শ্বাপদ সংকুল রাতের শিহরন পেরিয়ে বৈচিত্রময় দিবসে
আগের কাহিনী জানতে
.
১.
রাত কতো জানি না। ঘড়ি নেই। সময়ের কোন হিসেব রাখবো না বলে ঘড়ি আনিনি।
ঘরটা ভেঙ্গে পড়বে মনে হলেও ছুটে বেরিয়ে যেতে সাহস হচ্ছে না ঘুটঘুটে অন্ধকারে।
.
কুঁড়ে ঘরের চালের উপর থেকে এবার গরররররররর গররররর জাতীয় অদ্ভুত কিছু বিজাতীয় শব্দ ভেসে আসছে। ভীতু মানুষ না হলেও, এই সময়ের জন্য সাহসটা দমে গেল। এডভেঞ্চারের শুরুতে বেঘোরে মারা পড়াটা কোন কাজের কাজ হবে না। তবে ভয়ের চেয়েও একটা বিচিত্র অভিজ্ঞাতর লোভ অনেক বেশী আবিষ্ট করে রেখেছে বলে ভয়টা দাঁত ফোটাতে পারছে না।
.
অতীত থেকে শিক্ষা পেয়েছি যে দুর্যোগ থেকে বেঁচে গেলে সেই দুর্যোগই পরে মধুর স্মৃতিচারণ হয়ে ওঠে। সেরকম বেশ কয়েকটা অভিজ্ঞতা ঝুলিতে জমা আছে। সেন্টমার্টিনে প্রথমবার যাবার সময় মাঝ দরিয়ায় ছোট্ট নৌকাসহ ডুবে যাচ্ছিলাম দেখেও ভয় পাইনি ঢেউয়ের সেই অপরূপ রুদ্র মূর্তি শ্রীকান্তের চোখে দেখেছিলাম বলে।
.
আন্দাজ করার চেষ্টা করছি কিরকম জন্তু হবে পারে। এই অঞ্চলে কি কি হিংস্র জন্তু আছে তার তালিকা বাংলাপিডিয়ায় পড়েছিলাম অনেক আগে। এখন মনে আসছে না।
.
বাংলাপিডিয়ার কথা মনে পড়লে আমার এখনো লজ্জা হয়। প্রথম যখন ওটা প্রকাশিত হয়, সহজে কিনতে পাওয়া যেত না। হেলায় সুযোগ না হারানোর জন্য কারেন্ট বুক সেন্টারে গিয়ে আগাম অর্ডার দিয়ে রাখলাম। তারপর যখন ঢাকা থেকে জিনিস এলো, ষ্টক ফুরিয়ে যাবার ভয়ে দ্রুততম পথে দশ হাজার টাকায় পুরো সেট কিনে আনি বাসায়। কিন্তু বিজয়ীর হাসিটা ফুরোবার আগে কদিন বাদেই শুনি পুরো বাংলা পিডিয়ার ডিজিটাল ভার্সন মাত্র আশি টাকায়। ওটা ছিল বই কিনে আমার জীবনে অন্যতম ধরা।
.
যাককে, ধান ভানতে শিবের গীত চলে আসছে আবারো। জঙ্গলে ফিরি এখন।
.
২.
উপরে যে জন্তু হানাহানি করছে তা জানার চেয়ে এখানে চুপচাপ বসে থাকি। জ্ঞানের চেয়ে অজ্ঞানতা কখনো কখনো শ্রেয়তর। বাইরে বেরিয়ে টর্চ মেরে দেখতে গেলে ওদের ডিনারের খাদ্য হয়ে যেতে পারি। এখনো নিশ্চিত না ওদের লড়াইটা কি নিয়ে। অসম্ভব কিছু না, হতে পারে আমাকে দখল করা নিয়েই যুদ্ধ। আমার শরীরে যে মাংস আছে তাতে দুটো বাঘের কুলোবে না। তাই হয়তো ফয়সালা চলছে, মানুষ বেটা কার?
.
এটা মাথায় আসার পর গা শির শির করলো। মানুষ খেকো বাঘ নাকি ভয়ংকর জিনিস। আমার কাছে একটা মাল্টিপারপাস পকেট নাইফ বাদে আর কোন অস্ত্র নাই। খালি হাতে আত্মরক্ষা বিদ্যায় কালোফিতার পদক থাকলেও সেটা বাঘভালুকের বিরুদ্ধে কোন কাজে আসছে না। সুযোগ থাকলে ঝেড়ে দৌড় দিতাম, কিন্তু জঙ্গলের যে অবস্থা, দিনের বেলা পায়ে হেঁটেই চলা মুশকিল। রাতে তো পুরা আন্ধা। ঠিক এই সময়ে বিধাতার উপর একটু ক্ষোভ জন্মালো মানুষের প্রতি আনফেয়ার ট্রিটমেন্ট করার জন্য। সকল হিংস্র জীব জন্তুরই বিল্টইন নাইটগ্লাস আছে। কোন যন্ত্র ছাড়াই ওরা রাতের বেলাও ফকফকা দেখে। মানুষের নখ দাঁত কিছুই মজবুত না, তার উপর নাইটগ্লাসও নাই। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় একেবারে অচল। এটাকে ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট হিসেবে মেনে নিয়ে কান খাড়া করে শুয়ে থাকলাম।
.
এই ঘরে কোন দরোজা নেই। যে ফোকর দিয়ে আমি ঢুকেছি এত অন্ধকারে সেটার অবস্থানও বুঝতে পারছি না। অন্ধকার এত ঘন হতে পারে এরকম জায়গায় না এলে কেউ বুঝবে না। কোন কোন সাপ(নাকি সব সাপ) নাকি চোখে দেখে না, জিহ্বা দিয়ে শুনে শুনে শিকারকে টার্গেট করে। আমিও কানকে চোখের বিকল্প অবস্থানে দিয়ে তৈরী থাকলাম আক্রান্ত হওয়ার জন্য।
.
এমন সময় দূরে কোথাও তীক্ষ্ণ একটা চীৎকার শোনা গেল। হায়েনা নাকি? তারপর একটা শেয়ালের ডাক। শেয়ালের ডাক থামতে না থামতেই আরো কয়েকটা শেয়াল ডাক ছাড়া শুরু করলো। আবারো সেই হায়েনার মতো তীক্ষ্ণ চিৎকার। আমি হায়েনার ডাক চিনি না। কিন্তু আন্দাজে মনে হলো। ডাকটা কাছে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ মাথার উপর থেকেও সেরকম ডাক শুনতে পেলাম। কান ঝালাপালা করে ফেললো সেই চিক্কন ডাক। ধাপাধাপি থামিয়ে চিৎকার শুরু করলো এবার। আমার কানের পর্দা না ফাটিয়ে ছাড়বে না। আরো কয়েকটাকে আমন্ত্রন করছে নাকি ডিনারে?
.
এই ঘরে আছে এক এক মানুষের ছাও
তোমরা সকলে মিলে তাড়াতাড়ি আও
.
কাহিনী যদি এই হয়, তাহলে আজকেই আমার দিন শেষ। কেউ জানবেও না পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন জঙ্গলে বেঘোরে বন্য জন্তুর পেটে চলে গেছে একটা আস্ত মানুষ। পত্রিকার পাতায় কদিন নিখোঁজ সংবাদ আসবে। তিন মাস পর পরিচিত সাংবাদিক ফলো আপ নিউজ করবে স্থানীয় পত্রিকায়, "আজ তিন মাস হয়ে গেল আবুল হোসেন আমাদের মাঝে নেই। আজ থেকে তিনমাস আগে ২১ ডিসেম্বর শনিবার সকালে কাউকে না বলে উধাও হয়ে গিয়েছিল। তাকে সর্বশেষ মুরাদপুর বাস স্টেশানে দেখেছে বলে জানিয়েছে তার সহপাঠি জহিরুল। প্রাথমিকভাবে অপহৃত হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও তাহার মুক্তিপন ঘোষনা করে কেউ যোগাযোগ করেনি। আবুল হোসেন একজন সৎ নির্বিবাধী সাহসী ও মানবতাবাদী সমাজদরদী মানুষ ছিলেন। তিনি গতবছর তার ছেঁড়া পাঞ্জাবীটা রিকশাচালক নুরুল ইসলামকে দান করেছিলেন।"
.
৩.
হঠাৎ চিক্কুর পাক্কুর সব চুপ। কোথাও কোন শব্দ নেই। পোকা মাকড়গুলো অবিরত চিৎকার করে যাচ্ছে। এই ব্যাটাদের গলা ব্যাথাও হয় না। ঝিঁঝিঁ পোকার গলা কি দিয়ে বানানো খোদা মালুম। সিনথেটিক কোন বস্তু না থাকলে ওটা এত চিৎকারে ফেটে চোঙ্গা হয়ে যেত। মশামাছি বরং খুব ভদ্রজাতের প্রাণী। চিৎকারে অভব্যতা নেই। আমার সাহস ফিরে আসছে। উঠে বসলাম সাবধানে। তবু মচ মচ করে কঁকিয়ে উঠলো। এটা শুনে জন্তু জানোয়ার বিরক্ত হলে সেটা প্রাণঘাতি হবে। কোথাও নড়াচড়া দেখলাম না আর। বুঝলাম চলে গেছে যুদ্ধবাজ জন্তুগুলো। যাবার পর মনে মনে কাহিনীটা সাজিয়ে নিলাম।
.
শহরে ফিরতে পারলে এটা একটা দারুণ গল্প হবে। বীরত্বের রস দিতে হবে কিছুটা। রস ছাড়া বীরত্বের কাহিনী জমে না। ঘটনা সব ঠিক থাকবে, কেবল যোগ করা হবে একটা বর্শা। ওটা এই কটেজেই পাওয়া যাবে। সেই বর্শা হাতে নিয়ে আমি জন্তুটার উপর অন্ধকারেই হুংকার ঝাপিয়ে পড়েছি। বর্শার গুতোয় জঙ্গল ছেড়ে পালিয়েছে সেই কাল্পনিক বাঘটা। বাঘের রং অবশ্যই কালো হবে। যদিও অন্ধকার ছিল। পকেটে টর্চ ছিল ওটা জ্বেলে দেখে নিয়েছি। এরকম চাপাবাজিগুলো খুব কাজের, কেউ যাচাই করতে আসবে না।
.
এসব আউল ফাউল চিন্তা করতে করতে ঘুম জড়িয়ে এল। ঘুম ভেঙ্গে বুঝতে পারলাম না বেলা কত হয়েছে। সূর্যের দেখা নেই কোনদিকে। সকাল আটটাও হতে পারে, দুপুর একটাও হতে পারে। যাই হোক, ঘড়ি এখন একটা সেটা পেটের ভেতর। ওটা বলছে খিদা পাইছে, খানা দাও। রাতের কিছু খিচুড়ী ছিল প্যানে। জমে বরফ হয়ে আছে। এই একটাই পাত্র আছে আমার, ওটাতেই রান্না, ওটাতেই খাওয়া। ভাত চা কফি সব একটাতেই। স্টোভটা জাললাম। খিচুড়ী গরম করতে দিলাম। এই স্টোভ যন্ত্রটা আমাকে অবাক করেছে। এতবড় স্টোভ দেখিনি আগে। অন্তত এক লিটার কেরোসিন আছে ওতে। কে রেখে গেল এই জিনিস। এই ঘরের মালিক কে?
.
৪.
ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে উকি দিলাম। সুনসান নীরব। পাখির কিচিরমিচির বাদে কোন শব্দ নেই। কুটিরের চালের দিকে তাকালাম। কাল রাতের ভয়ংকর যুদ্ধের কোন চিহ্ন নেই। যে গাছ দুটোর সাথে ঘরটা আটকানো, সেই গাছের দুটো ডাল চালের সাথে লাগানো প্রায়। সম্ভবত ওদিকেই জন্তুগুলো নেমেছিল ঘরের চালে। তবে কি জন্তু এখনো বুঝতে পারলাম না।
.
খিচুড়ীর পোড়া গন্ধ নাকে আসতেই ঘরের ভেতরে ছুটলাম। দ্রুত চুলা নিবিয়ে নামিয়ে নিলাম প্যান। আধপোড়া জিনিসই খেতে হবে। খেতে বসে একটা কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজের জন্য প্রাণটা আনচান করলো। মানুষের কতো কিছু লাগে। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে খেতে বসে টের পেলাম। পোড়া খিচুড়িসহ খেয়ে ফেললাম। খেয়ে উঠে হাত ধুতে চাইলাম। বাজে অভ্যেস। চামচ দিয়ে খেয়েছি তবু পানি দিয়ে হাত ভেজানো চাই। কদিন এসব বিলাসীতা চলবে না। বনমানুষের কায়দায় থাকতে হবে, নো গোসল, নো পানি। কিন্তু খেতে আর ধুতে পানি লাগবে। বোতলে যে পানি আছে তা দিয়ে এই সকালেও হবে না। খাওয়ার পানি লাগবে এখনই। একটা ভেজালে পড়লাম। সামান্য বাটি ধোয়ার জন্যও ওই দূরের নদীতে যেতে হবে।
.
যাকগে, রোমে এলে রোমান হতে হয়। বোতল আর বাটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ব্যাগগুলো ঘরেই রইলো। এখানে চুরি করার কেউ নেই। পশুপাখিদের চুরিবিদ্যা জানা নেই। অথচ মানুষ নাকি শ্রেষ্ট জীব। এখানে এসে বড় বড় ভাবের কথা মনে আসছে। ফিরে এসে সব লিখে ফেলতে হবে।
.
ঘর থেকে বেরিয়ে মুশকিলে পড়লাম। কোন দিকে নামবো। দেখে মনে হচ্ছে এক মাইল হবে। কিন্তু পাহাড়ে দূরত্ব জিনিসটা বড় বিভ্রান্তিকর। তিন মাইলকে এক মাইলের মতো লাগে। বিশেষ করে নীচ থেকে উপরে কিংবা উপর থেকে নীচে তাকালে একদম বোঝা যায় না আসল দূরত্ব। ওই নদীটা একমাইলও হতে পারে, তিন মাইলও হতে পারে। হোক, আস্তে আস্তে নেমে যাবো। কিন্তু নামবো কোন দিকে। আমি তো ট্রেকার নই যে কোন পথে দড়ি ঝুলিয়ে বা লাঠি ধরে নেমে যাবো। আমার দরকার ভদ্র একটা পথ যেখান দিয়ে কেডস পায়ে নামা যাবে। সোজাসুজি খাড়াই অনেক বেশী। পারবো না। পা হড়কে গেলে দুনিয়ার কোন বান্দা খুঁজে পাবে না আমার হাড্ডিটাও।
.
৫.
কুয়াশা সরে গেলে দেখি সূর্য উঠে গেছে বেশ উপরে। চমৎকার উজ্জ্বল একটা দিন। ঠান্ডা বাতাস রোদে মিশে মিষ্টি একটা গন্ধ পেয়েছে। বাংলাদেশের মতো এত সুন্দর শীতকাল পৃথিবীর কোথাও নেই। ডানদিকে কোনাকুনি নামতে লাগলাম। এদিকে জঙ্গল একটু কম। লাঠি নিয়েছি একটা। পাহাড়ে লাঠি একটা জরুরী বিষয়। পথ খুঁজতে, পথ বাছতে, পথ চিনতে সাহায্য করে। আর সাপখোপের পাল্লায় পড়লে তো বোনাস সার্ভিস। একটু খোলামতন জায়গায় গিয়ে চোখে পড়লো একটা আনারস ঝোপ। একটা পাকা আনারস তাকিয়ে ডাকছে আমাকে। মৌ মৌ করছে পাকা ফলের গন্ধ। তৃষ্ণা মেটাবার একটা পথ পেয়ে আনারস তুলতে গেলাম কাছে। কাছে গিয়ে দেখি শুধু আনারস না, আরেকজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে, লম্বায় তিনি আড়াই হাত হবেন। তিন লাফে পিছিয়ে এলাম। একটা ফুলেল সাপ পাহারা বসিয়েছে আনারসের গোড়ায়। আরেকটু হলে ছোবল দিছিল। আনারসের গন্ধ সাপেদের খুব পছন্দ। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। ওকে ছাড় দিলে আমি তৃষ্ণায় কাহিল হয়ে যাবো। আবার ওকে মারতে গেলে আরো নাগনাগিনী ছুটে আসে কিনা।
.
লাঠিবিদ্যায় আমি মোটামুটি পারদর্শী। এটা একটা ভরসা। তাছাড়া পরনে মোটা জিন্স। পায়ে কেডস। সাপ যদি নেহায়েত কামড়াতে আসে, সুবিধা করতে পারবে না। পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দেবো তার আগে। জায়গামতো একটা হিটই যথেষ্ট। প্রথমে বিরক্ত না করে কাশি দিলাম একটা ভদ্রভাবে। যেন - ভাইসাহেব, আমি একটু যাবো, পথ ছাড়েন।
.
সাপটা মাথা তুললো। জিবটা সুড়ুত সুড়ুত করে ঢোকালো বের করলো। মনে হয় শত্রু মিত্র যাচাই করছে। শত্রু মনে করলে ভয় পায় সাপ, ভয় পেলে কামড়ে দেয়। আমি ভয় না দেখাতে চেষ্টা করলাম। রবি ঠাকুরের কবিতা আওড়ালাম - নিঃশেষে ভয় যে করিবে জয়, ভয় নাই তার ভয় নাই।
.
রবি ঠাকুরের কবিতায় মুগ্ধ হয়ে কিংবা আবৃত্তিকারের কন্ঠের মাধুর্যতায় বিগলিত হয়ে সে পথ ছেড়ে দিতে সম্মত হলো। মাথাটা নামিয়ে উল্টোদিকের ঘাসের জঙ্গলে ঢুকে পড়লো। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। আলগোছে আনারসটা কেটে নিলাম। গোড়ার ডান্ডিটা অক্ষত রেখে ছিলে ফেললাম মোটা দাগে। দারুন মিষ্টি। খেতে খেতে নামছি নীচে। মানুষের রুটিন থেকে বেরুতে পেরে অদ্ভুত প্রশান্তি লাগছে।
.
শহুরে মানুষের রুটিন, অসহ্য! এতটায় ওঠো, অতটায় অফিস যাও, স্কুল যাও, দাওয়াতে যাও, বাজারে যাও, লাঞ্চ করো, ডিনার করো, সব ঘড়ি ধরে। ধুত্তোরি, সব ঘড়ি টড়ি ফেলে দিয়ে এসেছি তাই। স্বাধীন মানুষ আমি এখন। মুক্তির আনন্দে নাচিব আজ সারাদিন। নামার পথটা এবার মোটামুটি সহজ। ঝোপগুলো মনে রাখার চেষ্টা করছি। যাতে এই পথেই ফিরে আসতে পারি।
.
৬.
নদীটা কাছেই দেখা যাচ্ছে। এখানে পাতলা হয়ে গেছে গাছপালা। ছোট ঝোপঝাড়ই বেশী। ওখানেই পেয়ে গেলাম কয়েকটা সফেদা গাছ। বাদামী ফলে ভরে আছে পুরো গাছ। এই ফলটা আমার বিশেষ প্রিয়। দুতিনটে পেড়ে খেতে বসে গেলাম। কিছু নিয়ে যেতে হবে। পকেটে একটা পলিথিন ব্যাগ আছে। ওটায় ভরে গাছের তলায় রাখলাম। নদী থেকে ফেরার পথে নিয়ে যাবো।
.
নদীর কিনারে গিয়ে আমি নির্বাক। এত সুন্দর স্বচ্ছ কোন নদী হতে পারে, বিশ্বাস হয় না। এটা কি বাংলাদেশ? চারপাশের উচু পর্বতে ঘেরা সবুজ কেমন অপার্থিব মনে হলো। আমি যেন এই জগতে একা। আসলেই তো একা।
.
তখনই আইডিয়াটা এলো। গোসল সেরে ফেললে কেমন হয়। তোয়ালে টোয়ালে কিছু নেই। কাপড় বদলাবার উপায় নেই। তাতে কি। এই জগতে আমি ছাড়া কেউ নেই। একদম আদম হয়ে নেমে গেলাম স্বচ্ছ জলধারায়। কোমর পানিতে গিয়ে দাড়ালাম। বেশ ঠান্ডা পানি। কিন্তু প্রবাহমান জলধারার তাপমাত্রা খানিক উপরে। আরামই লাগছে। মুখ ডুবিয়ে পানিতে কুলি করলাম। খেলাম ঢকঢক করে। পেটে করেও পানি নিয়ে যাই। কয়েকটা ডুব দিয়ে উঠে গেলাম।
.
ফেরার পথে আর কোন সমস্যা হলো না। চেনা পথেই ফিরে এলাম। খিচুড়ীর প্যাকেট খুলে রান্না চড়িয়ে ডায়েরী নিয়ে বসলাম। সিগারেট ধরিয়ে কলমটা বের করলাম। লিখতে শুরু করলাম ভাবের কাহিনী। লিখতে লিখতে এত মগ্ন ছিলাম যে চুলার খিচুড়ী উৎড়ে চুলাটাই নিবিয়ে দিল সাঁ করে। বিপদের কথা। চুলা না জ্বললে চা হবে না, রান্না হবে না, উপোষ দিতে হবে। চুলো পরিষ্কার করতে পানি লাগবে। অত পানি ষ্টকে নাই। একটা বুদ্ধি আসলো। স্টোভটাকে খুলে ফেললাম। স্টোভের ফিতাগুলো ভিজেছে মাথার দিকে। গোড়ায় আরো লম্বা ফিতা আছে। একেকটা ফিতা টেনে টেনে মাথাগুলো ছেটে দিলাম। হাতে কেরোসিন লেগে গন্ধ হয়ে গেল। তবু ভালো, লতাপাতায় আর মাটিতে হাত ঘষে দূর করা যাবে গন্ধটা। স্টোভ জ্বললো, আমার মুখ উজ্জ্বল হলো। রবিনসন ক্রুসো হিসেবে মন্দ হচ্ছে না।
.
বিকেলে আরেকটা জরুরী কাজে হাত দিলাম। পাইপগান বানাবো একটা। পকেট নাইফটা খুব কাজের। নানারকম যন্ত্র আছে এটাতে। করাতের মতো একটা জিনিস আছে তা দিয়ে ছোট ছোট বাশের ডাল কেটে আনলাম কাছের জঙ্গল থেকে। সেই বাশের পাইপ কেটে সমান করলাম। জঙলী কায়দার অস্ত্র। বাশের কঞ্চিকে সরু করে ছেচে নিয়ে তীরের মতো সুক্ষ্ণ করা হলো। মুখের বাতাস দিয়ে সেই তীর ছুড়ে দেয়া যাবে শত্রুর দিকে। কোন সিনেমায় দেখেছিলাম।
.
পাইপও তৈরী, মিনি সাইজ বর্শাও। কিন্তু ফু দিতে গিয়ে দেখি দেড়ফুট দুরে গিয়ে হুমড়ি খাচ্ছে আমার সাধের তীর। ছেলেবেলায় শোনা বড়দের উপদেশ মনে পড়লো -সিনেমা দেখে সবকিছু বিশ্বাস করতে নেই। রাজ্জাক যে শাবানাকে জড়িয়ে ধরে ওসব মিথ্যে। ওরা দুর থেকে দুই হাত বাড়িয়ে দাড়িয়ে থাকে। কিন্তু ক্যামেরার কারসাজিতে কাছাকাছি দেখায়। ওরা কখনোই একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেনি। আরেকবার ইচড়ে পাকা এক কাজিন কয়েক ডিগ্রী বাড়িয়ে বলেছিল, সিনেমায় ধরাছোঁয়া এত সহজ না। রাজ্জাকের নাকি একবার খুব ইচ্ছে হইছে শাবানাকে একটা সত্যি সত্যি চুমু দিবে। সেজন্য তাকে পাঁ-চ-শো টাকা দিতে হইছিল। সহজ কথা নয়।
.
যাকগে ওসব কথা। আপাততঃ আমার অস্ত্রবিদ্যা বিফলে গেল। রাতের বেলা আবারো অরক্ষিত থাকতে হবে। কোন হারামজাদা জন্তু দাপাদাপি করছে বুঝতে পারলে অন্তত সেরকম ব্যবস্থা নিতে চেষ্টা করতাম। দিনের আলো থাকতেই খাওয়াদাওয়া সেরে ফেললাম। আদিম মানুষ তাই করতো। সূর্যটা যেন টুপ করে হারিয়ে গেল। বোঝার আগেই। অবশ্য তার আগেই কুয়াশা এসে চারদিক অন্ধকার করে ফেলেছিল।
.
সূর্য ডোবার সাথে মনটা কেমন উদাস লাগলো। একাকীত্ব পেয়ে বসেছে। দিনের আলোয় যেরকম চরম উৎফুল্লতা ছিল। এখন তা একদম নিভে গেছে। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মনে হলো সময় এখানে স্থির। কোথাও যাবার নেই। যাবার উপায় নেই। মানুষ কতো অক্ষম প্রাণী। এমনকি একটা বিড়ালও এই সময়ে আমার চেয়ে অনেক বেশী ক্ষমতাবান। রাতের অন্ধকারে পথ চিনে যেতে পারে। খাবার খুঁজতে পারে, শিকার করতে পারে। আমার মানুষ জন্ম আস্ত একটা ঘোড়ার ডিম।
.
এই রাতে কিরকম উৎপাত আসতে পারে ভাবতে ভাবতে চোখ জড়িয়ে এল। এমন ঘন ঘুম এলো, ঘুমানোর আগে যে শিল্পীরা সমবেত সঙ্গীত গাইছিল, তারা যে ক্ষুদে বর্শা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মচ্ছব শুরু করেছে তা টের পেতে অনেক দেরী হয়ে গেল।
.
.
[আগামী পর্বে সমাপ্ত হতে পারে]
বাহ, টানটান উত্তেজনার মইধ্যে আছি। আমি আর অমরা সবাই... তারপর কী হৈলো বদ্দা...?
আসতেছে, একটু জিরায়া লই কদিন
মনে হলো আমি যেন ঘুর আসলাম এই মাত্র ওই জায়গা থেকে ।
আপনিতো পুরো চষে ফেলছেন এইবার
শেষ পর্ব কখন আসবে নীড়দা?
শেষ করার আগে আবার ভূত হইয়েন না। পিলিজ লাগে।
বুঝছি আপনি সেই মাইকঅলার মতো বসে আছেন কখন বক্তৃতা শেষ হবে, আপনি মাইক নিয়া দোকানে জমা দিবেন
জঙ্গলে তো একদম ইচ্ছেমত আছেন, অপার্থিব সৌন্দর্যটা দেখতে পেলাম যেন। শেষ পর্বের অপেক্ষায়।
বুঝছি, গুটানোর সময় হয়ে আসছে, আগামী পর্বেই বাসা বদল করে নিরুদ্দেশ যাত্রা..........
অন্তর্হিত হয়ে গেলাম পড়তে পড়তে। পরের পর্বটা আরো ডিটেল হওয়া চাই।
পরের পর্বের অপেক্ষায়
ফিরবেন কবে চিটাগং???
আমি দেশে যাওয়ার আগেই কিন্তু আইসে পইড়েন।
গল্প পড়ে মনে হচ্ছে সত্য কাহিনী পড়ছি। যদি কাহিনী সত্যই হয় তবে লেখকের সাহস ও উদ্দমের প্রতি লক্ষ্যকোটি স্যালুট। আর যদি হয় কল্পনা, তবে লেখকের কল্পনা শক্তি বাস্তবতাকে হার মানিয়ে দিচ্ছে । বর্ণনা অতি নিখুঁত, বলবার ঢং অতীব আকর্ষণীয়। মনে হচ্ছে, আমিই যেন সেই ব্যক্তি, যে এই ভ্রমণে বেরিয়েছে। অভিনন্দন - আপনার সাথে আছি ।
সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ নাজমুল ভাই। আপনার অভিজ্ঞতার ঝুলির তুলনায় এসব কিছুই না।
নতুন এলাম। আদের পর্ব পড়া হয়নি, পড়ব।
মনে হচ্ছে জমে যাচ্ছে কাহিনী।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়।
শুভকামনা অবিরাম
চলুক----
ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য
এই সেই পাহাড়। যেখানে আবুল ভাই ছিলেন।
জী। কিন্তু আপনি কই ছিলেন সেদিন। নৌকায় নাকি? এরকম মারাত্মক সুন্দর ছবি দেখলে মাথা নষ্ট হয়ে যায়। জঙ্গল থেকে ধোয়া উড়ছে। একটা হাই রেজুলেশন ছবির আবদার করতে পারি। নয়তো ফ্লিকার লিংক দেন।
বৈচিত্রময় দিবসের অপেক্ষায় থাকলাম।
আরো বৈচিত্রময় দিবস চাই?
সবচেয়ে ইন্টারেষ্টিং হলো আবুল ভাইয়ের পর্বটা। টান টান উত্তেজনায় ইট্টুখানি হাস্যরস
মন্তব্য শুনে আবুল ভাই কৃতজ্ঞ
আমি সবার শেষে।
তারপর ? তারপর কি হলো ?? এত দেরী কেন ???
নীড়দা' পরের পর্ব কৈ? অপেক্ষায় আছি।
মন্তব্য করুন