মনে পড়ে : ফেরদৌসী মজুমদার
পড়লাম ফেরদৌসী মজুমদারের লেখা আত্মজীবনী ‘মনে পড়ে’। বনেদি, ধনী মুসলিম পরিবারে জন্ম হয়েছিলো তাঁর ১৯৪৩ সালে। চৌদ্দ ভাইবোনের সংসার ছিলো তাঁদের, তিনি ছিলেন এগারো নম্বর। বেশ কড়া শাসন আর আধুনিকতার মিশ্রণে ছিলো তাঁর পারিবারিক জীবন। কবীর চৌধুরী, শহীদ মুনীর চৌধুরীর বোন তিনি, বাকি ভাই বোনেরাও সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত, রত্নগর্ভা মায়ের সন্তান তাঁরা। আত্মজীবনীতে তিনি তাঁর পারিবারিক ঘটনা বেশ অকপটেই বলেছেন, সে-জিনিসটা আমার ভাল লেগেছে। আমার নিজের ছোটবেলাও কেটেছে মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারে। আমি তাঁর পরিবার দিয়ে কিছুটা যেনো নিজের পরিবারটাই দেখতে পেলাম। মাথায় কাপড় দেয়ার জন্যে, পর্দায় থাকার জন্যে মেয়েদেরকে শাসন, সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরতে দেরি করা নিয়ে ছেলেদেরকে শাসন, পড়াশোনা নিয়ে মারধোর, অশান্তি, হয়তো তখন ঢাকার ঘরে ঘরে এরকমই গল্প ছিলো...
তখনো এতো লোক ঢাকায় বাস করতো না। গ্রামের দু একটি সচ্ছল পরিবারের দুএকজন ঢাকায় থাকে। প্রায়ই দেখা যেতো গ্রাম থেকে কেউ না কেউ, কোন না কোন প্রয়োজনে কিংবা কখনো স্রেফ শহর দেখার জন্যে ঢাকা চলে আসত এবং যারা ঢাকায় থাকে তাদের বাসায় উঠে যেতো। অনেকটাই “মান ইয়া না মান, ম্যায় তেরা মেহমান” টাইপ অবস্থা। ফেরদৌসীদের বাড়িও তার ব্যতিক্রম ছিলো না, তা নিয়ে ফেরদৌসী লিখেছেন, “বাবার দিকের লোকজন এলেই আম্মা সচেতনভাবে ওদের একটু সেবা-যত্ন করতেন। ওরা এলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের থাকা খাওয়ার একটু অসুবিধে হতো। বাড়িতে এলে বিছানায় উঠে যেত ওরা, মাটিতে নেমে যেতাম আমরা।............. কিন্তু এসব ঘটনা থেকে আমার মনে যেটা দাগ কেটেছে এবং যে উপসংহারে উপনীত হতে আমি বাধ্য হয়েছি-সেটা হচ্ছে দেশের বাড়ির প্রায় অশিক্ষিত লোকগুলো বড় সঙ্কীর্ণমনা হয়। এদেরকে সন্তুষ্ট করা বড় কঠিন। এদের ভিলেজ পলিটিক্সটা বড় মারাত্মক। বিচিত্র স্বভাব, বিচিত্র মনমানসিকতা। তাই গ্রামীণ সরলতার পাশাপাশি গ্রাম্য সঙ্কীর্ণতার কথাটিও ভুললে চলবে না।”
যতোটা আগ্রহ নিয়ে বইটি শুরু করেছিলাম বইটা ঠিক ততোটা আশা পূরণ করতে পারে নি। সত্তরের শুরুতে রামেন্দু-ফেরদৌসীর বিয়ে হয়। সেসময়ে দুজন ভিন্ন ধর্মালম্বী মানুষ পারিবারিক সম্মতি নিয়ে সংসার পাতছেন, সে খুব বিরল একটা ঘটনা। তাঁর ভাষাতেই, “মুসলমান ছেলে হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছে কদাচিৎ শোনা যেতো, কিন্তু মুসলমান মেয়ে হিন্দু ছেলে বিয়ে করেছে শোনা যেতো না”। কিন্তু এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু লিখেন নি তিনি। আমার দৃষ্টিতে, এটি খুব উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা যা বাংলাদেশের মানুষের জানার দরকার ছিলো। এই অন্ধ, বধির সমাজে, মৌলবাদী জনগোষ্ঠীর মত পরিবর্তন করতে এ ধরনের ঘটনার বিশদ প্রচারের প্রয়োজন আছে। প্রথমে পরিবার রাজি ছিলো না, পরে রাজি হয়েছে তাঁর দৃঢ়তা দেখে শুধু এটুকুই লিখেছেন তিনি। সামাজিকভাবে কী ধরনের বাধাবিঘ্ন এসেছে বা আত্মীয় স্বজনদের কিভাবে মানালেন তা নিয়ে কিছুই লিখেন নি। তাঁর নিজের পরিবার ছাড়াও রামেন্দুর পরিবার ছিলো, রামেন্দুর সমাজ ছিলো, তাঁদের আচরণ তাঁর প্রতি কেমন ছিলো, তাঁরা তাঁকে কিভাবে গ্রহণ করেছিল সে-সম্পর্কেও একটি কথা নয়! তাঁর সুখ-শান্তির সংসারের কিছু বিবরণ সমাজকে জানানো তাঁর দায়িত্ব ছিলো বলে অন্তত আমি ভাবি।
তবে পুরো বইয়ের কোথাও ফেরদৌসী তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো খুব বিশদে লিখেন নি যেটা আত্মজীবনী লেখার অনেকটা মূলধারা বলে ভাবা হয়। তিনি তাঁদের পারিবারিক ঘটনাবলীই লিখে গেছেন। অনেকটা খাপছাড়া, ধারাবাহিকতা নেই। এক এক সময়, এক এক ঘটনা। পঞ্চাশের দশক, ষাটের দশক, সত্তরের দশকের পর্যায়ক্রম অনুপস্থিত। সাংস্কৃতিমনা, শিক্ষিত পরিবারের ঘটনাবলী থেকে সমাজ পরিবর্তনের, রাজনৈতিক আন্দোলনের, মুক্তিযুদ্ধের যে-ধারাবাহিকতা আসার কথা ছিলো তাও নেই। যার কারণে ছোট থেকে বড় হয়ে-ওঠা ফেরদৌসীর বিশদ কিছু চিত্র এখানে পাওয়া যায় না। শেষের দিকে তাঁদের চৌদ্দ ভাইবোনের জীবনের সারমর্ম লিখেছেন, সবার প্রেম-বিয়ে-সংসার নিয়ে লিখেছেন। তারমধ্যে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত তাঁর নিজের কাহিনি, যার মধ্যে প্রেম-বিয়ের কিছু নেই, শুধু আছে রান্না করতে জানতেন না, সেটা শিখেছেন আর তাঁর মেয়ের কথা! হয়তো এ-কারণেই, বইটি ঠিক যতোটা আলোচনায় আসার কথা ছিলো, ঠিক ততোটা আলোচনায় হয়তো আসে নি। কিন্তু বইটিতে অনেক তথ্য আসার সুযোগ ছিলো। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনকে তুলে ধরার একটি দলিল হতে পারতো এই বইটি। সে-হিসেবে বইটা আশা জাগিয়েও ব্যর্থতার ছায়ামাখা একটা সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটিয়ে গেলো।
গত গ্রীষ্মের ছুটিতে বইটি যথারীতি উপহার পেয়েছিলাম ছোটভাই আরাফাত শান্ত থেকে।
তানবীরা
১৫/০৪/২০১৫
এত চমৎকার রিভিউ লেখার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ আপু!
বইটা দিয়েছিলে বলে না । পুরোটা এখানে পাবে http://blog.mukto-mona.com/tanbira/45789
রিভিউ ভালো লাগছে। বইটাতে লেখকরে নিজের কথা আরো বিস্তারিত থাকবে ভেবেই পড়া শুরু করেছিলাম।
তবে ১৪ জন ভাইবোনের কথা পড়তেও ভালো লেগেছে অনেক।
আপু, রামেন্দু মজুমদারের লেখা "প্রথম তিরিশ" পড়তে পারেন।
আত্মজীবনী? আছে তোমার কাছে? থাকলে দিও
আছে। নিয়ে যান
সামিয়ার সাথে কোথাও দেখা হলে দিয়ে দিও, ও পাঠিয়ে দিবে
মন্তব্য করুন