‘আব্বা এই যে আমি!!!
সংসারের বড় মেয়ে বড়াপার ছোট ভাই বোনের জন্য আদরের প্রকাশ ছিল এত বেশি যে ছোটরা তার রাগের জন্য খুব একটা ভয় পেতোনা, এম্নিতেও বড়াপা যত গর্জাতো, তত বর্ষাতো না। মেজাপার রাগ ছিল চন্ডালের রাগ, বুঝিয়ে দেবার পর লেখা পড়ায় ভুল করলে মেরে হালুয়া বানিয়ে দিত, বিশেষ করে ক্লাস সিক্সে ওঠা মেজ এবং সেজ দুরন্ত দুই ভাই এর উপরে তার শাস্তির মাত্রাটা এত বেশি ছিলো যে ভাগ্যিস তখন মানব-অধিকার উকিলদের কথা কেউ শোনেইনি, তাদের হিসেবমত ছোট ভাইদের মেরে তক্তা বানানোর অপরাধে মেজাপার কয়েক বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয়া যেত অনায়াসেই।
তা সেই ক্লাস সিক্সে ওঠার সেই বছরে হোল কি, বছরের শেষ দিনটায়ে চুটিয়ে ফুটবল খেলার পরিবর্তে আযান হওয়ার সাথে সাথে ঘরে ঢুকে মেজাপার আদেশে দুই ভাই পড়ার ঘরে নুতন বইএর মলাট লাগাতে বসেছে। কোথা থেকে দলছুট এক চামচিকে ঘরের ছাদের ঝুলানো লাইটের চার পাশে চক্কর দিয়ে উড়তে লাগলো। আস্তে উঠে সেজ জন দরজা জানালা বন্দ করে মেজকে বললো দেখিতো কার হাত কত পাক্কা, কে ঐটার গায়ে ঢিল মারতে পারে। ঢিল কোথায়? স্পঞ্জের স্যান্ডেল দিয়ে শুরু, তারপর যা সামনে ছিল তাই দিয়ে বই, কেচি, কুশন, ছোড়ার খেলা চললো, জান বাঁচানোর জন্য চামচিকে যতই কোনা কুনিতে পালায় দুই কিশোরের জেদ তত বাড়ে, বুক সেলফের সব বই, এমন কি শোকেসে সাজানো প্রাইজের বইও ছোঁড়া যখন শেষ পর্যায়ে, হটাৎ করে এক উড়ন্ত বই ধাঁই করে জলন্ত লাইটে লেগে দপ করে আঁধারে ঢেকে দিল ঘর, সারা মেঝেতে কাঁচের টুকরো।
টগবগে উত্তেজনায় হটাৎ হিম শীতল ভয় দুই কিশোরকে স্তব্ধ, পঙ্গু করে দিল। মড়ার পরে খাঁড়ার ঘাঁ, ঠিক তক্ষুনি দরজায় মেজাপা ধাক্কাতে শুরু করলেন খোলার জন্য। দরজা খোলার সাথে সাথে আপার মাথার উপর দিয়ে নিশ্চিন্ত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা চামচিকে উড়াল দিল, হাতের নীচ দিয়ে সেজ পালালো। লন্ডভন্ড ঘরের ভিতর ফাঁসির আসামির মত ভীত সন্ত্রস্ত মেজ দাড়িয়ে। কপাল ভালো কাঁচ ভাঙ্গার শব্দে আম্মা এসে দাঁড়ালেন দরজায়, ঘরের অবস্থা দেখে মুখে বললেন ‘কেউ হারিকেন্টা দিয়ে যা এদিকে।
আজকে ঐ দুজনের কপালে কি আছে সেই চিন্তায় এঘরে ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য আমরা সুবোধ বাচ্চার মত মনোযোগে পড়তে লাগলাম। মেজ ছেলেকে নিয়ে সব গুছিয়ে ক্লান্ত আম্মা এসে একটি পান মুখে দেবার জন্য পানের বাটা নিয়ে বসলেন, গম্ভীর ভাবে সব্বাইকে জরিপ করে পান মুখে দেবার বদলে আতংকিত প্রশ্ন করলেন সেজ কোথায়? তাইতো এবাড়ির নয় বছরের চঞ্চল অতি বুদ্ধিমান ছেলেটি কোথায়? খোঁজ, খোঁজ, আলমারির চিপায়, দরজার পিছনে, টেবিলের তলায়, আলনায় ঝোলানো কাপড়ের পিছনে, খাটের নীচে, নেই তো নেই, কোথাও নেই। ছোটাপুর সন্মন্ধে প্রচলিত, তার গলা এত উচ্চগ্রামে যায় যে তার মাইক লাগে না, অংক ক্লাসে সব সময় স্যার নামতার জন্য সামনে ডেকে বলতেন সমস্ত ক্লাসকে নামতা পড়াতে, সে আগে আগে বলে ‘তিনোক্কে তিন’ সমবেত ক্লাস কোরাসে বলে সেটা, যদিও ছোটাপুর গলাই বহু দূর থেকে কোরাসের থেকে পরিস্কার শোনা যেত, সেই ছোটাপু প্রানপনে সেজোর নাম ধরে ডাকতে থাকলো, গলায় দরদ দিয়ে ডাকতে থাকলো ‘ভাইয়া তুমি কোথায় লুকাইছো, একটু সাড়া দাও, আমি এসে তোমাকে নিয়ে আসবো’ কিন্ত কোথাও তার সাড়া শব্দ নেই। আম্মা এমনিতেই ছেলে ধরার ভয়ে সিটিয়ে থাকেন, ছেলে হারানোর ভয়ে একদম হাল ছেড়ে জায়নামাজ বিছিয়ে কোরান শরিফ নিয়ে বসলেন। বড়াপা মেজাপা আমাদের ভাগে ভাগে পাঠালেন আশে পাশের বাড়িতে। মফস্বল শহরে রাত আটটা অনেক রাত! বড়াপু পই পই করে বলে দিলেন সেজ কে পাই আর না পাই অবস্যই এশার নামাজ শেষের আগেই, যেন সবাই ঘরে ফিরে আসি। আব্বা আসার আগেই সব সার্চ পার্টি ফেরত এসে আসন্ন কেয়ামতের ভয়ে কুকঁড়ে দোয়া দরুদ পড়তে লাগলাম।
প্রতিদিনের মত এশার নামাজ পড়ে বাসায় এসে কাপর পালটিয়ে বারান্দার দস্তরখান বিছানো চৌকিতে বসলেন খাবারের আশায়। চৌকির নীচে রান্নার জন্য শুকনো চ্যালাকাঠ, কেরোসিনের স্টোভ, আলু পিয়াজের ঝুরি, ধারালো দা-বটি, হাড়ি-পাতিল, গামলা, বালতি ইত্যাদি হাজার জিনিস। তেলাপোকা, কেন্নো, আর মশা ছাড়া অন্য কোন জীবিত প্রানী সেখানে আশা করা যায় না। স্টোভ জ্বেলে বড়াপা খাবার গরমে দিলেন, ভুমিকা হিসেবে মেজাপা সন্ধ্যার ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ননা দিয়ে থামলেন। বাড়ি ভর্তি লোকের মধ্য থেকে তিন ঘন্টা ধরে সেজোর খোঁজ নেই, কি ভাবে মুখ দিয়ে বলবে আব্বার কাছে সেটা? আব্বা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো একমাত্র আসামি মেজোকে দেখে, চারিদিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় আসামিকে না পেয়ে মুখে বললেন ‘সেজ জন কৈ?
থমথমে নিরবতায় সব্বাইকে অবাক করে গরমে, মশার কামড়ে, অপরাধি ভয়ে ঘেমে একাকার সেজ চৌকির নীচ থেকে হামা দিয়ে বেড় হয়ে এক লাফে কোলে উঠে আব্বার গলাটা জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে ‘আব্বা এই যে আমি!!!
আসমা খান





হা: হা:
মজা পেলাম পড়ে!
পড়েছেন জেনেই খুব ভালো লাগছে। অনেক ধন্যবাদ।
দারুণ। খুব দারুণ।
ধন্যবাদ, অনেক অনেক ধন্যবাদ!
দারুন!
ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা!
দারুণ। খুব দারুণ।
সত্যিই দারুন? শুনে খুব ভালো লাগছে। অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানবেন।
বেশ মজা পেলাম।
মন্তব্যর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আরে, দারুণ মজার তো
ঃ
ঃ
দারুণ লিখেছেন । খুবই মজার ।
অশেষ ধন্যবাদ! ঃ
ঃ
মন্তব্য করুন