ইউজার লগইন

১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১

এদিনে মার্কিন ৭ম নৌবহরকে মোকাবিলা করবার জন্য বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ভারতীয় নৌবাহিনীর সমর্থনে সোভিয়েত রণতরীর ২০টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে অবস্থান গ্রহণ করে। এরপর মার্কিন রণতরী ৭ম নৌবহর যুদ্ধে অংশ নেয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে ফেলে। পাকিস্তানের মনে যুদ্ধে সাহায্য পাবার যেটুকু আশা ছিল সেটাও এর সাথে শেষ হয়ে যায়।এদিকে,দেশের অধিকাংশ রণাঙ্গনে চলছিল মুক্তিকামী জনতার বিজয়োল্ল­াস। অসংখ্য নদীনালা, খালবিলসহ নানা প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ইতোমধ্যে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলায় অবরুদ্ধ ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় ক্রমাগতভাবে ভারতীয় মিগের একের পর এক বোমাবর্ষণ ও স্থল পথে মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি আক্রমণে দখলদার বাহিনীতে চরম বিপর্যয় নেমে আসে।

চারদিক থেকে পরাজিত হতে হতে পাকিস্তানি বাহিনী বুঝে ফেলে যুদ্ধে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। ফলে সকালে সব আশা ছেড়ে দিয়ে শর্তসাপেক্ষে আত্ম-সমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে বিদেশি দূতাবাসের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেন নিয়াজী। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মীরা সেই প্রস্তাব পাঠিয়ে দিল দিলি্লর মার্কিন দূতাবাসে। সেখান থেকে পাঠানো হয় ওয়াশিংটনে। এরপর ওয়াশিংটন ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাসের কাছে জানতে চায়, নিয়াজীর এই প্রস্তাবে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার
সমর্থন আছে কি না। প্রস্তাবের মূলকথা

আমরা যুদ্ধ বন্ধ করেছি। তবে বাংলাদেশে অবস্থানরত গোটা পাকবাহিনীকে চলে যেতে দিতে হবে, কাউকে গ্রেপ্তার করা চলবে না।

কিন্তু ভারত সরকার এ প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের পাকবাহিনীকে এই আশ্বাস দিতে রাজি হয় যে, যুদ্ধবন্দিরা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ব্যবহার পাবেন। পাকি জেনারেল নিয়াজীর শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পেয়ে ভারতীয় বাহিনী মনে করে এটি তার কৌশল। নিয়াজীর প্রস্তাবকে তাদের কাছে মনে হলো এটি যুদ্ধবিরতি, আত্মসমর্পণ নয়। কিন্তু মিত্রবাহিনী বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছুতেই রাজি নয়।

পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজীর দেয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের জবাবে বিকালে জেনারেল মানেক শ’ পাকিদের জানিয়ে দেন যে,

শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সম্মতি দেয়া হবে না

এসময় প্রস্তাবের প্রতি মিত্রবাহিনীর আন্তরিকতার নিদর্শন হিসাবে ১৫ ডিসেম্বর বিকাল ৫টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকার ওপর বিমান হামলা বন্ধ রাখা হবে বলে পাকিস্তানি জেনারেলকে জানিয়ে দেয়া হয়। এমনকি আত্মসমর্পণ করলে মিত্রবাহিনী কোন প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াবে না বলেও পাকিস্তানি জেনারেলকে আশ্বস্ত করা হয়। তবে, সেই সঙ্গে পাকিস্তানী জেনারেলকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে এও বলা হয় যে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করলে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা থেকে সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ করা ছাড়া মিত্রবাহিনীর কোন গত্যন্তর থাকবে না। জেনারেল নিয়াজী তাত্ক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে পাকিস্তান হেডকোয়ার্টারকে অবহিত করেন। শোনা যায়, নিয়াজী সেদিন সারারাত ধরে ইসলামাবাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন, দূতাবাসের সাহায্য নেন। কিন্তু পাকি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তখন মিত্রবাহিনীর গোলার আওয়াজ বাড়তে থাকে। ঢাকার অসামরিক পাকিস্তানিরা ও কয়েকটি বিদেশি দূতাবাসও আত্মসমর্পণের চাপ বাড়িয়ে দিল পাক হানাদার বাহিনীর ওপর। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ১৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জেনারেল নিয়াজীকে নির্দেশ দেন যে,

ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের জন্য যে সব শর্ত দিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য তা মেনে নেয়া যেতে পারে।

এ নির্দেশ পেয়ে সেনানিবাসে নিজের কক্ষে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন কথিত পরাক্রমশালী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে রাত ২টার মধ্যে বাংলাদেশের সব জায়গায় অবস্থানরত হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে তারবার্তা পাঠান। এদিনটি মূলত দখলদার বাহিনীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের দিন-ক্ষণ নির্ধারণের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়।

এদিন ঢাকার বাসাবোতে ‘এস ফোর্সে’র মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। জয়দেবপুরেও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক আক্রমণে পর্যুদস্ত হয় তারা। টঙ্গী, ডেমরা, গোদনাইল ও নারায়ণগঞ্জে মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি আক্রমণে বিপর্যস্ত হয় দখলদার বাহিনী। এছাড়া এদিন সাভার পেরিয়ে গাবতলীর কাছাকাছি নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয় মিত্রবাহিনীর একটি ইউনিট। ভারতীয় ফৌজের একটি প্যারাট্রুপার দল পাঠিয়ে ঢাকার মিরপুর ব্রিজের পাকিস্তানী ডিফেন্স লাইন পরখ করে নেয়া হয় ।

রাতে যৌথ বাহিনী সাভার থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পথে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদিরীয়া বাহিনী ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। রাত দুইটার দিকে যৌথ বাহিনী পাক সৈন্যের মুখোমুখি হয়। যৌথ বাহিনী ব্রিজ দখলের জন্য প্রথমে কমান্ডো পদ্ধতিতে আক্রমণ শুরু করে। ব্রিজের ওপাশ থেকে পাকবাহিনী মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ সময় যৌথ বাহিনীর আরেকটি দল এসে পশ্চিম পাড় দিয়ে আক্রমণ চালায়। সারারাত তুমুল যুদ্ধ চলে।

এদিকে রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী কুমিরার দক্ষিণে আরো কয়েকটি স্থান হানাদার মুক্ত করে। সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম শহরের প্রথম রক্ষাব্যুহ ভাটিয়ারীতে আক্রমণ চালায়। সারারাত মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ চলে। ভাটিয়ারি থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এদিন বগুড়া জেলা ও পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি শত্রুমুক্ত হয় ।

মার্কিন ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যে কোন মুহূর্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। চারদিক থেকে ঢাকা অবরুদ্ধ। এদিন দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় লেখা হয়-

ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনীকে তাড়িয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণাথর্ীরা মুক্ত বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। দেশের ভেতর বাড়ি-ঘর থেকে বিতাড়িত লোকজনও বাড়িতে ফিরে আসতে শুরু করেছে।

এদিকে জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি, নেজামী ইসলামীর নেতাকর্মীরা অনেকেই মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে আবার অনেকেই আত্মগোপন করে।

দোহাইঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, মূলধারা’৭১, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে,মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর,বাংলাউইইকি ,কালেরকন্ঠ, জনকন্ঠ, ইত্তেফাক,যাযাদি রিপোর্ট ।

পোস্টটি ৯ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

সাঈদ's picture


আর ১ দিন পরেই সেই বিজয়ের সূর্য ।

নুরুজ্জামান মানিক's picture


লীনা দিলরুবা's picture


মানিক ভাই, মাসব্যাপী চলবে তো? ১৬তে যেন সিরিজটা শেষ না হয়। ডিসেম্বর জুড়ে থাকুক। তাহলে '৭১'র ডিসেম্বর' বা 'বিজয়ের মাস' নামের একটা দালিলিক অর্জন এবির সাথে মানিক ভাইর সাথে আমাদের সবারই হবে Smile

রাফি's picture


পরশ্রমী ও প্রশংসনীয় কাজ। চলুক মানিক ভাই।

রায়েহাত শুভ's picture


টিপ সই

হাসান রায়হান's picture


টিপ সই

গ্রিফিন's picture


বাংলাদেশ

তানবীরা's picture


প্রশংসনীয় কাজ

প্রিয়'s picture


পরশ্রমী ও প্রশংসনীয় কাজ।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

নুরুজ্জামান মানিক's picture

নিজের সম্পর্কে

ঢাবি হতে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর । আগ্রহের বিষয় কবিতা-দর্শন-বিজ্ঞান । ১৯৯০'র দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেনীর জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক ,পাক্ষিক ও মাসিক সাময়িকী সমুহে প্রবন্ধ-উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ-প্রতিবেদন-ফিচার লিখছি । ব্লগিং করি-
http://www.amrabondhu.com/user/manik
http://www.sachalayatan.com/user/manik061624
http://mukto-mona.com/banga_blog/?author=23
http://www.somewhereinblog.net/blog/nuruzzamanmanik
http://nmanik.amarblog.com/
http://www.nagorikblog.com/blog/109
http://prothom-aloblog.com/users/base/nuruzzamanmanik
http://www.mukto-mona.com/Articles/n_manik/index.htm
http://www.satrong.org/Nuruzzaman%20Manik.htm