থ্যালাসেমিয়াঃ ভয় নয়, প্রয়োজন সচেতনতা, পর্যাপ্ত প্রচারণা। (শেষ পর্ব)
হিমোগ্লোবিন-ই ডিসঅর্ডারঃ
বিটা থ্যালাসেমিয়ার মত হিমোগ্লোবিন-ই ও আমাদের দেশে বেশ দেখা যায়। এটাও এক ধরনের হিমোগ্লোবিন ডিসঅর্ডার এবং বংশগত রোগ। এই হিমোগ্লোবিন-ই ডিসঅর্ডার দুই ধরনের হয়ে থাকে। ১. হিমোগ্লোবিন-ই ট্রেইট ২. হিমোগ্লোবিন-ই ডিজিজ। যে সন্তানের পিতা-মাতার যে কোন একজন থেকে হিমোগ্লোবিন-ই এর জিন পায়, তাদেরকে হিমোগ্লোবিন-ই এর বাহক (Hemoglobin E-Trait) বলা হয় আর যারা বাবা-মা দু’জনের কাছ থেকেই উত্তরাধিকারসূত্রে এই জিন পায় তারা হিমোগ্লোবিন-ই ডিজিজে আক্রান্ত হয়।
হিমোগ্লোবিন-ই ট্রেইট কিংবা হিমোগ্লোবিন-ই ডিজিজে আক্রান্ত ব্যক্তি যদিও হিমোগ্লোবিন-ই জিন সারাজীবনের জন্য বহন করে, তবুও এদের ক্ষেত্রে তেমন কোন উপসর্গ দেখা দেয় না। এরা অনেকটা বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহকের মতই, সামান্য রক্তশূন্যতায় ভুগতে পারে। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে যদি এদের কারো সাথে বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহকের সাথে বিবাহ হয়, তবে তাদের শিশুর হিমোগ্লোবিন-ই বিটা থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
থ্যালাসেমিয়ার ভয়াবহতাঃ
থ্যালাসেমিয়ার রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে দিনের পর দিন রক্ত দিয়ে যেতে হয়। প্রতি ব্যাগ রক্তের সঙ্গে জমা হচ্ছে ২০০ মিলিগ্রাম করে আয়রন। এই আয়রন আস্তে আস্তে লিভার প্যানক্রিয়াসের প্রতিটি কোষ ধ্বংস করে দেয়। ফলে ডায়াবেটিস, সিরোসিস রোগের উত্পত্তি হয়। উপরন্তু পানিবাহিত রোগের মতো নানা রক্তবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়; যেমন—জন্ডিস, এইচআইভি, হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসজনিত রোগ। এই আয়রন নিয়ন্ত্রনের জন্য প্রয়োজন হয় ব্যয়বহুল ঔষধ। থ্যালাসেমিয়ার রোগীর জীবনকাল ২০-৩০ বছর পর্যন্ত। এই স্বল্পকালীন জীবনে রোগীর নিজের ও পরিবারের যে মানসিক অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে তা কেবল ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ ও উপসর্গগুলো:
• অবসাদ ও দূর্বলতা অনুভব করা
• শ্বাসকষ্ট হওয়া
• মুখ-মন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
• পেট ফুলে যাওয়া
• মুখের হাড়ের বিকৃতি, নাকের হাড় দেবে যাওয়া
• অস্বস্তি অনুভব করা
• গাঢ় রঙের প্রস্রাব হওয়া
• ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া অনেকটা জন্ডিস হলে যেমন হয়।
• স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি ব্যহত হওয়া
আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে যা যা করণীয়:
• নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করানো
• রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১০ গ্রাম বা ডেসিলিটার রাখার চেষ্টা করতে হবে
• হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের (Hepatitis B Virus) টিকা দেয়া।
• প্রতি তিন মাস পর পর রোগীর উচ্চতা, ওজন, লিভার ফাংশন টেষ্ট ইত্যাদি পরীক্ষা করানো।
• আট থেকে ১০ ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পর রক্তে লৌহের পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে।
• রক্তে লৌহের মাত্রা এক হাজার ন্যানো গ্রাম বা মিলি লিটারের ওপরে হলে চিকিত্সকের শরণাপন্ন হওয়া।
• শিশুর প্রতিবছর বুদ্ধি ও বিকাশ পর্যবেক্ষণ করা।
• অধিক আয়রনযুক্ত খাবার পরিত্যাগ করা।
• প্রয়োজনে এবং উপসর্গ অনুসারে, ওড়াল গ্লুকোজ টলারেন্স টেষ্ট (Oral Glucose Tolerance Test), রেনাল ফাংশন টেষ্ট (Renal Function Test), হৃদপিণ্ড এবং অন্যান্য এন্ডোক্রাইনোলজিক্যাল (Endocrinological) পরীক্ষা করানো।
প্রতিরোধে করনীয়ঃ
• থ্যালাসেমিয়ার মহামারি হতে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য প্রথম প্রয়োজন থ্যালাসেমিয়া বাহকদের শনাক্তকরণ।
• যদি কোনো কারণে দুজন বাহকের বিয়ে হয়েও যায়, তাহলে সন্তান গর্ভধারণের অনতিবিলম্বে গর্ভস্থিত সন্তানের পরীক্ষা করা এবং পরীক্ষায় যদি ধরা পড়ে যে ভ্রূণটি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত, সেক্ষেত্রে চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী এবং বাবা-মায়ের ইচ্ছায় গর্ভপাত ঘটানো যায়।
• দু’জন থ্যালাসেমিয়া বাহক যাতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয় সে বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে।
• সরকারীভাবে থ্যালাসেমিয়াকে একটি অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য যাবতীয় কর্মসূচী গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
• বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ‘এইডস’ কে যেভাবে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণকে সচেতন করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই থ্যালাসেমিয়া রোগী কিংবা বাহকদের কি কি করনীয় তা বিশদভাবে তুলে ধরতে হবে
• টেলিভিশন, রেডিও, পত্র-পত্রিকায় পর্যপ্ত প্রচারণা।
• ঘন ঘন র্যারলি, প্ল্যাকার্ড, বিলবোর্ড স্থাপন, পোস্টার, লিফলেট এবং বিশেষ ক্রোড়পত্র বিতরণের মাধ্যমে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
থ্যালসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাঃ
বিয়ে করুন রক্ত পরীক্ষা করে, দয়া করে বিয়ের আগেই রক্ত পরীক্ষা করুন, দেখুন আপনি থ্যাসেমিয়ার ক্যারিয়ার কিনা।
পরীক্ষার নামঃ হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোপ্রোসিস (Haemoglobin Electrophoresis)
কোথায় করাবেনঃ বারডেমে, পিজি, সেনা হাসপাতালে (এএফআইপি), আইসিডিডিআরবি ও বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে এ পরীক্ষা করা হয়। খরব পড়বে সর্বোমোট ৪০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা।
প্রয়োজন একটু সচতনতাঃ
আপনি হয়ত জানেনই না যে নিজের অজান্তেই বহন করে চলেছেন এই জিনটি, যেটা আপনার জন্য হয়ত ক্ষতিকর কিছু নয় কিন্তু আপনার একটু অসচেতনতাই আপনার ভবিষ্যতের ঘুম হারাম করে দিতে পারে। জীবনকে করে তুলতে পারে দুর্বিসহ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ারের সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ। সচেতনার অভাবে দুর্ভাগ্যক্রমে এদের শতকরা ৫ ভাগও যদি পরস্পরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তাহলে ভবিষ্যতটা একবার চিন্তা করুন!
অ্যাফেয়ার ম্যারেজ কিংবা পারিবারিকভাবে সেটেল্ড- যেভাবেই হোক, একজন সচেতন মানুষ হিসেবে বিয়ের আগে এই টেস্টটি করে জেনে নিন আপনারা দুজনেই ক্যারিয়ার কিনা। যে কোন একজন ক্যারিয়ার হলে সমস্যা নেই, তবে দুজনে ক্যারিয়ার হলে সম্পর্ক স্থাপনে বিরত থাকুন। একমাত্র দু’জন থ্যালাসেমিয়ার ক্যারিয়ারের পরস্পরের সাথে বিবাহ রোধই বাঁচাতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রাণঘাতী এই রোগটি থেকে।
নিজের ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করুণ। মনে রাখবেন, পরিবারে একটি থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্ম হওয়া মানে সারাজীবনের জন্য ওই পরিবারের সুখ-শান্তি শেষ হয়ে যাওয়া।
জনকল্যাণমূলক ব্লগিংয়ে আপনি অনেকদূর এগিয়ে আছেন নিভৃতদা'। আপনার চরিত্রের এ বিশেষ দিকটি দারুন! স্যালুট জানালাম।
শুভ উদ্যোগ!
জনকল্যাণমূলক ব্লগিংয়ে আপনি অনেকদূর এগিয়ে আছেন। আপনার চরিত্রের এ বিশেষ দিকটি দারুন! স্যালুট জানালাম।
স্ত্রির যদি থ্যালাসেমিয়া মেজর হয়,,, আর সামীর যদি থ্যালাসেমিয়া মাইনর মেজর কোনটাই না থাকে, একদম নরমাল, তাহলে সন্তান কি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে?? সম্ভাবনা কত পারসেন্ট হওয়ার
মন্তব্য করুন