গন্তব্য (প্রথম পর্ব)
একটা অদ্ভুত হাহাকার আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো পুরোটা সময়। অস্তিত্বহীনতার অমোঘ নিয়তির প্রহরগুলো দারুণভাবে রেখাপাত করেছিলো ছোট্ট দু’টি স্বত্বাজুড়ে। প্রবল মনের জোরে কিশোর বয়সের সীমা ছাড়িয়ে হঠাৎ যেন বড় হয়ে উঠেছিলো মাত্র এগারো বছরের কলিম। সময়ের প্রয়োজনে নিজের থেকে কেবল দুই বছরের ছোট ভাই রতনের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলো। আর কোন এক অলৌকিক উপায়ে মায়ের অন্তিম সময়ের ভারী দেহটিকে বহন করার শক্তি অর্জন করেছিলো। প্রকৃতিই যেন সবকিছু নির্ধারণ করে দেয়, মানুষ কেবল প্রকৃতির সীমারেখায় সমান্তরালভাবে নিরন্তর ছুটে চলে চেনা গন্তব্যে।
অনেকক্ষণ ধরে আকাশে চক্কর দিচ্ছিলো শকুনটা। ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছিলো নীলগঞ্জ আর গোসাঁইপুরের মাঝখানে দিগন্তবিস্তৃত বিলের মধ্য দিয়ে মোটা দড়ির মত মাটি আঁকড়ে থাকা কাঁচা সড়কটার উপর। পাশের বিলে থই থই পানি। আশপাশের কয়েক মাইলের মধ্যে লোকালয়ের চিহ্ন নেই। ভাদ্র মাসেও মেঘহীন আকাশ। হাওয়াশূণ্য রোদ্দুরে খাঁ খাঁ করা খোলা জলাভূমিটা সম্পূর্ণ স্থির। মৃত্যুর মত নিস্তব্ধ সময়টাতে বৃক্ষবিহীন ফাঁকা রাস্তাটার কোথাও কোন ছায়া নেই। রাস্তাটির দু’পাশে নল-খাগড়া আর জংলি লতাপাতায় পরিপূর্ণ পানিতে সাপ আর জোঁকের আখড়া।
রাস্তা থেকে অনেক দূরে ভরা বিলের মাঝে ডিঙ্গি নৌকার উপর দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে জমির শেখ। ভাবছে- ‘এই অসময়ে শকুনটা এলো কোত্থেকে? অনেকদিন এই তল্লাটে এ প্রাণি দেখা যায়নি।‘ জমির শেখ কপালে হাত রেখে রোদ আড়াল করে বড় সড়কটির দিকে তাকায়। প্রায় দুই মাইল দূরের রাস্তাটিকে ঝাপসা লাগে। বাঁক খাওয়া সড়কটির যেখানে ভেঙ্গে খাদের সৃষ্টি হয়েছে, তার ঠিক ওপাশে কিছু মানুষের অবয়ব চোখে পড়ে অস্পষ্টভাবে। জমির শেখ নিজের মনেই বলে, ‘আবার কারা আটকা পড়লো?’ দুপুরের কড়া রোদে লু হাওয়ায় ঠিকমত ঠাহর করতে পারেনা সে। আরও কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বিফল হয়, তারপর বাড়ির দিকে ঘুরিয়ে দেয় নৌকার মুখ।
চারিদিকে থই থই জলরাশির মাঝে কাঁচা রাস্তাটার উপর কেবলমাত্র দুটি প্রাণি আর ভ্যানের উপর শোয়ানো ওদের মায়ের দেহটি ছাড়া আশেপাশের কয়েক মাইলের মধ্যে কোন জনমানবের সাড়া নেই। দূরের গ্রামগুলো অনেকটাই ঝাপসা লাগে। মধ্যগগনে পূর্ণযৌবনা গনগনে সূর্য্যটা অকৃপণভাবে আগুনের হল্কা ছড়াচ্ছিলো। রতন কিছুক্ষণ পর পর কাপড়ে ঢাকা মায়ের দেহটিকে দেখে, তারপর বড় ভাই কলিমের মুখের দিকে তাকায়। সে চোখে হাজারো প্রশ্ন ভিড় করে। কলিম ছোট ভাইয়ের করুণ চোখের দিকে তাকাতে পারে না। বুঝে গিয়েছে আজ থেকে ও-ই রতনের অভিভাবক।
-ভাই, আর কতক্ষণ এইহানে বইয়া থাকুম আমরা? কিছুক্ষণ পর বড়ভাই কলিমের উদ্দেশ্যে বলে রতন।
-জানিনা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলিম। মনে অয় অনেক সময় লাগবো। পানি না কমলে ভ্যান নিয়া যাওন যাইবো না। ভ্যানের উপর মায়ের নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে বলে কলিম।
নীলগঞ্জ সদর হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে প্রায় পাঁচ মাইল দীর্ঘ এবড়ো-থেবড়ো পথ পেরিয়ে কলিমের ভ্যানটা এই খাদের কাছে এসে আঁটকে গেছে। উদাস চোখে ভাটার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা ওর। নীলগঞ্জ থেকে গোসাঁইপুরের দিকে ছুটে চলা কাঁচা সড়কটা এই জায়গাটায় এসে হঠাৎ থমকে গেছে। গত বন্যায় ভেঙ্গে যাওয়া খাদটি রাস্তাটিকে দ্বিখন্ডিত করে রেখেছে। বছর শেষ হয়ে গেলেও রাস্তাটি মেরামত করা হয়নি আর। জোয়ার-ভাটায় পানির উচ্চতার সাথে তাল মিলিয়ে চলাফেরা করে এখানকার মানুষ।
ভাটা শুরু হয়েছে মাত্র। কিছুক্ষণ পর পর কলিম দেখে পানি কতটুকু কমলো। পানি হাটু সমান উচ্চতায় নেমে এলে রওনা দিবে ওরা। মাথার উপর সূর্য্যটা যেন আরও নির্মম হয়ে ওঠে।
-ভাই, কাইল বিহালে তো এত পানি আছিলো না!
-বুঝতাছি না রে রতন, আগে তো একলা এইদিকে আহি নাই!
ভাবনায় পড়ে যায় কলিম। কিশোর কলিমের ধারনা ছিলোনা গতকাল বিকেলে অসুস্থ মাকে হাসপাতালে নেয়ার সময় দেখা অল্প পানির খাদটি আজ এই সময়ে বুক সমান পানিতে ডুবে যাবে।
মাথার উপরে চক্কর দেয়া শকুনটির দিকে তাকিয়ে রতন বলে- ভাই, অইডা কি উড়তাছে আকাশে?
আকাশের দিকে তাকায় কলিম। মাথার উপর শকুনের ওড়াউড়ি দেখে কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠে। খাদের ঢাল থেকে একটু দূরে ভ্যানটার দিকে তাকায়। -আয় তো রতন! তাড়াতাড়ি উঠে ভ্যানের কাছে যায়।
-ভাই, কইলা না ঐডা কি?
-ঐডা শগুন, হুনছি এইগুলান নাকি মরা খায়। বাজানের লগে বিলে আইসা একবার দেখছিলাম মরা গরু খাওয়ার লাইগ্যা দুইডা শগুন এইরহম আকাশে উড়তাছিলো।
রতন ভয় পায়। -ভাই, ঐডা কি আমগো দিগে আইবো?
কলিম কিছু বলে না, কেবল লক্ষ্য করে উড়ন্ত শকুনটার গতিবিধি। ভ্যানের উপরে মায়ের ছোট্ট দেহটি লম্বালম্বিভাবে শোয়ানো। পা দু’টো বাহিরে কিছুটা ঝুলে আছে। তাঁর পরনের কাপড়ের আঁচল দিয়েই মুখমন্ডল আরও ভাল করে ঢেকে দেয় কলিম।
-ভাই, মায় আর ফিরা আইবো না? রতন জিজ্ঞেস করে।
একটা চমক লাগে কলিমের। চট করে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকায় কলিম। মনে পড়ে যায়- ঠিক এই প্রশ্নটাই রতন মাকে করেছিলো মাত্র তিনমাস আগে, যখন বাবার নিষ্প্রাণ দেহটা শোয়ানো ছিলো বাড়ির উঠোনে। ছোট ভাইটির দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন করে ওঠে কলিমের।
বাবার চলে যাওয়ায় সেদিন বিরাট একটা ধাক্কা খেয়েছিলো কলিম। নিজের চোখের সামনে জলজ্যান্ত বাবাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। বাবার মৃতদেহের কাছে বাকরুদ্ধ হয়ে বসেছিলো অনেকক্ষণ। তারপর জোরে একটা চিৎকার দিয়ে উঠেছিলো। সেই চিৎকারে সবাই ছুটে এসেছিলো ওদের বাড়ির উঠোনে। আজ মা চলে যাবার দিন কেউ নেই ওদের পাশে। আজ ওকে একাই সংগ্রাম করতে হচ্ছে, ছোট ভাইটিকেও সামলাতে হচ্ছে।
ভ্যানের উপর শোয়ানো মায়ের দেহটির পাশাপাশি বাবার মুখটা ভেসে ওঠে মনে। কি সুখ-শান্তি, আদর-স্নেহে ভরা ছিলো ওদের জীবন! বাবা-মা দুজনেই আগলে রেখেছিলো ওদের দু’ভাইকে। মাছপাগল বাবার সাথে কতদিন এই বিলে এসেছে ও! ঘরের বাইরে নেমে দক্ষিণে তাকালেই দিগন্ত বিস্তৃত বিলের থৈ থৈ পানি হাতছানি দিয়ে ডাকতো মালেক ঢালীকে। শক্ত সামর্থ্য মানুষ ছিল মালেক ঢালী। কি নিখুঁত নিশানা! বাজপাখীর ক্ষিপ্রতায় পানির নিচে মাছের নড়াচড়া লক্ষ্য করে সপাং করে ছুড়ে মারতো কোঁচ, যা বেশীরভাগ সময়ই ছিল অব্যর্থ। আঁধার রাতে পাঁচ ব্যাটারীর টর্চ নিয়ে বাবার সাথে কতদিন বিলের পানিতে নৌকা ভাসিয়েছে কলিম!
‘বাপজান, অইহানে আলোডা ফ্যালতো’, কলিম বাপের দেখানো স্থানে আলো ফেলতেই চোখে পড়েছিলো লালচে লেজের সামান্য নড়াচড়া। মালেক ঢালীর জন্য ওটুকুই ছিল যথেষ্ট। সপাং করে কোঁচটা ছুটে গিয়েছিলো মাছের পিঠ বরাবর। বাপ-ছেলের মুখে হাসি ফুটেছিলো। বাপকে এমন হাসি আরও অনেকদিন হাসতে দেখেছিলো কলিম; নিজেও হেসেছিলো। তারপর একদিন সেই হাসি থেমে গিয়েছিলো একেবারেই।
নিখুঁত চোখের দৃষ্টি আর অব্যর্থ ক্ষিপ্রতা ছিল যার, সেও একবার ভুল জায়গায় পা ফেলেছিলো। আর সেই ভুলই তার জন্য কাল হয়ে দেখা দিয়েছিলো। জীবনে আর ভুল করার সুযোগ মেলেনি মালেক ঢালীর। সেদিন হাত থেকে ছুটে যাওয়া কোঁচটা তুলতে নৌকা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিলো বিলের মধ্যে জমানো আগাছার স্তূপের উপর। হিসহিস শব্দটা কানে যাবার সাথে সাথেই সতর্ক হয়েছিলো মালেক, কিন্তু নৌকায় উঠতে কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিলো তার। হাঁটুর নিচে অব্যর্থ ছোবল খাওয়ার সাথে সাথেই একলাফে উঠে এসেছিলো নৌকায়। ‘বাপ, আমারে কেউটেয় কাটছে, জলদি নৌকা ঘুরা’ বলে কোমর থেকে গামছাটা খুলে নিয়ে হাটুর উপরে শক্ত করে বেঁধে ছেলের সাথে লগি চালিয়ে ফিরে এসেছিলো বাড়িতে। কিন্তু ঘরে ফেরা হয়নি তার। ঘরের সামনের ছোট্ট উঠোনে সেই যে আছড়ে পড়েছিলো, আর ওঠেনি।
কলিমের চোখ দু'টো ছলছল করে ওঠে।
চলবে...
অনেকদিনপর আপনার লেখা পড়লাম। চলুক।
কেমন আছেন ভাইয়া?
হুম, অনেকদিন পর এলাম এবি'র উঠোনে
ভাল আছি। তুমি তো দারুণ লিখে চলেছ! মাঝে মাঝে পড়াও হয়েছে। সময়ের অভাবে লগইন করা হয়নি আর কমেন্টও করা হয়নি।
ভাল থেকো অনেক।
পড়ছি, চলুক
দ্বিতীয় পর্বেই শেষ।
আজকেই পোষ্ট করবো।
মন্তব্য করুন