ইউজার লগইন

দেশে যেমন; এই প্রবাসেও আমরা তেমনটি কেনো?

1
অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ক্যালগেরিস্থ বাংলাদেশ সেন্টারে ক্যালগেরির স্বনামধন্য ফুটবল ক্লাব বেঙ্গল টাইগার্সের ক্ষুদে ফুটবলারদের মাঝে সার্টিফকেট বিতরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় গত ১৪ এপ্রিল। দিনটি ছিলো বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন। পহেলা বৈশাখ। সংগঠনের ক্ষুদে ফুটবলাররা ছাড়াও, তাদের অভিভাবকসহ বেশ কিছু দর্শক-স্রোতা অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন। ব্যাপক পরিসরে না হলেও আয়োজনটি এক কথায় ছিলো চমৎকার। বন্ধু আজহারুল ইসলাম মাখনের সাথে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয়েছিলাম একজন দর্শক হিসেবেই। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরুর প্রাক্কালে উপস্থাপক জুবায়ের সিদ্দিকী আমার নাম ঘোষণা করে বিশেষ অতিথির আসনে নিয়ে বসালেন। যার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। ক্যালগেরি আসার পর এমন আয়োজনে এটাই আমার প্রথম উপস্থিতি। অনেকদিন থেকেই অসুস্থ। আর তাই অনিচ্ছা সত্বেও নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখার একটা প্রবণতা কাজ করে। তবে হ্যাঁ, বেশ কিছুদিন পর এমন একটি চমৎকার আয়োজনে উপস্থিত থাকতে পেরে বেশ ভালো লেগেছে।

'ক্যালগেরি বেঙ্গল টাইগার্স' ফুটবল ক্লাবটির নাম এবং এর গর্জন আমি মন্ট্রিয়লে থাকাকালেই শুনেছি। ক্যালগেরিতে আসার পর ক্লাবটি সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জেনেছি। এখানে পা রাখার পর প্রায় মাস তিনেক আগে স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টার জেনিসাসের সকার গ্রাউন্ডে বন্ধু মাখনের সাথে গিয়েছিলাম। অনুশীলন দেখেছি ক্লাবটির ক্ষুদে ফুটবলারদের। বেশ লেগেছে। সেখানে কথা হয়েছিলো সংগঠনের কর্মকর্তাদেরসহ প্রধান কোচ বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার রকিবের সাথে। তাদের মুখে ক্লাবটির অনেক সাফল্যের বর্ণনা শুনে বড় ভালো লেগেছিলো। তাদের কাছেই জেনেছিলাম, বেঙ্গল টাইগার্স কানাডার মাইনর লীগে খেলে থাকে। অনূর্ব্ধ-১৬, অনূর্ব্ধ-১২ এবং অনূর্ধ্ব-৮ তিনটি ক্যাটাগরিতে মোট ৭৪ জন ফুটবলার প্রশিক্ষন নিয়ে থাকে এই ক্লাবে। রকিবের সহকারি হিসেবে রয়েছেন আরো দু'জন কোচ, যাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশী, মোহাম্মদ রশিদ রিপন, এবং অপরজন সাউথ আমেরিকান, ফেলিক্স লোপেজ। তবে সবচাইতে সুখের সংবাদটি ছিলো, দলটিতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সন্তানরা ছাড়াও কানাডায় বসবাসরত পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকা, এমনকি কানাডিয়ান শিশুরাও অর্থ খরচ করে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এটা জানার পর সেদিন রসিকতা করে এক কর্মকর্তাকে বলেছিলামও, বাংলাদেশের শিশুদের বাইরে অন্য বেশ ক'টি দেশের শিশুদেরও আপনারা 'বাংলার টাইগার' বানিয়ে ফেলেছেন! আপনাদের ধন্যবাদ।'

এই প্রবাসে ক্যালগেরির কিছু ফুটবলামুদে বাঙ্গালীর এহেন সাফল্য সত্যিই সেদিন আমাকে অনেকটাই আবেগাপ্লুত করে তুলেছিলো। বেঙ্গল টাইগার্সের সাফল্য সম্পর্কে এরপর আরো যা শুনেছি তাতে একজন বাঙ্গালী হিসেবে তো বটেই, পাশাপাশি দেশসেরা একটি ক্রীড়া পত্রিকার সাবেক সম্পাদক হিসেবে আমি সুখবোধ করেছি। জানলাম, ক্লাবটি ২০১০ সালের সামারে মাত্র ১১ জন ক্ষুদে ফুটবলার নিয়ে যাত্রা শুরু করে। কোচ ও কর্মকর্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এর পরিধি ক্রমেই বাড়তে থাকে। পরের বছর অর্থাৎ ২০১১ সালে প্রশিক্ষণার্থী ফুটবলারের সংখ্যা ৩৫-এ উন্নীত হয়। অব্যাহত থাকে এর অগ্রযাত্রা। প্রথমভাগে শুধুমাত্র বাঙ্গালী প্রশিক্ষণার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও ক্লাবটির সাফল্যের সুবাদে দিনে দিনে কানাডাসহ কানাডায় বসবাসরত অন্য কয়েকটি দেশের ফুটবলানুরাগী অভিভাবক তাদের সন্তানদের ফুটবলে সোনালি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এ ক্লাবে ভর্তি করান। ২০১২ সালে প্রশিক্ষ‌ণার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪-এ। এরই মাঝে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে ক্লাবের তিন ক্যাটাগরির তিনটি দলই ক্যালগেরির মাইনর লীগে অংশ নেয় এবং শুরুতেই সাফল্য প্রদর্শণ করে সকলের নজর কাড়ে। লীগে অনূর্ধ্ব ৮ দলটি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে, অনূর্ধ্ব ১২ দলটি রানার্সআপ, এবং অনূর্ধ্ব ১৬ দলটি তৃতীয় স্থার অধিকার করে। চমৎকার অর্জন! কোচ ও কর্মকর্তারাই মূলত এই অগ্রযাত্রার রূপকার। সময়ের সাথে সাথে সাফল্যের পালক বাড়তে থাকে ক্লাবটির দেহে। আলাপকালে এসব তথ্য প্রদান করে ক্লাবের এক কর্মকর্তা জানালেন, ক্যালগেরি সকার এসোসিয়েশনের অনেকেই আমাদের ক্লাবের ভূয়শি প্রসংশা করে থাকেন। অনেকে আমাদের বলে থাকেন, তোমাদের ক্লাবে অনেক ট্যালেন্ট ফুটবলার রয়েছে, যারা ভবিষ্যতে অনেক ভালো করবে।' তিনি আরো বললেন, আমাদের ক্লাবে এমন কিছু ফুটবলার রয়েছে যারা প্রভিন্সিয়াল পর্যায়ে খেলার যোগ্যতা রাখে।

এতো গেলো সা‍ফল্যের গল্প, এবার বলবো বেদনার কাব্য, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ক্যালগেরি সকার এসোসিয়েশনের নজর কাড়া, সন্তানদের ভবিষ্যত প্রশ্নে প্রবাসী বাংলাদেশীসহ অন্য বেশ কয়েকটি দেশের স্বপ্নাশ্রয়ী অভিভাবকদের আস্থা অর্জককারী এই চমৎকার ক্লাবটি আজ কর্মকর্তাদের অর্ন্তদ্বন্ধের কারণে বস্তুত দ্বিখন্ডিত হয়ে গে‌ছে। আর মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রায় শ'খানেক দেশী-বিদেশী সম্ভাবনাময় ক্ষুদে ফুটবলারের লালিত্য স্বপ্ন। অভিযোগ উঠেছে, শীর্ষ দুই কর্মকর্তার মধ্যে পদ-পদবী সংক্রান্ত বিরোধের কারণেই এই ভাঙ্গন। এর সাথে যুক্ত আছে কোচের সাথে কর্মকর্তাদের বনিবনা না হবার ব্যাপারটিও। সত্যিই যদি তা হয়, তবে সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। কেননা, স্বীয় সাফল্যের আলোকমালায় উদ্বাসিত হয়ে এই ক্লাবটি প্রতিশ্রুতিশীল শিশু-কিশোরদের শুধু স্বপ্নবাজই করে তোলেনি; একই সাথে আস্থা অর্জন করেছিলো দেশী-বিদেশী অভিভাবকদের। ফলে এর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আমাদের জাতিগত মর্যাদার প্রশ্নটিও। কোচ-কর্মকর্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যে মর্যাদা সুপ্রতিষ্টিত হয়েছিলো, বিরোধে সৃষ্ট ভাঙ্গনের কারণে তার মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে বিদেশী অভিভাবকদের কাছে। অপরদিকে, বিদেশী শিশু-কিশোররা তো বটেই, সংগঠনের বাংলাদেশী ফুটবলারদের প্রায় সকলেরই কানাডায় জন্ম, ফলশ্রুতিতে তারা এদেশেরই আচার-আচরণ ও নেচারে গড়ে উঠছে, কর্মকর্তাদের অন্তর্দ্বন্ধের কারণে দলের ভাঙ্গনে তাদের কচি মনে সংগঠক আঙ্কেলদের ভাবমূর্ত্তিও যে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সেটা বোধ করি বলার অপেক্ষা রাখে না।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কানাডায় ফুটবল এখনো তেমন একটা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। এ দেশের প্রধান দুই জনপ্রিয় খেলা হচ্ছে আইস হকি ও বেসবল। তবে হ্যাঁ, দিনে দিনে ফুটবলের প্রসার ঘটছে। বিভিন্ন প্রদেশে এর বেশ চর্চা শুরু হয়ে গেছে। ফিফাও দেশটিতে পৃথিবীর সেরা খেলা ফুটবলকে জনপ্রিয় করে তুলতে উঠে-পড়ে লেগেছে। আমেরিকার মেজর লীগে এদেশের তিনটি দল টরেন্টো, মন্ট্রিয়ল এবং ভ্যাঙ্ককুভার খেলে থাকে। আশার কথা শিগগিরই এ সংখ্যা বাড়তে পারে। ফুটবলের এই ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার ফলে বুকভরে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে এ দেশের প্রতিভামান নবাগত ফুটবলাররা। বেঙ্গল টাইগার্স যেভাবে এগুচ্ছিলো তাতে, কে বলতে পারে, পাঁচ বছর পর এ দলটিরই হয়তো একাধিক ফুটবরারকে দেখা যেতো মেজর লীগের কোনো দলে। হতেও পারতো সে আমাদেরই কারো সন্তান। আমরাও অপেক্ষায় থাকতে পারতাম মেজর লীগসহ এ এলাকার বড় বড় টুর্নামেন্টে আমাদের টাইগারদের গর্জন শোনার জন্য। কিছুদিন আগে আলাপকালে দলের কোচ রকিবও তেমনটি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছিলেন, 'তিনটি গ্রুপে এমন বেশ ক'জন বাংলাদেশী ফুটবলার রয়েছে যারা ঠিকভাবে গড়ে উঠলে অবশ্যই আগামী পাঁচ-সাত বছর পর মেজর লীগে সুযোগ করে নিতে পারবে।' দলের কোচ রকিব এমন কথা বললেও কথা হচ্ছে, সেই 'ঠিকভাবে' গড়ে ওঠার সুযোগটা আমারা তাদের দিচ্ছি কোথায়! বরং সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোরদের আশাহত করছি, করছি নিরুৎসাহিত নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করে, দলকে ভেঙ্গে চুরমার করে। হায়রে আমাদের সচেতনাতাবোধ! দেশেও যেমন; এই প্রবাসেও তেমনই! নেই কোনো পরিবর্তন!

এখানে আরো একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, দ্রুতগতির যান্ত্রিক জীবন যাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে একজন চাকুরিজীবীর কথাই বলা হোক, আর একজন শিক্ষার্থীর কথাই বলা হোক না কেনো, ফুটবল চর্চার জন্য সময় বের করা বড্ড কঠিন। চাকুরেদের কাজের সিডিউলের বাইরে এর জন্য সময় বের করা যেমন বড্ড কঠিন তেমনি শিক্ষার্থীদের থাকে কম-বেশী হোমওয়ার্ক। তারপরও বুকে স্বপ্ন বেঁধে যে সকল অভিবাবক সময় বের করে বেঙ্গল টাইগার্সে তাদের সন্তানদের অনুশীলনে নিয়ে আসতেন তারাও আজ ক্ষুব্ধ, মর্মাহত। অনেকেই তাদের সন্তানদের আর ফুটবলের সাথে সম্পর্ক না রাখারও চিন্তা করছেন। যা অত্যন্ত দুখজনক। যদ্দুর শুনেছি, দুভাগ হয়ে মূল বেঙ্গল টাইগার্স থেকে বেরিয়ে যাওয়া কর্মকর্তারা নতুন আর একটা ক্লাব গড়ে তুলছেন। এদিকে মূল ক্লাবটিও নতুনভাবে গোছানো হচ্ছে। এ‍খন প্রশ্ন হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে তারা কতোটা সফল হবেন? তবে অভিঙ্গদের ভাষ্য হচ্ছে, আলাদা‌ভাবে কোনো ক্লাবই ভা্ঙ্গনের পূর্বের বেঙ্গল টাইগার্সের মতো গর্জন তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সত্যিই ব্যাপারটা বড্ড বেদনাদায়ক! আর এ বেদনার কবল থেকে মুক্তি দিতে, শ'খানেক ফুটবলার ও তাদের অভিভাবকদের বুকে আবার স্বপ্ন তুলে দিতে সকল বিরোধ ভুলে বিভক্ত হয়ে যাওযা কর্মকর্তাদের এক হয়ে, একক শক্তিতে একটি বেঙ্গল টাইগারকে লালন করার পরামর্শ সকলের মতো আমিও তাদের দেবো।

মাহাবুবুল হাসান নীরু
mhniru@gmail.com
-২২ এপ্রিল ২০১৩, ক্যালগেরি, কানাডা।

পোস্টটি ১০ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

আরাফাত শান্ত's picture


শুভকামনা থাকলো দলটার জন্যে!
সুন্দর লিখছেন!

মডারেটর's picture


গ. "আমরা বন্ধু" তে শুধু নতুন লেখাই প্রকাশিত হবে। পুরনো লেখা রিপোস্ট করা যাবে না। অন্য কোনো কম্যুনিটি ব্লগে প্রকাশিত লেখা এবিতে প্রকাশ নিষিদ্ধ। এবিতে প্রকাশিত কোন লেখা ২৪ ঘন্টার মধ্যে অন্য কোনো কমিউনিটি ব্লগে প্রকাশ করা যাবে না। ব্যক্তিগত ব্লগ এবং পত্রিকা এই নিয়মের আওতার বাইরে।

উক্ত কারনে লেখাটি ব্লগের প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে আপনার নিজের পাতায় রাখা হইলো!

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.