সেই পাহাড় আর নদীর গল্পটি (দুই)
অরণ্যকে ঠকানোর কষ্টটা আজকাল রিয়ার মনে খুব বাজে। বিবেকের এই চাপ সে আর সহ্য করতে পারছে না। অনেক ভেবে সে ঠিক করল যাই হয় হোক, এভাবে আর না। সে সব অরন্যকে খুলে বলবে, তারপর অরন্য যে শাস্তিই দিক, তাই মেনে নিবে। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর অরন্য স্বভাবমতো তার স্টাডিতে গিয়ে বসলো সেদিনও। রিয়া স্বপ্নকে শুইয়ে দিয়ে এসে অরন্যের চেয়ারের পাশে হাটু মুড়ে বসল। পুরো বাড়িটা নিস্তব্ধ। রিয়া এ ঘরে আসার সময় হলের বাতিটাও নিভিয়ে দিয়ে এসেছে, আলো পাগল রিয়া এখন যতোটা সম্ভব অন্ধকার চায়। মুখ লুকিয়ে আজ অরন্যের কাছে তাকে আসতে হবে। আলোতে, অরন্যের চোখে চোখ রেখে একথা কিছুতেই রিয়া তাকে বলতে পারবে না। এভাবে পায়ের কাছে নতজানু হয়ে রিয়ার বসে পরা অরন্যকে হতভম্ব করে তোলে। কি হয়েছে রিয়া, বলে রিয়ার মুখে হাত রাখতেই দেখতে পায় অঝোরে রিয়ার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে যাচ্ছে। দ্রুত রিয়াকে তুলে পাশের সোফায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ঢাকায় কথা হয়েছিল আজকে? রিয়া মাথা নীচু করেই ঘাড় নেড়ে হ্যা সূচক জবাব দেয়। আবার অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলো, সব খবর ভালো সেখানে? রিয়া আবারো মাথা কাত করলে, অরন্য বুঝতে পারে না তাহলে কেনো রিয়া এতো কেঁদে যাচ্ছে। আর কি হতে পারে। কি হয়েছে রিয়ার? শরীরে খারাপ কিছু বাসা বাধেনিতো কিংবা স্বপ্নের কি কিছু হয়েছে? অস্থির হয়ে অরন্য ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে লাগলো। নিশ্চয়ই স্বপ্নকে নিয়ে কিছু। সংসারের কোন খবরইতো সে রাখে না। সব বেচারী রিয়া একা সামলায়। সংসারে সময় দেয় না বলে এখন তার নিজের ওপর রাগ লাগতে লাগলো। সাথে সাথে অমংগলের আশঙ্কায় সে রীতিমতো ঘামতে লাগলো।
অনেকক্ষন কেঁদে আর বার বার অরন্যের অস্থির প্রশ্নের মধ্যে রিয়া এক সময় বলে ফেললো, “ I’m in love with some one else”. প্রথমে কিছুক্ষণ অরন্য বুঝতেই পারলো না রিয়া আসলে কি বলছে। এতোই অপ্রত্যাশিত এই কথাটি তার জন্য যে কিছুক্ষণেরর জন্য মনে হলো তার বোধশক্তি লোপ পেয়েছে। কিন্তু কথাটি বলে ফেলতে পেরে রিয়ার বেশ হালকা লাগছে। চুপচাপ চারধার, একই ঘরে বসা দুটো প্রানী নিজেদেরকে পরবর্তী পর্বের গুছিয়ে নিয়ে তৈরী হচ্ছে। অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর এবার অরন্য সরাসরি রিয়ার দিকে চোখ রেখে প্রশ্নের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে রইলো। রিয়া চোখ না তুলেই বুঝতে পারলো, অরন্যে অপেক্ষা করছে তার বক্তব্যের। মুখ নীচু করেই রিয়া কথা বলে গেলো। একটি প্রশ্নও করেনি অরন্য তাকে একটিবারের জন্য, একবার থামায়নি কথা বলার সময়। হঠাৎ রিয়ার মনে হলো, সব শুনছেতো অরন্য? মুখ তুলতেই রিয়া ভয় পেলো, অরন্যের মুখ পুরোই ছাই রঙের, বুকে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে সে। রিয়া দৌড়ে এসে ধরতেই ধপাস করে অরন্য সামনের সোফায় বসে পরে অনেক কষ্টে উচ্চারন করল পানিই, পা - নি - ই। দৌড়ে রিয়া পানি আনতেই অরন্য ঢকঢক করে সেটা এক নিশ্বাসে খেয়ে নিলো। একটুক্ষন চুপ থেকে কথা বলার শক্তি অর্জন করে রিয়াকে বললো, তুমি শুতে যাও। রিয়া আস্তে জিজ্ঞেস করলো, তুমি শোবে না। অরন্য, হুম। বিছানায় শুয়ে রিয়া অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো কিন্তু অরন্য এলো না শুতে। অপেক্ষা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো রিয়া। সকালে এ্যার্লামের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলে অভ্যস্ত হাত অরন্যকে খুঁজলো। না পেয়ে উঠে বসতেই মনে পড়লো কাল রাতের কথা।
পায়ে পায়ে নীচে স্টাডিতে যেয়ে দেখে অরন্য ঠাই বসে আছে সেই সোফাটায়। আজ পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে তাদের, অরন্য বাড়ি থাকলে কোনদিনও তারা আলাদা শোয়নি কোন কারনেই নয়। বিয়ের পরে আজ প্রথম এভাবে তাদের রাত কাটল। অরন্য খুব নিয়ম মেনে চলতে ভালোবাসে। যতো ইন্টারেষ্টিং বইই হোক না কেনো কিংবা ডিস্কোভারীতে নতুন কিছু রাত দশটার মধ্যে সে বিছানায় চলে যাবেই। আজ নির্ঘুম রাত পার করে দিলো সে। রিয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে অরন্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তারপর রোজকার মতো ফ্রেশ হয়ে অফিসে চলে গেলো। একটু পরেই সুজনের ফোন এলো রিয়ার মোবাইলে। অরন্য বেড়িয়ে যাওয়ার সময় সে জানে। সেভাবেই মর্নিং কল দেয় সুজন রিয়াকে। সমস্ত ঝড় একা মোকাবেলা করে পর্যুদস্ত রিয়া সুজনের গলা পেতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। হড়বড় করে বলে দিলো, সে অরন্যকে সব বলেছে। সুজন বেশ রেগেই গেলো এটা শুনে। কয়দিন ধরেই রিয়া যখন পাপ - পূন্য, নৈতিকতা - অনৈতিকতা নিয়ে কথা বলছিলো, সুজন তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে এগুলো আসলে কথার কথা। দুজন মানুষ দুজন মানুষকে ভালোবাসলে এরমধ্যে পাপ কিছুই নেই। রিয়াকে আরো ঘনিষ্ট করে তার কাছে টেনে নিয়ে বলেছে, মানুষকে ভালোবাসা কখনো পাপ না। ভালোবাসার কোন সময় - অসময় নেই, যেকোন পরিস্থিতিতেই মানুষ যে কারো প্রেমে পড়তে পারে। নিজের স্ত্রী - পরস্ত্রী এগুলো সবই মানুষের সৃষ্টি করা ভুল ধারণা মাত্র। এ নিয়ে অপরাধ প্রবনতায় ভোগারও কিছু নেই আর অরন্যকে জানানোরও কিছু নেই। ভয়ে ভয়ে তখন রিয়া জিজ্ঞেস করেছে, তাদের দুজনকেতো বাইরে অনেকেই দেখেছে। কেউ যদি বলে দেয়, অরন্য রিয়াকে জিজ্ঞেস করলে তখন কি হবে? রিয়ার চোখে মুখে ঠোঁটে আদর করে আঙ্গুল ছুইঁয়ে দিতে দিতে বলেছে, অস্বীকার করবে, স্রেফ অস্বীকার করে যাবে। রিয়া বুঝতে পারে না, দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ নিজেদের ইচ্ছায় নিজেদের ভালোবাসছে, তাহলে কেনো সব্বাইকে মিথ্যে বলে ঠকাতে হবে? কেনো সত্যি সত্যি বলা যাবে না।
এতো নিষেধের পরেও রিয়া অরন্যকে সব বলে দেয়াতে সুজন রেগে ফোন কেঁটে দিলো। রিয়া বুঝতে পারলো না, কি হলো ব্যাপারটা। ভাবলো লাইন কেঁটে গেছে হয়তো। রিয়া পাগলের মতো সুজনকে ফোন করতে লাগলো। কিন্তু কিছুতেই সুজন ফোন তুলছে না। মীটিং, জরুরি কিছু? মেইলে করল তাড়াতাড়ি, লিখল মিস ইউ বেবি, কল মি ব্যাক, এজ আরলি এজ পসিবল। সারাদিন একটু পর পর মেইল চেক করলো কিন্তু সুজনের কোন পাত্তা নেই সারাদিন। এভাবেই কিছুটা সুস্থতায় কিছুটা অসুস্থতায় দিন কাটলো রিয়ার। বিকেলে অরন্য এলো অফিস থেকে। সবাই একসাথে ডিনার করলো যেন সবকিছু এ বাড়িতে চরম স্বাভাবিক। অরন্য টুকটাক সংসারের কেজো কথার বাইরে কোন কথা রিয়ার সাথে বললো না। স্বপ্নের সাথে সে স্বাভাবিক রইলো। রাতে সে স্টাডিতে ঘুমালো। এভাবে তিন দিন গেলো। মৃত্যু যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ রিয়া সুজনের ব্যবহারে হতভম্ব। সে কি মরে গেলো না বেঁচে আছে সে খোজঁও কি করবে না সুজন? দিনের মধ্যে পাঁচবার রিয়ার গলা না শুনলের সুজন চার্জ হতো না, কোন কাজের এনার্জি পেতো না বলতো থাকা সে একদম নিপাত্তা। এদিকে অরন্যের কাছ থেকে কঠিন শাস্তি কিংবা কটু কথা কিছুই আসছে না, যেনো বরফ শীতল এক মানুষ। শনিবারে আর সহ্য হলো না, অরন্যের কাছে আবার গেল,
জিজ্ঞেস করলো, কি করবো অরন্য?
অরন্য জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে শান্ত গলায় বলল, কি করবে তুমি, তোমার সেই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়ইতো আমি আছি রিয়া। তুমি জানাও তুমি কি চাও
আমি জানি না অরন্য, আমি জানি না। আমার মন আমার বশে নেই। আমি কি করবো? কেঁদে কেঁদে রিয়া বলতে লাগল, আমি তোমাকেও শ্রদ্ধা করি, স্বপ্নকে ছাড়া আমি আমার জীবন কল্পনা করতে পারি না কিন্তু তবুও আমার মনকে আমি বেঁধে রাখতে পারছি না
রিয়ার কান্নাতে অবিচল থেকে অরন্য বলে উঠলো, চলে যাও তুমি, দু নৌকায় পা দিয়ে চলবে না রিয়া। মন আর শরীরকে একসাথে করে যাও। একজনকে শরীর আর একজনকে মন, ছিঃ রিয়া।
এবার রিয়া স্বামীর ভালোমানুষীতে কঁকিয়ে কেঁদে উঠলো। বললো, তার সাথে আমার শরীর-মন সবকিছুরই মিলন হয়েছে অরন্য। আমি শুধুই আর তোমার রিয়া নেইগো ......
হতবিহ্বল অরন্য উঠে এসে রিয়ার হাতদুটো ধরে কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, কেন রিয়া কেন? কি কমতি ছিল আমার মধ্যে? কি সেটা তুমি অন্যের মাঝে পেলে যা আমার মাঝে ছিল না? তোমাকে অদেয়া কি ছিল আমার রিয়া?
মাথা নীচু করে হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে রিয়া বলে গেল স্বগোক্তির মত। তোমার কোন দোষে এটি হয়নি অরন্য, হয়েছে আমার জন্যেই। আমিই পারিনি নিজেকে সামলে রাখতে।
কিন্তু কেন? আমাদের মাঝেতো ভালবাসার কোন ফাঁক ছিল না? কোন উষ্ণতা কমে গেল, কিভাবে আমি টেরই পেলাম না? কি করে রিয়া? কি করে? অরন্য সমানে রিয়ার কাধ ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে গেল
(চলবে)
২০১২ সালের বইমেলাতে "ভালবাসার গল্প" পেজের প্রথম প্রকাশনা "ভালবাসার গল্প"তে এ গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে।
গল্পটির প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক





ভালো লেগেছে। বাকিটা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
দু'টা পর্বই পড়লাম!
পারিপার্শ্বিক বর্ননার কারনে গল্পতো পছন্দ হলো এতোক্ষন পর্যন্ত তবে আশা করছি যেন গতানুগতিক না হয় পরেরটা।
মানে, সুজন বদে বিজনে যাবে আর রিয়া যাবে অরন্যে ফিরিয়া! তবে কিন্তু আমি মিলে যাওয়াটাই বেশি পছন্দ করবো!
কনগ্রেটস!
এফবি'তে দেই নাই স্ট্যটাস কিন্তু দেখছিলাম ঠিকই! 
কাহিনীর মোড় ঘুরে গেল, চলুক
জটিল মনস্তত্ত্ব! কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে রিয়া?!?
পড়তেছি। দেখি কি হয়!
দেখা যাক...
বাকি অংশ বাকি অংশ
হায় আল্লাহ ! আমার নাম নিয়ে তো দেখি বিশাল গল্প শুরু হয়ে গেছে। দাঁড়ান, পুরোটা পড়ে নিই, তারপর কমেন্ট করছি।
পরের পর্বের জন্য অধীর হয়ে গেলাম....প্লিজ তাড়াতাড়ি.. অনেক চমৎকার হচ্ছে।
গল্পটির পাঠকের মনোযোগ আর্কষনের ব্যর্থতার কারণে বাকি অংশটুকু আর দেয়া হলো না। ধন্যবাদ সবাইকে
তাতাপু, এই পর্বটাও ১১৩ বার পঠিত এখন পর্যন্ত। আর আমরা তো সাথেই আছি। অপেক্ষা করছি পরের পর্ব পড়ার জন্য। আমরা তো পাঠক। পরের পর্বগুলা দেন। শেষ করেন পুরাটা।
আমরা তাহলে পাঠক পদবাচ্য নই?
পরের পর্ব চাই
যদি কারো গল্পটার শেষটুকু জানতে ইচ্ছে করে তাদের জন্য

প্রথম পর্বের বর্ণনা বেশি ভাল ছিল।
২য় পর্বে শুরুর ধাক্কাটা ভাল হইছে।
শেষের ডায়লগগুলা এতটা স্বতঃস্ফূর্ত লাগে নাই।
বাকি টাও এখানে পোস্ট করা উচিৎ। সেখানেই কমেন্ট দিব।
এতোদিন হয়ে গেল ৩য় খন্ড এখনো দেয়া হয় নাই কেনো?
আজকেই ৩য় খন্ড দেয়া চাই।।
প্লিজ, আর না। আমি আধুনিক এবং বাস্তববাদী। লেখাটা পড়ে নিজের সম্পর্কে (আধুনিক এবং বাস্তববাদী) সন্দেহ হল।
আমি আর এ লেখা পড়ব না। এত স্বাধীনতা, স্বাধীনতা নয়। এভাবে চললে সম্পর্ক নামক সম্পর্ক ফিকে হয়ে যাবে।
আপনার চিন্তা কোথাও ধাক্কা খেলেই যদি না না না করে সিরিয়ালের মতো চিৎকার করে ওঠেন, তাহলে কি করে নিজেকে বাস্তববাদী ভাবেন? বাস্তবতো প্রতিনিয়ত ধাক্কা খাওয়ার নাম। লেখা না পড়েন আপত্তি নেই কিন্তু আপনি ঝোপে মুখ গুজলেই আপনাকে কেউ দেখতে পাবে না, তাতো আর না, তাই না?
মন্তব্য করুন