শেষ বেলার গল্প
ওল্ডহোমের উপর ভিত্তি করে অনেক গল্প, নাটক ও গান হয়েছে। এটিও খুব সাধারণ একটি গল্প। কাছের একজন মানুষের একাডেমিক কাজের অংশ হিসেবে খুবই স্বল্প পরিসরে ওল্ডহোমের উপর একটি মুভি তৈরির জন্য একটি গল্প প্রয়োজন ছিল, তার অনুরোধেই এই প্রচেষ্টা। আমাকে বলা হয়েছিল পজেটিভ ফিনিসিং হতে হবে তবে ড্রামাটিক কোন কারণে নয়, স্বাভাবিক নিয়মেই। আমি চেষ্টা করেছি সেভাবেই লিখতে, সবার সাথে শেয়ার করার জন্য আজ ব্লগে দিলাম।
আকাশটা যেন ভেঙ্গে পড়েছে আজ। পূব আকাশ কালো করে সেই যে একটানা শুরু হয়েছে আর থামাথামি নেই। দুপুরের পর থেকে তৈরি হয়ে বসে আছে রওশন আরা। আজ সে তার নতুন বাসায় যাবে। নতুন একটা ঠিকানা পেতে যাচ্ছে সে, যেখানে তাকে অভ্যর্থনা করার জন্য অপেক্ষা করে আছে অনেক মানুষ! আজ থেকে সে আর একা নয়, সে হবে অনেকের একজন! একাটা বিশাল পরিবারের একজন! একা একা থাকতে কি কারো ভাল লাগে! কথা বলার, গল্প করার কেউ নেই। সারাদিন মনমরা হয়ে বসে থাকতে থাকতে দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল সে। আজ থেকে তার সাথে কথা বলার জন্য থাকবে কত লোক! সব তারই বয়সী। কত সুখ দুঃখের গল্প করতে পারবে, আনন্দ বেদনা সেয়ার করতে পারবে! এর চেয়ে বেশী আর কি চাই!
কিন্তু এই হতচ্ছরা বৃষ্টিটা তাকে দেরী করিয়ে দিচ্ছে! প্রায় দু ঘন্টা হয়ে গেল থামার নাম নাই! জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে রওশন আরা। ধূসর আকাশটা যেন কাঁদছে অঝোর ধারায়, তার এই সুখের দিনে ওর কান্নার কি হল! যতদূর চোখ যায় শুধু ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির ধারা, গাছপালা, উচু ভবনগুলো সব ভিজে একাকার। একটানা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে রওশন আরার। মনে ভেসে আসে কত স্মৃতি! বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানোর মত করে রওশন আরা ফিরে যায় ফেলে আসা দিনগুলোতে-
সেই পনেরো বছর বয়সে এ বাড়িতে আসে সে। লাল রঙের বেনারশি পড়ে যেদিন এ বাড়িতে প্রবেশ করে সেদিন তাকে বরন করে নেবার জন্য ছিল কত লোক! কত হাসি, কত আনন্দ! আজ চলে যাবার দিনে কেউ নেই। কেনই বা থাকবে? যে তাকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিল সে-ই তো ফাঁকি দিয়ে চলে গেল সবার আগে! মনে পড়ে, প্রথম বছর তাদের কি আনন্দেই না কেটেছে! তারপর দু’বছরের মাথায় কোল আলো করে এলো রওনক। ওকে নিয়ে দু’জনের কত উচ্ছ্বাস! কত নির্ঘুম রাত কেটেছে ওদের! তারপর ও যখন এক পা দু’পা করে হাঁটতে শিখল, আধো আধো বোলে কথা বলতে শুরু করল, ও হাসলে নতুন ওঠা দুটি দাঁত বেড়িয়ে আসতো! - কি যে আনন্দ হত দু’জনার!
বৃষ্টি যেন আরও বেড়ে গেল। আজ কি করে যে যাব! রওনকটা আমাকে রেডি করিয়ে সেই যে ওদের রুমে গেল আর এল না। হয়ত রেগে গেছে। যাহ! বৃষ্টিটা অঘটন ঘটিয়েই দিল! বউটার মনটাও বোধহয় খারাপ হয়ে গেল, আজ সে চলে গেলে বউ ওর নিজের মত করে এই রুমটা সাজিয়ে নিতে পারত! ধু ধু করা আকাশটার দিকে তাকিয়ে রওশন আরা আবার আনমনা হয়ে যায়। তার শাশুড়ি মারা যাবার আগে বলেছিল- বউ, এই সংসার তোমাকে দিয়ে গেলাম। দেখে রেখ আর আমার ছেলেটার যত্ন নিও। ও তো এতদিন কথা রেখেছিল! কিন্তু রওনকের বাবা যে ওকে ফাঁকি দিল! এখন ওকে কে দেখে রাখবে?
এ বাড়িতে ওর আর কোন কাজ নেই। শাশুড়ির দেয়া আমানত সে তার বউর হাতে তুলে দিয়েছে। আর রওনককে দেখার জন্য তো বউ রইলই! এবার তার ছুটি। কিছুটা কষ্ট তো থাকবেই! কচি দু’টি হাতের ছোঁয়া না পাওয়ার কষ্ট, আদুরে গলায় দিদা ডাক না শুনতে পাওয়ার কষ্ট, আর রাত হলেও অন্তত একবার হলেও একমাত্র সন্তানের মুখটা দেখতে না পাওয়ার কষ্ট। এ আর এমন কি! অনেক সুখের আশায় এতটুকু কষ্ট না হয় সহ্য করল সে! কিন্তু বৃষ্টি কেন থামছে না? রওনকটাও কেন যে এদিকে আসছে না!
রওশন আরা চেয়ার ছেঁড়ে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় রওনকদের রুমের দিকে। দরজায় নক করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। রওনক ও শিখার মধ্যে তর্ক হচ্ছে, ভেতরে যাওয়া বোধহয় ঠিক হবে না। আবার ফিরে আসে নিজের জায়গায়।
অনেকক্ষণ ধরে কেঁদে চলেছে রাতুল। দিদাকে সে কোথাও যেতে দেবে না। বাবা মা যতই বোঝাক তার জিদ যেন আরও চেপে বসেছে। তাহলে আমি দিদার সাথে যাব। শিখা যতই বলে ওখানে বাচ্চারা যেতে পারে না কিন্তু রাতুলের সেই একই কথা-
-আমি দিদার সাথে যাব, আমি দিদার সাথে যাব, আমি দিদার সাথে যাব।
-বাবা, দিদার বয়স হয়েছে তাই ওখানে যাবে। তোমাকে তো ওখানে থাকতে দেবে না। শিখা বলে
-তাহলে দিদা ওখানে যাবে কেন? দিদা আমাদের সাথে থাকবে।
-বুড়ো হয়ে গেলে তো ওখানেই যেতে হয়। শিখা আবার বলে
-তাহলে তুমি যখন বুড়ো হয়ে যাবে তখন আমিও তোমাকে ওখানে পাঠিয়ে দিবো?
এতক্ষণ চুপচাপ খাটের উপর বসে ছিল রওনক, রাতুলের কথা শুনে চট করে ঘুরে তাকায়। দেখে শিখা হা করে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে ঘুরে তাকায় রওনকের দিকে। দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।
-কি হল মামনি বললে না, তুমি বুড়ো হলে তোমাকেও আমি ওল্ডহোমে পাঠিয়ে দিবো?
শিখা কোন কথা বলে না। আবার তাড়া দেয় রাতুল। এবার ধমকে ওঠে শিখা,
-রাতুল! বেশি পেকে গেছ তুমি! চুপ করে বসে থাক ওখানে।
কান্না শুরু করে রাতুল।
-ছেলেটাকে ধমকাচ্ছ কেন? এবার কথা বলে ওঠে রওনক
-তুমি শোননি ছেলে কি বলেছে? এতটুকু ছেলে এতবড় কথা! তুমি তো ওকে কিছুই বললে না!
-একটা বাচ্চা ছেলে একটা কিছু বলেছে তাই বলে ওকে বকতে হবে?
-বেশ করেছি, আমার ছেলেকে আমি শাসন করব, প্রয়োজন হলে মারব আবার আদরও করব। তুমি যখন ওকে কিছু বলনি, আমাকেও বাধা দিতে আসবে না
-বাহ! এমনভাবে বললে যেন ছেলে তোমার একার
-বলব না! ছেলে তো আমারই। সারাদিন ওর যত্ন নেয়া, স্কুলে আনা নেয়া করা, ছেলেকে লেখাপড়া করানো এমনকি অসুখ হলে রাত জেগে থাক- সবই আমাকে করতে হয়। তুমি কোনদিন এগুলো করেছ?
-বুঝলাম তুমিই সব কর, আমার সময় কোথায়! তাই বলে কিছু হলেই ছেলেটাকে ধমকা ধমকি করবে?
-দেখ, আমার থেকে ওর প্রতি বেশি দরদ তোমার নেই। ওর কিছু হলে তোমার আগে আমারই লাগবে। রাগে গজ গজ করতে থাকে শিখা। বির বির করে বলতে থাকে- মা’র চেয়ে মাসির দরদ বেশি!
থমকে যায় রওনক। কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়। শিখা বক বক করে কি যেন বলতে থাকে কিছুই ওর কানে ঢোকে না। ও চলে যায় বহু বছর পিছনে- ছেলেবেলায়। একটা ঘটনা মনে পড়ে যায়। রওনক তখন পাঁচ কি ছয় বছরের শিশু, মা’র খাওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য দৌড়ে ছাদে চলে যায় এবং লুকাতে গিয়ে একেবারে ছাদের কার্নিশে চলে যায়। মা দেখে কি যে ভয় পায়! ভাতের প্লেট ফেলে দিয়ে বলে বাবা তোমাকে আর খাওয়াব না, অনেক কৌশল করে ওর কাছে যায়। তারপর ওকে হাতের কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে সে কি কান্না! সেই ঘটনাটি রওনক আজও ভোলেনি! আজ আবার অনেকদিন পর সেই দৃশ্যটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কখন যে ওর দু’চোখ ভিজে ওঠে বুঝতে পারে না।
শিখা বুঝতে পারেনা হঠাত কি এমন হল! রওনকের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।
-কি হল তুমি এত ইমোশনাল হয়ে গেলে কেন?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রওনক বলে- ধন্যবাদ শিখা, তুমি আমার চোখ খুলে দিলে, তা না হলে আজ আমি অনেক বড় একটা অন্যায় করে ফেলতাম! এর জন্য নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতাম না। আজ নতুন করে বুঝলাম- মা’র চেয়ে আপন আর কেউ হতে পারেনা। শিখা যেন আর কিছুই বলতে পারে না। রওনকের বুকে মাথা রেখে ঢুকরে কেঁদে ওঠে। রওনক শিখার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে যাও ছেলেটাকে আদর কর, আমি একটু মায়ের কাছে যাই।
রওনককে আসতে দেখে যেন উতলা হয়ে ওঠে রওশন আরা। কিরে বাবা, সেই কখন থেক রেডি হয়ে বসে আছি! আমাকে নিয়ে যাবি না? বৃষ্টি তো কমে গেছে এখন। রওনক মায়ের সামনে এসে বসে পড়ে। মায়ের কোলে মাথা রেখে কেঁদে ওঠে। রওশন আরা ছেলের কান্না দেখে আরও উতলা হয়ে যায়। কিরে রওনক! কি হয়েছে তোর বাবা! কাঁদছিস কেন? মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়, আঙ্গুল দিয়ে চুলে বিলি কেটে দেয়। বোকা ছেলে, এভাবে কাঁদে! আমার বয়স হয়েছে। এই বয়সে কিছু কিছু পরিণতি তো মেনে নিতেই হবে! তাছাড়া তুইই তো বলেছিলি- প্রতি সপ্তাহে আমাকে দেখতে যাবি! ওঠ বাবা, চল। এখনো সন্ধ্যা হতে অনেক বাকি, এই সময়ের মধ্যে পৌঁছানো যাবে না ওখানে?
-মা তুমি কোথাও যাবে না। এখানে আমার সাথেই থাকবে
-সে কি কথা! বউয়ের সাথে রাগ করিস না বাবা। সংসারে শান্তি বজায় রাখতে হলে অনেক সময় এ রকম অনেক ডিসিশন নিতে হয়। এত ইমোশনাল হলে চলে!
-মা, তুমি আমাকে ছেঁড়ে, রাতুলকে ছেঁড়ে থাকতে পারবে?
আবার আনমনা হয়ে যায় রওশন আরা। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর ধরা গলায় বলে- কিছুটা কষ্ট তো হবেই, সে আমি ঠিক সামলে নেব।
-মা তোমার মনে আছে সেই যে ছেলেবেলায় ছাদ থেকে আমি পড়ে যেতে নিয়েছিলাম, তুমি অনেক বুদ্ধি করে আমাকে বাঁচিয়েছিলে!
রওশন আরা হাসে, তখন তো ছোট ছিলি, এখন তো আর সেই ভয় নেই রে বাবা!
ওদের কথার মাঝেই গ্লাসে করে দুধ নিয়ে আসে শিখা
-মা, আপনার দুধ
-দেখ তো বৌমা, সেই কখন থেকে রেডি হয়ে বসে আছি আর বৃষ্টিও থেমে গেছে এখন। ওকে বল আমাকে পৌছে দিয়ে আসতে।
শিখা এগিয়ে আসে শাশুড়ির কাছে। তড়পর হেসে বলে- আমার উপর রাগ করেছেন মা ? সন্তানরা ভুল করলে মা ক্ষমা না করলে কে করবে? আপনি আমাদের মাথার উপর থাকবেন, ছায়া দিয়ে।
বাবাকে সরিয়ে দিয়ে রাতুল দিদার কোল দখল করে নেয়। নাতিকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রওশন আরা। বাহিরে তাকিয়ে দেখে বৃষ্টি থেমে গেছে একেবারেই! মেঘ কেটে গিয়ে রোদ উঠেছে- ঝলমলে রোদ।
সুন্দর গল্প!
ধন্যবাদ শান্ত।
ধন্যবাদ শান্ত
এমন হ্যাপি এন্ডিং হয় না রে ভাইয়া আদতে! মা-বাবাদের জায়গা হয় ওল্ডহোমে ভালো দেখভালের দোহাই দিয়ে, ডাক্তার-নার্সের ভিড়ে সন্তান-সন্ততি হারাবার একাকীত্বে ততোধিক অসুস্থ হয়ে শেষে পরপারেই চলে যান, খালি করে দিয়ে যান তিলতিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নের সংসার! .।।।
কষ্ট লাগে, খুব কষ্ট কেন আমরা এমন করি, কেন জানোয়ার হয়ে যাই
তবুও আমাদের প্রত্যাশা সব মায়েরা যেন ভাল থাকে।
সুন্দর গল্প! কিনতু বাসতব জেবীন বলে দিয়েছে
বাস্তবতা জানি, আমরা চাইনা কোন বাবা মা'ই কষ্ট পাক।
খুব ভালো লেগেছে লেখাটি।
মন্তব্য করুন