি যাতে অন্তত সপ্তাহে একবার তার স্নেহধন্য আতিথেয়তা গ্রহণ করি। তার দেয়া রুটিন মতো তার অফিসকক্ষে ঢুকতেই বললেন, ‘তোমার একটি চিঠি আছে, যাওয়ার সময় নিয়ে যেও।’ আমি বললাম, ‘দাদা, এ অফিসের ঠিকানায় আমার চিঠি।’ তিনি জানালেন, ‘একজন পাঠক তোমার একটি লেখায় আকৃষ্ট হয়ে এটি পাঠিয়েছে।’ মফিজ ভাইয়ের কাছ থেকেই চিঠিটি পেলাম।
চিঠিতে যৌতুকবিরোধী লেখাটির জন্য অভিনন্দন জানানো ছাড়া কাগজের উপরভাগ ও নিচের ভাগে লেখা ছিল- ‘TOP SECRET’ আর মাঝখানে ৬-৭ ডিজিটের একটি ল্যান্ডফোন নম্বর। তখন মোবাইলের মতো ল্যান্ডফোনের এতো আধিক্য ছিল না। এ ছাড়া ফোনে আলাপচারিতায়ও আমি তেমন পটু ছিলাম না। তাই রসিকতা করেই তার গ্রিন রোডের ঠিকানায় প্রশ্নবোধক চিহ্নটি (?) ইনভেলাপে পুরো পাঠিয়ে দিলাম। উত্তর এলো- ‘গৌড়চন্দ্রিকা না করে কি বলতে চান, বলুন।’ এরপর একদিন তার সাথে ফোনে কথা হয়। কুশল বিনিময়সহ ফোনে পরস্পরকে জানার প্রথম সুযোগ হয়। তিনি ফোনে আমাকে তার বাসায় নিমন্ত্রণ জানালেন, তারিখটি ছিল ১৯৮৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। বড়দিনের ছুটিতে তিনি বাসায় থাকবেন, তাই এদিনটি বেছে নেয়া। আমি তার নিমন্ত্রণে সম্মতি দিলাম। ২৫ তারিখের বাকি মাত্র দুদিন। অপেক্ষার ক্ষণ পেরিয়ে ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লালবাগ থেকে রিকশায় রওনা দিলাম তার গ্রিন রোডের সরকারি কোয়ার্টারে। হাতে উপহার হিসেবে রজনিগন্ধার একগুচ্ছ স্টিক আর ২-১টি বিদেশী ম্যাগাজিন। বৃত্তান্ত অনুযায়ী বিল্ডিংয়ের দোতলায় উঠে কলিংবেল টিপতেই মাঝ বয়েসি এক ভদ্রলোক দরজা খুলে পরিচয় জেনে বসতে দিলেন। জানালেন, তার মেয়ে একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছে, আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছে, শিগগির ফিরবে। আমি ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর তার দর্শন ছাড়া গিফটগুলো রেখে বিদায় নিলাম।
এরপর কেটে গেছে দু-চারদিন। হঠাৎ একদিন স্বামীসহ আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। বারে ছিল শুক্রবার। আমি জাতীয় অধূমপায়ী ফোরাম নামে একটি সামাজিক সংগঠনের মাসিক সভায় স্থানীয় গ্রন্থবিতান পাঠাগারে ব্যস্ত। মা এক ভাতিজাকে দিয়ে সংবাদ পাঠিয়েছেন, অতিথি এসেছে, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে। বাড়িতে পৌঁছে স্বামীসহ প্রথম দেখলাম সেই ‘টপ সিক্রেট’ শুভাকাঙ্ক্ষীকে। পুরোনো ঢাকায় অতিথি আপ্যায়নে তেমন বেগ পেতে হয় না। সবই রেডি পাওয়া যায়। দরকার শুধু ইচ্ছা আর মেন্যু। দুপুর টাইম, তাই একটি রেস্টুরেন্ট থেকে চিকেন বিরিয়ানির ব্যবস্থা করা হলো।
সামাজিকতা রক্ষায় নামমাত্র খাওয়া হলো তাদের। শেষ হলো দেখা-সাক্ষাৎ আর জানা-অজানার পরিচয় পর্ব। তখন জেনেছিলাম, তিনি ইফফাত আরা বেগম, গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের ডেপুটি ডিরেক্টর (ডিডি)। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি। এতোদিনে হয়তো প্রমোশনের ধাপ পেরিয়ে অবসরে চলে গেছেন।
লেখালেখির সূত্র ধরে মিসেস ইফফাত আরার সাথে পরিচয়ের পঁচিশটি বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ তার নিরহংবোধের দৃষ্টান্ত আজো আমাকে ভাবায়; উদ্বেলিত করে, নিজকে সৌভাগ্যবান ভাবতে ইচ্ছে করে। তিনি যেখানেই থাকেন না কেন, শুভ বড়দিনে তার জন্য আমার শুভ কামনা রইলো।
ঢাকা
২৫.১২.২০১৩
ভাল থাক বন্ধু সব সময়।
বাপ্রে! হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিসিটি!!
হুম!
মন্তব্য করুন