ধূসর গোধূলিঃ বিষন্ন ছায়াপথ
হারু মেম্বার গদিতে বসে পান চিবাতে চিবাতে হাঁক দেয়- এই তোরা তাড়াতাড়ি কর। সন্ধ্যার আগে কাম শ্যাষ করতে না পারলে সবগুলার হাজিরা কাটুম।
সবাই তাড়াতাড়ি কাজে হাত লাগায়। জানে, মেম্বার সারাক্ষণ হাজিরা কাটার ধান্ধায় থাকে, সুযোগ পেলে ঠিকই টাকা কেটে রাখবে হারামিটা। আড়তের দরজায় এসে দাঁড়ায় বিভা। ওকে দেখে হারু মেম্বরের মুখে কপট হাসি দেখা যায়।
-এই যে পুন্নিমার চাঁন, আপনে আইছেন? যহন কামে হোগগলের দম বাইর হইয়া যায় তহন আপনারে দেহা যায় না, এহন বুজি টাকা পয়সায় টান পড়ছে। তাই এইহানে ধরনা দিতে আইছেন?
-না মেম্বর সাব, কয়দিন শরিলডা খুব খারাপ আছিলো, তাই আইতে পারি নাই।
-আইজকা দিন শ্যাষ, আর কামে নেওন যাইব না। কাইলকা আইও।
-আইচ্ছা, বলে ফিরে যায় বিভা।
সকালে উঠেই কাজে যাবার জন্য তাড়াহুড়া করতে থাকে বিভা। সময়মত চাউলের আড়তে যেতে না পারলে কাজে নিবে না হারু মেম্বর।
-এই প্রভা ওঠ। আমার এহনই বাইর হইতে অইব।
-তুমি একদিনও আমারে ঠিক মতন ঘুমাইতে দেও না
-খালি ঘুমাইলেই অইব? স্কুলে যাওন লাগবো না?
-স্কুলের এহনও দেরি আছে।
-আমি মেম্বারের আড়তে কামে যাইতেছি, পাতিলায় কয়ডা ভাত আছে, তুই খাইয়া স্কুলে যাইস। আমার আইতে দেরি অইলে কয়ডা মুড়ি খাইয়া নিস।
-আইচ্ছা, তুমি যাও।
ঝটপট কিছু মুখে দিয়েই বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে বিভা। মসজিদের পাশ দিয়ে যাবার সময় ভিতর থেকে উচ্চস্বরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আরবী পড়ার শব্দ ভেসে আসে। তাড়া থাকায় একটু জোড়েই হাটতে থাকে বিভা। কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর মসজিদ থেকে মৌলভীসাবের কন্ঠ শুনতে পায়,
-কেডা যায়?
-আমি হুজুর। ঘুরে তাকিয়ে জবাব দেয় বিভা
-এইভাবে মাথার কাপড় ফালাইলা এত্ত জোরসে হাঁটতে নাই মেয়েছেলেদের
-ভুল হইয়া গ্যাছে হুজুর
-এত্তভোরে ছোটাছুটি কইরা কই যাও?
-মেম্বারের আড়তে যামু, দেরী হইলে মেম্বার আবার রাগ করে
-ওইহানে সব বেগানা পুরুষগো লগে মেয়েছেলেরা কাম করে, যত্তসব বে-শরিয়তি কাজ-কাম!
-হুজুর, ঠেকায় পইড়া ওইহানে কাম করি। কাম না করলে খামু কি? আমার তো আর আয়-রোজগারের কেউ নাই
-আল্লার উপর তোমগো ভরসা নাই, তোমগো বুঝাইয়াও কোন লাভ নাই।
বিভা মাথা নিচু করে বাজারের দিকে হাঁটতে থাকে। মেম্বরের আড়তে গিয়ে দেখে দিনের কাজ কেবল শুরু, হাসুর মা ঝাড়ু দিতে ব্যস্ত আর জয়নাল মিয়া গতকালের জমানো ধান ভাঙ্গানোর প্রস্ততি নিচ্ছে। বিভাকে দেখে হাসুর মা হেসে বলে-
-বিভা আইছস? আয়, হেই কহন সূর্য উঠছে আর এহন পর্যন্ত কারো দেহা নাই। আমি একলা কত কাম করুম, ক? টাকার বেলায় তো হগগলেই সমান! আয়, আমার লগে একটু হাত লাগা।
-ঠিক আছে চাচী; ঝাড়ুটা আমারে দেও, আমিই ঝাড়ু দিয়া দিতাছি।
-নে, সাবধানে কাম করবি, মেম্বারের কিন্তু নজর ভাল না।
বিভা হেসে বলে- আমি জানি চাচী, এই বেডার এইহানে কাম করতে ইচ্ছা করে না কিন্তু কি করুম কও, ঘরে এক মুঠ চাউলও নাই।
বেলা একটু বাড়লে লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে, ভ্যান, নৌকা করে ধান এসে আড়তে জমে। সব লোকজনের ব্যস্ততাও বেড়ে যায়। রুস্তম মিয়া গদিতে বসে পুরানো হিসাব দেখছে, এমন সময় হারু মেম্বার ঢুকে হাঁক দেয়- কি রে, হগগলে আইছে তো ঠিক মতন?
-হ মেম্বার সাব, হগগলেই আইছে। খালি বারেক মিয়া আহে নাই, হের জ্বর হইছে, আইজকা আইব না।
-ওরে কইয়া দিস, আইজকা ওর হাজিরা কাটা। হালার পুতগুলা কামের সময় খালি ফাঁকি দিবার ধান্ধায় থাকে।
-তুমি দেহি আইজকা ঠিক সময় মতনই আইয়া পড়ছ! ঠিক মত কাম কর, ফাঁকি মারনের চেষ্টা কইরো না- বিভাকে দেখে বলে ওঠে হারু মেম্বার।
-না মেম্বার সাব, ফাঁকি মারুম ক্যান?
মেম্বার গদিতে বসে হিসাব দেখা শেষ করে পান চিবাতে থাকে আর চেয়ে চেয়ে দেখে সবাই ঠিকমত কাজ করছে কিনা?
-কাপড় ঠিক কর। কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে হাসুর মা। বিভা ঘুরে তাকিয়ে দেখে- ওর আঁচলটা খসে পড়ে আছে আর মেম্বার সোজা তাকিয়ে আছে তার শরীরের দিকে। তাড়াতাড়ি কাপড় ঠিক করে নেয় বিভা।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক নাগারে কাজ করে সবাই বেশ ক্লান্ত। আজকের মত কাজ শেষ করে বাড়ি যাবার জন্যে তৈরি হয়। মেম্বরের কাছে গিয়ে বলে,
-মেম্বার সাব, আমি এহন যাইতে পারি?
-এহনি যাবা? বেলা তো শেষ হয় নাই!
-বাড়িতে মাইয়াডা একলা থাকে, বইলা আইছিলাম তাড়াতাড়ি ফিরুম
-আচ্ছা যাও।
হাজিরার টাকা নিয়া বাড়ির দিকে হাটতে থাকে বিভা।
বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেল বিভার। ঘরে ঢুকে দেখে প্রভা চুপ করে চৌকির উপর বসে আছে।
-ভাত রান্ধছিলি ?
প্রভা কোন জবাব দেয় না দেখে ধমক দেয় বিভা- কি রে, কি কইতেছি হুনস না?
-হ রান্ধছি, বলে আবার চুপ করে থাকে প্রভা।
-প্রভা, কি অইছে তোর? এই রহম ভুতের লাহান গুম মাইরা বইয়া আছস ক্যান?
-কিছু অয় নাই, এমনেই।
বিভা আর কিছু না বলে রাতের খাবার ব্যবস্থা করতে যায়। থালায় ভাত বেড়ে প্রভাকে খেতে ডাকে-
-এই প্রভা, খাইতে আয়। প্রভা চুপ করে বসে থাকলে বিভা রেগে বলে- কি রে, তোরে কি কোলে কইরা আনতে অইবো? সারাদিন কাম কইরা শরিলডা ব্যাতা করতাছে, তারপর নবাবজাদীরে আবার সাইধা খাওয়াইতে অইবো!
প্রভা কোন কথা না বলে খেতে চলে আসে। চুপ চাপ খেয়ে উঠে যায়। মুখটা তেমনি আগের মতই ভার দেখে বিভা কিছুটা নরম হয়ে বলে- প্রভা, কি অইছে আমারে কইতে পারস না?
-মা, আমার বাবায় মইরা গ্যাল ক্যান? দু’চোখে পানি টলমল করতে থাকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিভা বলে- কি করুম মা, আমগো কপাল খারাপ, না অইলে আমগো নিজেগো বাড়ি ক্যান নদীতে ভাইংগ্যা যাইবো আর তোর বাপ ক্যান অকালে মইরা যাইবো? আইজক্যা তোর বাপের কতা মনে পইড়া খারাপ লাগতাছে মা?
-বাপ নাই তাই হগগলেই আমগো দূর দূর করে।
-প্রভা! তোরে কেউ কিছু কইছে?
-বিহাল বেলা দিঘির পাড় থেইক্যা কয়ডা কচু কাইটা আহনের সময় নানার লগে দ্যাহা, হেয় আমারে কয়- থাকতে দিছে দেইখা আমরা নাকি তার সব দহল কইরা লইছি। একদিন লাথথি মাইরা খ্যাদাইয়া দিবো। বলে কাঁদতে কাঁদতে বিভার বুকে মুখ লুকায় প্রভা।
বিভা খুব ভাল করেই জানে ওদের তাড়াতে পারলেই চাচা খুশি, কিন্তু মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে? কত কষ্ট করে জীবন কাটাচ্ছে। কখনো চালের আড়তে, কখনো মানুষের বাড়িতে কাজ করে খেয়ে না খেয়ে কোন রকম দিনগুলি পার করছে। কোনদিন চাচাকে বিরক্তও করেনি, শুধু থাকার জন্যে একটু জায়গা দিয়েছে। ও জানে, ওর বাবা কিছুই বিক্রি করে যায়নি, বলতে গেলে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে সে। ওর বিয়েতেও তেমন কিছু খরচও করেনি চাচা, কোন রকম বিদায় করেছে তাকে। সবই তো সে দখল করছে। আজ এই আশ্রয়টুকুও চাচা কেড়ে নিতে চায়!
চলবে...
চলুক!!
আবার পড়বো।
সাথে আছি।
ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।
শেষ হলে সব পর্ব আবার একসাথে পড়ব। চলুক
চলুক
ভাল চলছে..
ভাল চলছে
মন্তব্য করুন