ইউজার লগইন

ভোরের সূর্য দেখে মুমূর্ষু শিশির বলে, "হায় ! কোন সুখ ফুরায়নি যার, তার জীবন কেনো ফুরায় ?"

ভৌতিক গল্প পড়ে ছেলেবেলা থেকেই একটা ছেলেমানুষী মজা পাই। দেশী-বিদেশী সাহিত্যের  বিখ্যাত লেখকেরা গদ্যসাহিত্যের এই ধারাটি নিয়ে কাজ করতে খুব অলসতা করেছেন- অনুভব করা যায়। যদিও প্রচলিত ধারায় সবচেয়ে বেশি ভূতুড়ে গল্প লেখা হয়েছে কেবল ভূত এবং মৃত মানুষদের নিয়ে, তবুও  ভৌতিক গল্পকে কেবল ওরকম রুপে ঠিক উপভোগ করি না। ভূত ছাড়াও যে কেবল বর্ণনা এবং পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে চমৎকার সব গা-ছমছমে ভৌতিক গল্প লেখা যায়, বাংলা সাহিত্যে সেই কাজটা খুব সম্ভব সবচেয়ে দারুণভাবে করে গিয়েছেন দুই বন্দোপাধ্যায়;  তারাশঙ্কর এবং মাণিক। ... এবং আরো ভালোভাবে করে গিয়েছেন ভিনদেশী লেখকেরা।

আমার পঠিত ভৌতিক ছোটগল্পগুলোর মাঝে সবচেয়ে স্মরণীয় গল্পটি একজন ভিনদেশীর লেখাই বটে। দুঃখের বিষয়, বহুকাল আগে পড়া সেই গল্পটির গল্পকারের নাম মনে নেই, কেবল মনে আছে- তিনি লেখক নন, একজন লেখিকা। গল্পকারের নাম ভুলে গেলেও বিন্দুমাত্র ভুলিনি গল্পটির নাম এবং মূল গল্পটি। কল্পনার অভিনবত্বে এই পাঠকের মুগ্ধতাকে ছাড়িয়ে যাওয়া সেই গল্পটির নাম ছিলো, দ্যা বয় অন দ্যা বাস। সেই গল্পের সূচনায় থাকে এন্ড্রু নামের একটি ছেলে, গল্প এগোয় বইয়ের পাতায় দেখা একটি কাল্পনিক বাসকে কেন্দ্র করে তার অপার্থিব ভীতিকে সঙ্গে করে, গল্পের শেষে সেই ভূতুড়ে বাসের মুখোমুখি হয় এন্ড্রু স্বয়ং। আপাতঃ অতি সাধারণ প্লটের এই গল্প পাঠককে পুরোটা সময় জুড়ে ধরে রাখে, গা-ছমছমে একটা আবহ তৈরী করে ক্ষণেক্ষণে পাঠককে বুঝিয়ে দেয় ভৌতিক গল্পের উপভোগের জায়গাটা ঠিক কোনখানে।

সম্প্রতি এই রকম আরেকটি খবর পড়ার ভাগ্য হলো। গল্প নয়- খবর, নির্জলা বাস্তব সংবাদ। অথচ গল্পের মত এ খবরেও একটি ছেলে আছে, বাস আছে, বাসচালক আছে। তবুও এই সংবাদ জেনে কোন কল্পনাবিলাসী গল্পপাঠকের রোমান্টিসিজমে মন আপ্লুত হয় না, তীব্র ভয় পাওয়ার ঈর্ষণীয় অনূভুতি হয় না। বরঞ্চ নিরাপত্তাহীনতায় পাঠক কুঁকড়ে ওঠেন,  পাঠকের নিস্ফল আক্রোশ হয়, জান্তব প্রতিহিংসার একটা অসুস্থ অনূভুতি হয়।...

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, সকাল ৮টার সময় ইডেন মহিলা কলেজের সামনে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা খন্দকার খানজাহান সম্রাট নামের বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)এর যন্ত্রকৌশল বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রকে উইনার পরিবহনের একটি বাস অতর্কিতে পিছু হঠতে গিয়ে চাপা দেয়। বাসের তলায় সম্পূর্ণ থেঁতলে যায় সম্রাটের মাথা। ইডেন কলেজের জনৈক কর্মচারী ও ঢাকা কলেজের জনৈক ছাত্র সম্রাটকে ঐ অবস্থায় মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ...

পরিবারের কনিষ্টতম সন্তান আর তিন বোনের একমাত্র ভাই মেধাবী ছাত্র সম্রাটের  নিশ্চয়ই আমাদের মতই নানা রকম স্বপ্ন ছিলো। সম্রাট হয়তো বড় প্রকৌশলী হতে চেয়েছিলো, হয়তো বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনার পক্ষে আকাশ কাঁপানো চীৎকারে সমর্থন দিতে চেয়েছিলো, অথবা হয়তো প্রকৌশলবিদ্যা শেখার ফাঁকে সবুজ মাঠে ঘাসফুলের ছবি তুলতে চেয়েছিলো- যেমন আর সকলেই শৈশবে হতে চায় ম্যাকগাইভার, বেলুনওয়ালা কিংবা ফায়ারফাইটার। অথচ বুয়েটে মাত্র দিনপাঁচেক ক্লাস করা সম্রাট প্রকৌশলী হতে পারেনি। কেবল তাঁর রক্ত কালি হতে পেরেছে, আজিমপুরের কালো পিচের রাস্তায় সেই কালিতে লেখা হয়েছে আরেকটি শিশিরকণার মিলিয়ে যাওয়ার গল্প।

... যে গল্প পূর্বেও লেখা হয়েছে ২০০৫ সালে- যার পাত্রী ছিলেন শাম্মী আখতার; লেখা হয়েছে তারও পূর্বে ২০০২ সালে -সেটির পাত্রী ছিলেন চমন আরা। সকলেই জানি, এর পূর্বেও এই একই প্রজাতির নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে অগণিতবার, নাটকের রক্তাক্ত অঙ্কগুলোর দৃশ্য বিন্যাসে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি কখনো, কেবল পাত্র আর স্থানকাল হয়তো বদলে গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করবার জন্যে সরকার কী করেছেন ?? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভারী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ক্যাডেট কলেজের মাঝেও ভারী যানবাহন চলাচল করে না। চলে না এমন কী বিডিয়ার এলাকা অথবা সচিবালয়ের ভেতরেও। অথচ- এইসব ভারী যানবাহন অবাধে চলাফেরা করে যাচ্ছে বুয়েটের পাশের পলাশী এবং আজিমপুর সংলগ্ন এলাকায়। চোখে মাইনাস পাওয়ারের চশমা পড়ে থাকা উস্কুখুস্কু চুলের ভবিষ্যৎ প্রকৌশলীদের নিরাপত্তা বিধানে আমাদের ব্যস্ত সরকারের সময় হয় না। উইনার বাসের চালকের মতন দূর্ঘটনার পরেই কর্তৃপক্ষ পিঠ বাঁচিয়ে নেন। ভূতুড়ে গল্প তৈরী করে ফেসবুক বন্ধ করতে তারা পিছু পা হন না, কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিরাপত্তার খাতিরে আইন বানাতে গেলে বোবায় ধরে তাদের।

সম্রাটের আকস্মিক মৃত্যু সংবাদে হতবাক হয়ে পড়ে বুয়েটিয়ানেরা, বিচারের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে আজিমপুর এবং পলাশী এলাকা। বুয়েটিয়ানেরা এবং ক্ষিপ্ত এলাকাবাসী দূর্ঘটনার পরপরই রোষে ফেটে পড়ে- হয় গাড়ি ভাংচুর এবং অগ্নিকান্ড।... পরিস্থিতি শান্ত হবার পর বুয়েটিয়ানেরা শান্তিপূর্ণভাবে পরেরদিন মানববন্ধন করে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে (যদি আদৌ কেউ থেকে থাকে) ০৯ দফা দাবি পেশ করে; যার মাঝে অন্যতম ছিলো বুয়েট এলাকায় ভারী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধকরণ এবং সম্রাটের স্মরণে পলাশীতে তাঁর নামে একটি গেট নির্মাণ।

অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি, প্রখর চিন্তাশীল কোন কোন ব্যক্তি বুয়েটের এই ইস্যুতে বুয়েট ছাত্রদের হাতে ধ্বংস হওয়া যানবাহনকে সম্রাটের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে এই আক্রমণ এসেছে সরাসরি বুয়েটের প্রতি বিদ্বেষ থেকে। আবার, কেউ কেউ সম্রাটের প্রয়াণে সমবেদনা জানিয়েছেন বুয়েট পরিবারকে এবং মহাত্মা গান্ধী জীবনীর বাণী চিরন্তনী থেকে বলেছেন- "গাড়ি ভাংচুর এবং আগুণ লাগানোর মাধ্যমে কোন সমস্যার সমাধান করা যায় না।"... খুবই সত্য কথা, সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

তবুও এই জাতীয় চিন্তাশীলদের জন্যে বলছি, আসুন, ইতিহাস থেকে খুব ছোট্ট একটা অংশ পাঠ করে আসি।

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে এক আচমকা অভ্যুত্থানে থাইল্যান্ডের ক্ষমতা দখল করেছিলেন ফিল্ড মার্শাল থানম কিত্তীকাকর্ণ। দেড় বছরের সামরিক শাসনে ক্ষুদ্ধ হয়ে অবশেষে রাজধানী ব্যংককের থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শান্তিপূর্ণ এক পদযাত্রার আয়োজন করে। ১৩ অক্টোবর,১৯৭৩ সাল- পদযাত্রার প্রথম দিনটি কাটে নির্বিঘ্নে। ১৪ অক্টোবর পদযাত্রার দ্বিতীয় দিনে ছাত্ররা হঠাৎ ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে, বিপুল পরিমাণে গাড়ি ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগ আরম্ভ হয়। নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যেরা ছাত্রদের এইবার ছাত্রদের উপর ফাঁকা গুলি ছুঁড়লেও ভাগ্যক্রমে কেউ নিহত হয় না; তবে আন্দোলন নিয়ন্রণের বাইরে চলে যায়। পরেরদিনের শোভাযাত্রায় অংশ নেয় প্রায় ২০০,০০০ হাজার লোক। জনতার দাবিতে গদি ছাড়তে বাধ্য হন থানম কিত্তীকাকর্ণ। তার দুই প্রধাণ সহযোগীসহ তাকে নির্বাসনে যেতে হয়। থাইল্যান্ডে প্রণয়ন করা হয় নতুন সংবিধান। খুব অল্প কথায় বলতে গেলে- সামান্য কয়েকটা গাড়ি দুমড়ে দিয়ে ক্ষমতার সুতোতে যে টান দিয়ে ফেলেছিলেন থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, সেটা থামানো সম্ভবপর হয়নি পরাক্রশালী স্বৈরশাসক কিত্তীকাকর্ণের পক্ষেও।

...বুয়েটের ছাত্ররা সরকারের পতন চায়নি, তারা কেবল নিরাপদ সড়ক চেয়েছে। এ চাওয়া অনায্য নয়। ফিল্ড মার্শাল থানম ক্ষমতা ছাড়তে পেরেছেন; সর্ষের ভেতরের থেকে আমরাও ভূত ছাড়াতে পারবো। উইনার বাসের পলাতক চালককে আইনের আওতায় আনা এবং ছাত্রদের জন্যে নিরাপদ সড়কের আইন প্রণয়ন করা খুব বেশি চাওয়া তো নয়। ... আমরা পদযাত্রা শুরু করেছি মাত্র। নিশ্চিত জানি- আমাদের পদযাত্রায় সামিল হতে ২০০,০০০ এর চেয়ে ঢের বেশি লোক এগিয়ে আসছেন। তাদের যে আসতেই হবে...

তবু ভয় হয়। ...সরকারী লাল সূতোর গিঁটে হয়তো আটকে যাবে এইসব দাবি-দাওয়া, গোল্ডফিশের স্মৃতিশক্তি নিয়ে আমরা আরেকটি মৃত্যুর প্রতীক্ষায় থাকবো। আমাদের বুকের দিয়াশলাইগুলোতে বারুদ ধরবে না তখনো... 

সম্রাট, ভাইয়া- কয়েকজন বোকাচোদা 'সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ' আর সুশীলের মুখোশ পরে বেশ্যাবৃত্তি করতে থাকা অগণিত মানুষ দিয়ে ভরে থাকা এই ম্লান মনোরম মনোটোনাস শহরকে তুমি পারলে ক্ষমা করে দিও...

পোস্টটি ৫ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

নজরুল ইসলাম's picture


কিছু বলার সাহস নাই Sad
চুপ করেই থাকি

সুহান রিজওয়ান's picture


নজ্রুল ভাইকে একটা বড় ধন্যবাদ.....আমরা যখন চুপ করে ছিলাম, তখন আপনি অন্ততঃ আমাদের ব্যাথাটা বুঝে সরব ছিলেন.....

নাজমুল আরেফিন's picture


ফাটায় দিছিস সুহান....উদাহরণগুলা ভাল হইসে। কিন্তু ওই মুরগাটাকে (Cock) নিয়ে আরেকটু লিখলে আরো ভাল লাগত.... Tongue

সুহান রিজওয়ান's picture


দুঃখিত, কারো প্রতি ব্যক্তিগত রোষ প্রকাশে অথবা ব্যক্তি বিশেষকে খোঁচা দেবার জন্যে এই লেখা নয়....

এই লেখা সম্রাটের জন্যে....

তানবীরা's picture


খুব সুন্দর করে লিখেছো সুহান। খুবই গুছিয়ে।

সম্রাটরা কেনোই বা আমাদের ক্ষমা করবে? আর কতোকাল ক্ষমা করবে? আমি ক্ষমা চাই না, আমাদের শাস্তি চাই।

সুহান রিজওয়ান's picture


আমাদের ফাঁসি চাই.....

চাঙ্কু's picture


Sad

সুহান রিজওয়ান's picture


Sad

মামুন হক's picture


কষ্টে বুকটা ফেটে যায়রে ভাই, কিছুই করতে পারি না। তেলাপোকার মতো বেঁচে আছি

১০

সুহান রিজওয়ান's picture


ঠিক্কথা.....
পার্সিদের টাওয়ার অফ সাইলেন্সের কাকের ঠুকরে খাওয়া লাশগুলোর আত্নসম্মানটাও আমাদের চেয়ে বেশি.....

১১

রুমন's picture


এই ম্লান মনোরম মনোটোনাস শহরকে তুমি পারলে ক্ষমা করে দিও...

ক্ষমা করে দিয়ো আমাদের অক্ষমতাকেও Sad

১২

সুহান রিজওয়ান's picture


কখনো কখনো ক্ষমা দূর্বলতার পরিচায়কও বটে....

১৩

মীর's picture


শুধু ক্ষমা চাই না। বিচার চাই। সমস্যার সমাধান চাই।

১৪

সুহান রিজওয়ান's picture


আমরাও তাই....

বিচারের দাবি নিয়ে বসে আছি।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.