গন্তব্য (শেষ পর্ব)
রতন আবার ভাইকে প্রশ্ন করে;
-ভাই, কতা কওনা ক্যান? মায় আর আমার লগে কতা কইবো না?
কলিমের খুব কান্না পায়। অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলায়। ভাইকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
-মানুষ মইরা গ্যালে আর ফিরে আহে নারে ভাই। আমগো মায় আর কতা কইবো না।
রতন কাঁদতে কাঁদতে বলে- তইলে মেডিকেলে বইয়া কইছিলি ক্যান যে মায় ভাল অইয়া যাইবো?
কলিম উত্তর দিতে পারেনা। ভাইয়ের কাছ থেকে নিজেকে লুকাতে খাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। রতনকে কি বলবে ও? নিজের বুকে পাথর চেপে ভাইকে সান্ত্বনা দিয়েছিলো। মায়ের শেষ সময়ের করুণ চোখের চাহনি বুকের ভিতর আলোড়ন তোলে। রাত্রির শেষ প্রহরে মায়ের অন্তিম মূহুর্তের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের ছবিটা ভুলতে পারে না। যাকে দু’দিন আগেও মা মুখে ভাত তুলে দিয়েছে সেই অবুঝ ছোটভাইটিকে কাল রাত্রে বলতে পারেনি- ওদের মা আর বেঁচে নেই।
মায়ের অকাল মৃত্যু কলিমকে মুহুর্তেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো। মাত্র এগারো বছরের কলিম হয়ে উঠেছিলো একজন জীবন যোদ্ধা। কাউকে বলে দিতে হয়নি- ওর কি করণীয়। মাতৃপিতৃহীন অনাথ কিশোরটি একমাত্র ছোট ভাইটিকে নিয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে নামতে হয়েছিলো।
ভোর হতে তখনও অনেক বাকি। হাসপাতালের পাওনা পরিশোধ করার চিন্তাটা কেবলই ঘুরে ফিরে মাথায় আসছিলো। শিক্ষিত ভদ্র মানুষগুলোর নির্মম আচরণ ওকে মনে করিয়ে দিয়েছিলো- বাস্তবতা কত কঠিন! খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পেরেছিলো- এ পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে কারো উপর নির্ভরশীল হওয়া চলবে না। কারো জন্য অপেক্ষা করে থাকলেও হবে না। নিজে বাঁচতে হবে, ছোট ভাইটির মুখের অন্নও যোগাতে হবে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই ভ্যানটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলো কলিম। টাকা জোগাড় করতে হবে, মায়ের মৃতদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। টাকার অভাবে মায়ের লাশ হাসপাতালে পড়ে থাকবে? নিজেই নিজেকে বলেছিলো- ‘তাই কি হয়! কলিম এহনো বাইচা আছে না?’। গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাটাকে আটকে রেখে ছোট ভাইটিকে বলেছিলো-‘তুই মার কাছে থাক, আমি টাকার জোগাড় কইরা আইতাছি।‘ সেই কাকভোরে ভ্যান নিয়ে চলে গিয়েছিলো ষ্টেশনে। বুকের ভিতর চাপা কষ্টের দাগ কেউ দেখতে পায়নি। কয়েক ঘন্টা মানুষ আর মালামাল টেনে কলিম যখন হাসপাতালের পথ ধরলো ভাদ্র মাসের সূর্য্য তখন তার স্বরূপ দেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
খাদের কাছ থেকে কলিম ঘুরে তাকায়। রতন তখনও মায়ের দেহকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলো। ছোট ভাইয়ের কাছে এগিয়ে যায়।
-কান্দিসনা ভাই। আমগো কপালডাই খারাপ। আইজ থেইক্যা আমরা এতিম অইয়া গেলাম।
রতন তখনও ঢুকরে ঢুকরে কাঁদছিলো। -মায় ক্যান মইরা গ্যালো?
কলিম রতনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে- চিন্তা করিস না ভাই, আমি বাইচ্যা থাকতে তোর কোন কষ্ট অইবো না।
রতন তখনও মায়ের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থাকে, দু’চোখ বেয়ে নামে বাঁধভাঙা অশ্রুর ধারা।
কলিম উঠে গিয়ে আবার দেখে পানির উচ্চতা কতটুকুতে নামলো। মাথার উপর দগদগে সূর্যটা একটু একটু করে পশ্চিম দিকে হেলে পড়ছে। পেটের ভিতরে রাক্ষুসে ক্ষুধাটা জানান দিচ্ছে বার বার। কলিম রতনের দিকে তাকায়, মনে পড়ে গতকাল রাতে ছোট এক টুকরা পাউরুটি ছাড়া দু’ভাইয়ের পেটে আর কিছুই পড়েনি। এই প্রতিকূল পরিস্থিতি ছোট্ট রতনকেও ভুলিয়ে দিয়েছে ক্ষুধার কষ্ট।
অপেক্ষার প্রহরগুলো বড় দীর্ঘ। আশেপাশের বিরুপ প্রকৃতি এই সময়টাকে আরও অসহনীয় করে তোলে। প্রচন্ড গরমে অস্থির হয়ে উঠেছে রতন। গা থেকে জামা খুলে বিলের পানিতে ভিজিয়ে আবার গায়ে জড়িয়ে নেয়। হঠাৎ সামনের পানির দিকে চোখ পড়তেই দেখে একটা সাপ পানিতে সাতার কেটে এদিকেই আসছে। রতন ভাইকে দেখায়।
-ভাই দেহো, সাপটা আমগো দিগেই আইতাছে,
কলিম তাকিয়ে দেখে একবার। বলে-আউক।
-যদি কামড় দেয়?
-এইডা ডোরা সাপ, ডরের কিছু নাই।
কলিম আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে শকুনটা চলে গেছে। সূর্য্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে, রোদের তাপও কমে এসেছে কিছুটা। কলিম আবার খাদের কাছে গিয়ে পানির উচ্চতা পরীক্ষা করে।
-ভাই, এহন যাওন যাইবো না? রতন জিজ্ঞেস করে।
-না রে রতন, এহনও প্রায় কোমর সমান পানি, ভ্যান ডুইবা যাইবো।
-তাইলে আমরা আর কতক্ষণ বইয়া থাকুম? মার খুব কষ্ট অইতাছে, তাই না ভাই?
কলিমের মনে পড়ে ওদের মসজিদের হুজুর বলেছিলো- মানুষ মরে গেলে তার শরীরে খুব ব্যথা হয় কিন্তু সে বলতে পারে না। কলিম নিজের জামাটা খুলে কাপড়ে ঢাকা মায়ের দেহটির উপরে বিছিয়ে দেয়। ভাইয়ের দেখদেখি রতন তার ভিজা জামাটা দিয়ে মায়ের পা দু’টো ঢেকে দেয়।
অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহর একসময় শেষ হয়। সূর্য্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে অনেকটাই। রোদের তেজও কমে গেছে। কলিম আবার খাদের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। পানি কমে গিয়ে হাঁটুর কাছাকাছি উচ্চতায় নেমেছে। কলিম ভাবে- ‘এইবার যাওয়া যাইবো।‘
-রতন ধর তো ভাই, রশি দিয়া মার দেহটারে ভাল কইরা আটকাইয়া নেই।
-ভাই, মা’রে বান্ধতাছো ক্যান?
-রশি দিয়া ভালমত আটকাইয়া না নিলে মার দেহ ঐ উঁচা-নিচা গর্তে পইড়া যাইবো।
রতন বুঝতে পেরে আর কোন কথা বলে না। বড়ভাইয়ের কথামত কাজ করে চলে শুধু।
-আয় রতন, এইবার আমরা রওনা দেই
ধীরে খাদের নামে ওরা। কলিম হ্যান্ডেল ধরে ভ্যানটাকে সামনের দিকে টেনে চলে আর রতন পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। উঁচু-নিচু কাদামাটিতে বার বার ভ্যানটা আটকে যাচ্ছিলো। ছোট্ট রতনের পক্ষে নিজেকে সামলে ভ্যান ঠেলা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। কলিম বুঝতে পেরে ছোট ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
-রতন তুই খালি ভ্যানের পিছনডা ধইরা রাখ।
-আইচ্ছা।
রতন প্রাণপণে চেষ্টা করে ভ্যানটা ধরে রাখার, কিন্তু উঁচু-নিচু পিচ্ছিল খাদের পানিতে পড়ে যায় হঠাৎ। কলিম পিছন ফিরে তাকায়। ভ্যান ছেড়ে ভাইকে ধরার উপায় থাকে না। ছোট ভাইয়ের উদ্দেশ্যে শুধু বলে,
-রতন সাবধানে চল ভাই। রতন উঠে দাঁড়ায়, আবার পেছন থেকে ধাক্কা দেয়।
অল্প জায়গার খাদটি পার হতে দুই ভাইয়ের অনেক সময় লেগে যায়। মায়ের দেহটি নিয়ে যখন ওরা খাদের ওপারে ওঠে- সূর্য্য তখন পশ্চিম আকাশের শেষ প্রান্তে নেমে এসেছে। দূরে গ্রামগুলোর গাছের মাথা ছুঁই ছুঁই।
-ভাই, আন্ধার হওয়ার আগে আমরা বাড়ি যাইতে পারুম?
-দেহি!
কলিম রতনের দিকে তাকায়; বোঝে ক্ষুধা তৃষ্ণায় ও বেশ ক্লান্ত।
-তুই পেছন থেইক্কা জোরে ধাক্কা দিতে পারবি না রতন?
রতন জবাব দেয়- হ, পারুম। ভাই, তোমার পায়ে কত্তবড় একটা জোঁক! হঠাৎ কলিমের পায়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে রতন।
কলিম পিছনে ঘুরে পায়ের দিকে তাকায়। জোঁকটা গোড়ালির উপর থেকে প্রায় হাঁটু কাছাকাছি পর্যন্ত লম্বালম্বিভাবে আঁকড়ে আছে। রাস্তার পাশের ঝোপ থেকে কাঠি নিয়ে জোঁকটা ছাড়ায়। রক্তের লাল ধারাটা পা বেয়ে নেমে আসে। রতন ভাইকে বলে,
-ভাই, রক্ত পড়তাছে তো। তুমি একটু খাড়াও।
কিছু দুর্বাঘাস দু’হাতে ডলে কলিমের পায়ের ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয় রতন। রক্ত পুরোপুরি বন্ধ হয় না।
কলিম বলে- থাউক আর কিছু দেওন লাগবো না, রক্ত পড়া এমনিই থাইমা যাইবো। আর দেরি করনের সময় নাই। বেলা শেষ অইয়া আইতাছে। তাড়াতাড়ি চল।
আবার শুরু হয় ওদের দুর্গম যাত্রা। নিজেদের শরীরের অবশিষ্ট শক্তিটুকু অবলম্বন করে দুই ভাই ভ্যানটাকে চালিয়ে নিয়ে চলে বাড়ির পথে। উঁচু-নিচু পথের ঝাঁকুনিতে ভ্যানের উপর মায়ের দেহখানি দুলছিলো বার বার। পিছন থেকে ভ্যান ঠেলতে ঠেলতে মাত্র নয় বছরের ছোট্ট রতন বার বার কাপড়ে ঢাকা মায়ের দিকে তাকায় আর ভাবে- এখন থেকে মা বলে ডাকবার আর কেউ থাকলো না। ব্যথা পেলে কেউ আর আদর করবে না, কোলের মধ্যে নিয়ে রাতজেগে পাখার বাতাস করবে না, মুখে ভাত তুলে দেবে না। ঘুমের ঘোরে হাত দিয়ে আর মাকে খুঁজে পাবে না রতন। রতনের বুক ফেটে কান্না আসতে থাকে। ও বোঝে মায়ের দেহ নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়িতে পৌঁছতে হবে, ক্লান্ত শরীর নিয়ে ভ্যান ঠেলে চলে। দু’টি চোখ ক্রমশ ভিজে ওঠে।
-রতন, আর একটু ভাই। এই দ্যাখ- আমরা আইসা পড়ছি। ঐ তো জমির চাচার ঘর দেখা যাইতাছে। সামনে থেকে কলিম বলে।
ভাইয়ের কথা শুনে রতন সামনের দিকে তাকায়, দূরে ওদের বাড়িটা তখন চোখে পড়ছিলো অনেকটা কুয়াসার মত। বাড়ির প্রবেশমুখে জমির শেখের ছোট্ট কুঁড়েঘরটাও স্পষ্ট হচ্ছিল। ক্লান্ত অবসন্ন দেহে বড়ভাই কলিমের সাথে ভ্যান ঠেলে এগিয়ে চলছিল ছোট্ট রতন।
অপরিণত বয়সী দু’টি কিশোরের অসম যুদ্ধটা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছিলো। ক্লান্ত দিনের শেষে ধীরে ধীরে ওরা পৌছে যাচ্ছিলো চেনা গন্তব্যে। দিন শেষের রঙিন আভাটা তখন মিলিয়ে যাচ্ছিলো কেবল, আর পশ্চিম দিগন্তে ডুবন্ত লাল সূর্য্যটা একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছিলো দূরের গাছপালার আড়ালে। চারিদিক থেকে অন্ধকারের দেয়ালটা ক্রমশ এগিয়ে এসে ঢেকে দিচ্ছিলো ওদের।
আগের পর্ব - এখানে
মন্তব্য করুন