বেলা অবেলা
খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল রঞ্জুর। পাশ থেকে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো মাত্র সাড়ে পাঁচটা বাজে। সেলিম ও পাভেল তখনও ঘুমাচ্ছে। আজ কয়েক রাত ধরে ঠিকমত ঘুম হচ্ছে না ওর। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে আজকাল! প্রায় প্রতিদিনই মা’র সাথে কথা হয় তবুও মায়ের মুখটা দেখতে না পাওয়ার অতৃপ্তি যেন থেকেই যায়। আরো কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে অবশেষে উঠে পড়ল। হাত মুখ ধুয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল, উদ্দেশ্য কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা।
বাইরে বেরিয়ে দেখলো রাস্তায় মানুষজন নেই তেমন। এ সময় রাস্তায় বেশী মানুষজন থাকার কথাও না। ভোরের আবহাওয়াটাও বেশ চমৎকার! মাঝে মাঝে দু একজন মাঝবয়সী লোককে দেখা যাচ্ছে রাস্তায় হাঁটতে, সম্ভবত অবসরপ্রাপ্ত। অল্প বয়সী কিছু স্বাস্থ্য সচেতন লোকজনও অবশ্য আছে, জগিং করছে। লোকজনের হৈ হল্লা বিহীন চুপচাপ শান্ত নিরিবিলি শহরটা ভীষণ ভাল লাগে রঞ্জুর। যানবাহনহীন ফাঁকা রাস্তা, রিকশা গাড়ির অযথা হর্ণ নেই, মানুষজনের কোলাহল নেই। হরতালে অবশ্য লোকজন কমই থাকে রাস্তায়। রঞ্জু হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ডে এসে পড়ল। মেইন রোডেও লোকজনের ভিড় নেই তেমন একটা। মাঝে মাঝে কিছু বাস ও হালকা যানবাহন চলতে দেখা যাচ্ছে। রাস্তার পাশের টং দোকানগুলো সবে খুলতে শুরু করেছে দোকানীরা, অবশ্য তাদের মাঝে তেমন ব্যস্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফাঁকা ফুটপাত ধরে কিছুক্ষণ হাঁটলো ও, ফুটপাতের উপরেই হকারদের অস্থায়ী বন্ধ দোকানগুলো পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। আর কিছুক্ষণ পরই এগুলো খোলা হবে, আবার কোলাহল মুখর হয়ে উঠবে এ জনপদ। এই নিরিবিলি ঢাকা অন্যরকম! কয়েক বছর হল ও ঢাকা এসেছে কিন্তু এত ভোরে কখনো বের হওয়া হয়নি, মনে মনে ভাবে ইশ! এ রকম যদি থাকতো সবসময়! অবশ্য জানে এরকমটা হওয়ার নয়, আর ঢাকাকে সেটা মানাবেও না। কিছুক্ষণ পর ফেরার পথ ধরল রঞ্জু।
রুমে ফিরে দেখে সেলিম ও পাভেল উঠে বাইরে যাবার জন্য তৈরী হয়ে গেছে ততক্ষণে! ওকে দেখে সেলিম বলে উঠলো- সাহেব কি প্রাতভ্রমণে গিয়েছিলেন নাকি?
-সকালের ঢাকা যে এত শান্ত আগে কখনো খেয়াল করে দেখিনি!
-ভায়া, আমাদের কাছে ইহা নতুন কিছু নয়, আমরা রোজই দেখি!
ওরা বের হয়ে গেলে একা ঘরে আর ভাল লাগে না রঞ্জুর। ভার্সিটি বন্ধ থাকায় সারাদিন কোন কাজ নেই, টিউশনীগুলোও সব বিকালে। অলস সময়গুলো আর যেন কাটতে চায় না। টিউশনীগুলো না থাকলে বাড়িতে যেতে পারত! সারাদিন শুয়ে বসে ও বই পড়ে পার করল রঞ্জু।
বিকেলে টিউশনীর জন্য বের হল। আজকের দুটো টিউশনীই ধানমন্ডিতে। ইদানিং টিউশনী করতে আর ভাল লাগে না। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়, কেবলই মনে হয় প্রাইভেট টিউটররা বড়লোকদের কাছে তাদের বাড়ির কেয়ারটেকার কিংবা ড্রাইভারদের মতই বেতনভোগী একজন, এর বেশী কিছু নয়! বাসায় গিয়ে অনেকক্ষণ ছাত্র ছাত্রীর জন্য বসে থাকা, তারপর তাদের মন জুগিয়ে পড়ানো, রেজাল্ট খারাপ হলে টিউটরেরই দোষ! মাঝে মাঝে মন বিদ্রোহ করে বসে কিন্তু ছেঁড়ে দিতে পারেনা! মায়ের উপর খুব চাপ পড়ে যাবে।
বাবা মারা যাবার পর থেকে মা একাই আগলে রেখেছেন ওদের দু ভাই-বোনকে। কখনো বুঝতে দেননি বাবা না থাকার কষ্ট! মায়ের ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর চাকরী নিয়ে গ্রামের অনেকেই নানান কথা বলেছে, মা নিরবে সহ্য করে গেছে সব শুধুমাত্র ওদের দু’ভাই বোনের কথা ভেবে। আজও করছেন, কিন্তু আর কত? মাকে আর কত কষ্ট দিবে? তাই নিজের খরচটা অন্তত নিজেই আয় করে নেয়ার চেষ্টা রঞ্জুর।
বাসা থেকে মেইন রোড পর্যন্ত সবসময় হেঁটেই আসে রঞ্জু, আজও তাই করলো। আজ হরতালের কারণে অবশ্য বাসে ওঠা ঠিক হবে না। বিরোধী দলের ডাকা টানা দুইদিনের হরতালের দ্বিতীয় দিনে আজ সারা ঢাকা শহরে থমথমে অবস্থা। গতকাল দুইজনের মৃত্যুতে আজকে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা অনেক কম, তবে রিকশার সংখ্যা বেড়ে গেছে অনেক। ফাঁকা রাস্তায় রিকশায় চড়তে বেশ লাগে রঞ্জুর। অল্পক্ষণের মধ্যেই ধানমন্ডি পৌছে গেল ও। কলিং বেল বাজাতেই ভিতর থেকে জোড়ালো কন্ঠে শোনা গেল- কে?
এই ব্যাপারটা একদমই ভাল লাগে না ওর। এভাবে বাজখাই কন্ঠে চিৎকার করে জিজ্ঞেস না করলেই কি নয়? মিররে তাকালেই তো দেখা যায় দরজায় কে দাঁড়িয়ে! কোন জবাব না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো ও। কিছুক্ষণ পর কাজের লোকটি এসে দরজা খুলে দেয়। এই টিউশনীটা নতুন। মাত্র এক সপ্তাহ হল পড়াতে শুরু করেছে। ভিতরে ঢুকে ছাত্রের পড়ার রুমে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর ছাত্রের মা আসে
-সামনে পরীক্ষা, এ ক’দিন আপনি একটু বেশী সময় দেন। গত পরীক্ষায় ও রেজাল্ট বেশ খারাপ করেছে।
-ঠিক আছে তা না হয় দিলাম কিন্তু শিপলুর পড়ালেখায় তো মনোযোগ কম। আমি চলে যাবার পর মনে হয় বাসায় ঠিকমত পড়ে না।
-ও একটু চঞ্চল প্রকৃতির কিন্তু ছাত্র খারাপ না। আগের টিচার ঠিকমত পড়াত না, তাই আপনাকে রাখা।
রঞ্জু যা বোঝার বুঝে নেয় কিন্তু মুখে কিছুই বলে না। মনে মনে ঠিক করে ফেলে এখানে আর পড়ানো যাবে না। আরও প্রায় পনের মিনিট পর ছাত্র মহোদয়ের আসার সময় হয়। যেন অনেকটা বিরক্ত।
-স্যার, আজ কিন্তু আমি বেশীক্ষন পড়ব না
রঞ্জু বেশ গম্ভীর। কিছু না বলে পড়ানো শুরু করে, প্রায় দু ঘন্টা পড়িয়ে চলে আসে।
অল্প কিছু দুরত্বেই অন্য টিউশনীটা। রঞ্জু হেঁটেই চলে যায় এই পথটুকু। এখানে তেমন সমস্যা নেই, ছেলেটা পড়াশোনায়ও বেশ ভাল। বাসায় গিয়ে দেখা যায় ছাত্রটি বাসায় নেই, মায়ের সাথে ডাক্তারের কাছে গেছে। ওর বাবা এসে বলে তুমি বস, ওরা হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। ড্রয়িং রুমে বসে পত্রিকা পড়ছিল রঞ্জু
-আপনি কোথায় পড়েন?
হঠাৎ মেয়েকন্ঠ শুনে পত্রিকা থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে সেদিনের সেই মেয়েটি সামনে দাঁড়িয়ে। রঞ্জু মনে মনে ভাবে- এই আপদ আবার কেন! সেদিন এত ঝগড়া করার পর আজ আবার এসেছে! কিছুক্ষণ পর রঞ্জু উত্তর দেয়- ঢাকা ইউনিভার্সিটি
-কোন সাবজেক্টে?
-ফিজিক্স
-কোন ইয়ারে ?
-থার্ড ইয়ারে।
-ও, আমিও এবার ভর্তি হয়েছি
-ভাল
-আপনার জানতে ইচ্ছে হলনা আমি কোন সাব্জেক্টে পড়ি
-ও হ্যা, আপনি কোন সাব্জেক্টে?
মেয়েটি হেসে বলে আপনি বোধহয় এখনও রেগে আছেন। সরি, সেদিন আপনার সাথে অনেক বাজে ব্যবহার করেছি। আসলে আমি বুঝতে পারিনি। কিছু কিছু ছেলেদের উপর আমি বেশ বিরক্ত! মাঝে মাঝে বড্ড বেশি বিরক্ত করে, আর এমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে যেন মনে হয় এই প্রথম কোন মেয়ে দেখছে।
রঞ্জু হেসে জবাব দেয়, সবাই তো এমন না!
-এটা ঠিক যে সবাই এমন না, কিন্তু চেহারা দেখে তো বোঝা সম্ভব না কে কেমন!
-চেহারা দেখে বোঝার দরকার নেই, কেউ যদি আপনার সাথে খারাপ আচরণ করে, আপনি শুধু তাকেই বলতে পারেন। তাই বলে সবাইকে ঢালাওভাবে খারাপ ভাবার কোন কারণ নেই।
-আপনার কথাই হয়ত ঠিক!
জবাবে রঞ্জু একটু হেসে জিজ্ঞেস করে, ওদের আসতে বোধহয় আরও দেরী হবে, আমি কি অপেক্ষা করব নাকি আজ চলে যাব?
-ভাইয়া কি আপনাকে বলেছে ওরা তাড়াতাড়ি এসে পড়বে?
-হ্যা, সে রকমই তো বললেন!
-তাহলে আপনি আজ চলে যেতে পারেন, ভাবীদের আসতে দেরী হবে। আমাকে বলে গেছে।
রাত সাড়ে আটটা। রঞ্জু বের হয়ে দেখে রাস্তা মোটামোটি ফাঁকা। বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এসে একটা রিকশাও পেয়ে যায়। ব্যাটারি চালিত রিকশা, হরতালের ফাঁকা রাস্তায় রঞ্জুকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে চলল। নিউ মার্কেট পার হয়ে আজিমপুরের দিকে ছুটে চলছে পঙ্খিরাজ, আচমকা পাশ থেকে একটা কিছু এসে রিকশার সামনের দিকে লাগলো। রিকশাওয়ালা লোকটা আর্তনাদ করে ওঠলো। একটু এগিয়েই রিকশাটা থেমে যায়। রঞ্জু চমকে ওঠে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? লোকটি একহাত ঝাকাতে ঝাকাতে বলে- কেডা জানি ইডা ছুইড়া মারছে। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে রঞ্জু বুঝলো হরতাল সমর্থনকারী কোন পিকেটারের কাজ। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলো- খুব বেশি ব্যাথা পেয়েছেন?
লোকটা সামনে কি যেন চেক করতে করতে বলে- ব্যাথা খুব বেশি পাইনাই, তয় আর যাওয়া যাইব না ভাই
-কেন, ভয় লাগছে?
-আমগো ভয় পাইলে পেট চলবো না ভাই, তয় রিকশা আর চলব না, মনে অয় তার ছিইড়া গ্যাছে, ব্যাটারির লাইন পায়না।
-আর তো বেশী দূর না, এটুকু জায়গা প্যাডেল মেরে যেতে পারবেন না ?
-আমার পায়ে একটু অসুবিদা আছে, আমি প্যাডেল মারতে পারিনা।
এতক্ষণ খেয়াল করেনি, রিকশা থেকে নামতেই রঞ্জু দেখতে পায় লোকটির একটি পা নেই! মনটা খারাপ হয়ে যায়।
-এই নষ্ট রিকশা নিয়ে আপনি কিভাবে ফিরবেন ?
-অসুবিদা অইব না ভাই, অন্য রিকশার সাথে বাইন্ধা গ্যারেজে নিয়া যামু।
রঞ্জু লোকটিকে নির্ধারিত ভাড়ার কিছু বেশি দিয়ে ফেরার পথ ধরল। হরতালের কারণে রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা। সোডিয়াম লাইটের হালকা আলোতে হাটছে আর ভাবছে কত বিচিত্র মানুষের জীবন! আমাদের জীবনের কত ছোট খাটো কষ্ট নিয়েই আমরা বিমর্ষ হয়ে পড়ি আর এই লোকগুলো প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলেছে বেঁচে থাকার জন্য। হয়তো তার আয়ের উপরেই নির্ভর করে আছে অনেকগুলো মুখ! আজ হরতালের কারণে তার অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। পরিবারের সবার মুখে হয়তো আজ অন্ন জুটবে না ঠিকমত। আমাদের সমাজে যারা বড় বড় কথা বলেন, জনদরদী বলে নিজেদের জাহির করেন তারা কি এইসব খেটে খাওয়া মানুষগুলোর কথা ভাবেন কখনও?
আমাদের অনেকেরই প্রতিদিনের গল্পটাকে খুব সাবলীল ভাবে বর্ণনা করলেন...
সাদামাটা জীবনের গল্প। পড়ার জন্য ধইন্না
জীবন থেকে নেয়া সুন্দর গল্প!
লেখাটা পড়ার পুরোটা সময় রঞ্জুকে নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। শেষ পর্যন্ত তার কিছু না হওয়াতে এক স্বস্তি পেলাম। পাঠককে লেখার সঙ্গে জড়িয়ে নেয়ার একটা সহজাত গুণ আপনার আছে নিভৃতাদা'। যেটা আমার সবচাইতে বেশি ভালো লাগে
#নিভৃতাদা'=নিভৃতদা'
সে রকম চিন্তা যে মনে আসেনি বলব না, তবে শেষ পর্যন্ত জটিলতা ছাড়াই শেষ করলাম। এটা খুব সাধারণ জীবনের গল্প, আপনার আজকের লেখাটা আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে।
আসলে চারিদিকে এত জটিলতা, এত জটিলতা যে আজ সারাদিন মোটামুটি পালিয়েই আছি সবকিছু থেকে। তাই জটিলতার ভয় পাচ্ছিলাম। ভালো করেছেন ভাইজান। জটিলতা না এনে।
আমিও সবার মত ভাবি, ...হাত দিয়ে মুখে,
কবে যে আসবে সুদিন, থকবে সবাই সুখে।
হ, সুদিন আসুক, সবাই সুখে থাকুক
আমাদের অনেকেরই প্রতিদিনের গল্পটাকে খুব সাবলীল ভাবে বর্ণনা করলেন...
আপনারে ধইন্না পড়ার জন্য।
খুব সাবলীল ভঙ্গিমার সাহিত্য চর্চা! এগিয়ে যান!
মন্তব্য করুন