গুইশ
১.
"মেয়ে জেগে আছে, আস্তে কথা বলো," চাপা গলায় টুম্পার মা যেন গর্জে উঠলো। টুম্পা অবশ্য সবই শুনতে পেল। প্রতিদিনই বাবা-মা'র এরকম নোংরা ঝগড়া হয়। প্রতিদিনই দুজন দুজনকে বলে, "টুম্পা জেগে আছে, আস্তে কথা বলো" ,- তারপরেও টুম্পা প্রতিদিনই সব শুনতে পায়। প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ হতো...মন খারাপ হয়, এখনও। আজ বিছানা থেকে আলতো পায়ে নামলো, আস্তে করে ঘরের দরজাটা ভিড়িয়ে দিল। এখনো অবশ্য বাবা-মায়ের চাপা গলার ঝগড়া শোনা যাচ্ছে, শুধু দরজার বাধা পেয়ে শব্দগুলো দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে...এই বা কম কি?
বিছানায় শুয়ে একটা-দুটা করে ভেড়া গুনতে লাগলো টুম্পা। যদিও ভেড়া গুণে কোনদিনই তার ঘুম আসে না। কোন বোকার হদ্দ যে এই ভেড়া গুণার সিস্টেম বের করেছে! আসলে যখনই সে খুব করে ঘুমাতে চায়, তখুনি তার ঘুম পায় না। দিনের বেলা যখন বাসায় একলা থাকে, তখন রান্নাঘর থেকে কি যেন একটা খুটখুট আওয়াজ হয়। ভয়ে টুম্পার ভীষণ কান্না পায়, ইচ্ছে করে জোর করে ঘুমিয়ে পড়তে, পারে না। মা অবশ্য বলে ইঁদুরের আওয়াজ, টুম্পার বিশ্বাস হয় না। ইঁদুরের বয়েই গেছে তাকে ভয় দেখাবে! আবার যখন সে খুব করে জেগে থাকতে চাইতো, তখন কেমন করে যেন ঘুমিয়ে পড়তো। একটা সময় বাবা-মা পালা করে অনেকরাত পর্যন্ত গল্প করতো। মাঝে মাঝে মা গুনগুন করে গানের সুরও ভাজতো। টুম্পা তার বাবা-মার মাঝখানে ঘুমের ভান করে পড়ে রইতো। কতো যে জেগে থাকতে চাইতো তখন...আড়ি পেতে বাবা-মার সব গল্প শুনতে ইচ্ছে করতো। পারতো না, কেবলই ঘুম পেয়ে যেত। মাঝে মাঝে অবশ্য মা বুঝে যেত, বাবাকে বলতো, "এই! তোমার মেয়ে এখনো ঘুমায়নি। ঐ দেখ, চোখ পিটপিট করছে।" বাবা হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরতো।
২.
ঘুমটা প্রায় এসেই পড়েছিল, এমন সময় চোখে একটা হালকা আলোর রেখা পড়লো। কেউ কি ঘরে ঢুকেছে? মা? ঘুমের ভান করে পড়ে রইলো টুম্পা। এখন চোখ পিটপিট না করেও ঘুমের ভান করতে পারে টুম্পা, মাও বুঝতে পারে না। বাবা-মার শোবার ঘর থেকে ঠিকরে পড়া আলোর মতো স্থির না আলোর রেখাটা, নড়াচড়া করছে। পুরো বাসা নীরব। মা হলে এতোক্ষণে চুলে হাত বুলিয়ে দিত, কিংবা টুম্পার পড়ার টেবিলটা গুছাতো। চোখ পিটপিট করে একটু খুললো টুম্পা, সাথে সাথে চোখ বরাবর আলো ঝলসে উঠলো, আর এক অট্টহাসি। "হা হা হা, জানতাম তুমি জেগে আছ, হা হা হা! যা ঘুমের অভিনয় করতে পারো না!"- হাসতে হাসতে যেন ছেলেটার পেটে খিল ধরে গেছে, পেট চেপে হাসছে। টুম্পা একটু বিরক্ত চোখে তাকালো। ছেলেটা অদ্ভূত, চোখ থেকে আবার টর্চলাইটের মতো আলো বেরুচ্ছে। এরকমটা আগে দেখেনি ও, নতুন কোন খেলনা নাকি? তার চেয়েও বড় কথা, এ ছেলে এখানে আসলো কিভাবে?
বিরক্ত গলায় টুম্পা জিজ্ঞেস করলো, "কে তুমি?" ছেলেটা তখনো হাসছিল, ভীষণ জোরে...পুরো এলাকা জাগিয়ে তুলবে এমন হাসি।
"আস্তে! থামো, এতো হাসির কি হলো?" ধমকে উঠলো টুম্পা।
"হাসির কি হলো? হা হা হা," হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়লো ছেলেটা, যেন টুম্পার ধমককে পাত্তাই দিলো না।
টুম্পা রেগেমেগে বললো, "আস্তে হাসো, বাবা-মা জেগে যাবে।" একটু আগেও বাবা-মার ঝগড়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল, এখন এই কিম্ভূত ছেলেটার হাসি বাদে আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। মনে হয় কানে তালা লেগে গেছে।
হাসি থামিয়ে দম নিতে নিতে ছেলেটা বললো, "জেগে যাবে মানে? তোমার বাবা-মা তো এখনো জেগেই আছে," আবার হাসতে শুরু করলো, "জেগে যাবে, হা হা হা..." কার্টুনের মতো পেট চেপে হাসছে। টুম্পা হাল ছেড়ে দিল, এই ছেলেকে যা-ই বলে, তাতেই হাসে।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে তারপরে টুম্পা জিজ্ঞেস করলো, "নাম কি তোমার?"
"গুইশ...গুইশ।"
যেমন অদ্ভূত ছেলে তার চাইতেও অদ্ভূত নাম! গুইশগুইশ! টুম্পা বললো, "গুইশগুইশ?! এ আবার কেমন নাম!"
"আরে নাহ, খালি গুইশ।"
"খালি গুইশ? আহমেদ মোহাম্মদ কিছু নাই?" জিজ্ঞেস করলো টুম্পা।
"মোহাম্মদ গুইশ, আহাম্মদ গুইশ...হা হা হা" আবার হাসিতে ভেঙ্গে পড়লো গুইশ।
"তোমার চোখের লাইটটা নেভাও, চোখে লাগছে।" বিছানায় বসে হাত দিয়ে চোখটা আড়াল করতে করতে বললো টুম্পা। গুইশ মাথার পেছনের কি এক নাট না বল্টু প্যাচাতে লাগলো। তাতে চোখের লাইটটা দাপাদাপি করতে লাগলো পুরো ঘর জুড়ে, ওকেও কিছুটা অপ্রস্তুত দেখাতে লাগলো। তারপর বিব্রত গলায় বললো, "আজকেই লাগিয়েছি তো..."
"লাগিয়েছো মানে? চোখে আবার লাইট লাগাও কিভাবে?"
"আরি! তাই তো! তোমার চোখে লাইট কই? এজন্যই তো ভাবি, তোমাকে দেখে এতো হাসি পাচ্ছে কেন! হা হা হা..."
এরপরেও এ পাগলাটে ছেলের সাথে কথা চালাবার কোন মানে হয় না। খালি হাসে, অহেতুকই হাসে। গুইশ অবশ্য টুম্পার বিরক্তি বুঝতেই চেষ্টা করলো না, নিজের কোকড়া কোকড়া চুলগুলোর ফাঁকে কিসব গুতাচ্ছে। তার চোখের আলোটা কখনো নীল কখনো লাল আর হলুদ হয়ে যাচ্ছে। তা-ই দেখে আবার নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়ছে।
টুম্পা হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বালিশে মাথা গুজে চোখ মুদলো কি মুদলো না...এমনি সময় হাত ঝাঁকাতে লাগলো গুইশ, "এই! ঘুমিও না!"
টুম্পা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিল, তারপর বিরক্ত মুখে বললো, "কেন?"
"ঘুমালে আবার জেগে যাবে তো! হা হা হা!"
টুম্পা এবার রেগেই গেল, এ ছেলেকে পাত্তাই দেয়া যাবে না। শুধু শুধু হাসে। আবার ঘুমাবার জন্য চোখ বুজলো টুম্পা, "সত্যি বলছি! জেগে যাবে, ঘুমিও না," গুইশের কণ্ঠ একটু যেন কাতর শোনালো। আর প্রথমবারের মতো যেন ওর হাসিটাও একটু বন্ধ হয়েছে।
"মা পাঠিয়েছে, তোমার সাথে কথা বলার জন্য। যেন তুমি আবার ঘুমিয়ে না পড়ো," বলতে বলতে টুম্পার আলমারিতে চড়ে বসলো গুইশ।
টুম্পা জিজ্ঞেস করলো, "কার মা?"
"কার মা মানে?! আমার মা!"
"তোমার মা?" অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো টুম্পা।
গুইশ সন্দিগ্ধ চোখে টুম্পার দিকে তাকিয়ে রইলো, মানুষ যেমন করে পাগলদের দিকে তাকায়। টুম্পা নিজেকে সামলে নিল। গুইশ ছেলেটা অদ্ভূত-ঠিক আছে; তাই বলে মা থাকবে না!
"আচ্ছা, এই যে বার বার বলছো, ঘুমালে জেগে যাব...মানে কি?"
"হুমম," পা দোলাতে দোলাতে মাথা ঝাঁকালো গুইশ।
"হুমম মানে? ঘুমালে জেগে যাব, কোন মানে আছে এই কথার? ঘুমালে তো ঘুমিয়েই পড়লাম!" অবাক কণ্ঠে বললো টুম্পা।
"তো তুমি কি জেগে আছ নাকি? হা হা হা...তুমি তো ঘুমিয়েই আছ, হা হা হা"
"আস্তে, চুপ!" ধমকে উঠলো টুম্পা। তারপর বিড়বিড় করে নিজেকেই জিজ্ঞেস করলো, "আমি স্বপ্ন দেখছি নাকি?" সেটাও আলমারির উপর থেকে শুনে ফেললো গুইশ, সাথে সাথে জবাবও দিল, "হুমম।"
গুইশের দিকে তাকিয়েই টুম্পা কি যেন একটা মনে করতে চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না! কিছু একটা মনে পড়ার কথা...
"চিমটি কাটার কথা ভাবছো? হা হা হা...," হাসতে লাগলো গুইশ, "মানুষ যে এত বোকা কিভাবে হয়! চিমটি কেটে কারও কোনোদিন স্বপ্ন ভাঙ্গে? হা হা হা...আরে চিমটি কাটার কথাই তো মনে থাকে না!"
"ভালো হয়েছে, মনে করিয়ে দিয়েছো," দাঁতে দাঁত চেপে বললো, "তোমার ক্যানক্যানে বিরক্তিকর হাসি আর শুনতে হচ্ছে না, এক্ষুণি চিমটি কেটে স্বপ্ন ভাংছি।"
"এই রে!" জিভ কাটলো গুইশ,"না না প্লিজ! আর হাসবো না। এই চুপ মেরে গেলাম। প্লিজ!" বলেই মুখ চেপে বসে রইলো গুইশ। হাসবে না বলেও হাসি চাপার চেষ্টা করছে, পারছে তো না-ই...উল্টা ওকে দেখে টুম্পারও হাসি পেয়ে যাচ্ছে। খিলখিল করে হেসে উঠলো অনেকদিন পর, প্রাণখুলে...
৩.
তখন রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ঝগড়ার কি তবু শেষ হয়? রণে ভঙ্গ দিয়ে মা কাঁদতে কাঁদতে টুম্পার ঘরে এল। দেখলো মেয়েটা ঘুমের মধ্যেই হাসছে। "মেয়েটা হাসলে এতো সুন্দর লাগে..." মনে মনে ভাবলো মা, "ওর বাবা দেখলে খুব খুশি হতো।" এক মুহূর্তের জন্য যেন রাতভর ঝগড়ার কথা ভুলেই গেল। টুম্পার বাবাও যে মেয়ের সে ভুবনভোলানো হাসি দেখেনি, তা না। ঝগড়ার রেশ ধরেই শেষ কয়েকটা কথা বলে বিজয়ী হতেই টুম্পার মায়ের পিছু পিছু এসেছিল। মেয়ের হাসি দেখলো, সাথে মেয়ের মায়ের চোখের পানিতে এক ঝিলিক আনন্দ দেখলো। আর মনে মনে ভাবলো, "ঝগড়াটা নাহয় অন্য কোন রাতের জন্য তোলা থাক!"
বাহ। বাহ।
২. এ গুইশ আর টুম্পার কথোপোকথন টা এত্ত মজাদার লাগলো..
এমন ছেলেমানুষি স্টাইল এমন আনন্দ, ইশ, যদি পাইতাম টাইপ মনে হৈতাছে..
খুবই সুন্দর হৈছে ভাঙ্গা।
ছেলেমানুষি টাইপ আনন্দ পাইতে চাইলে বয়স কমায়া আবার পোলাপান হয়ে যান
সুন্দর লাগলো...
থেঙ্কু
এট বড়দের গল্প।
তবে গুইশকে আমার অনেক ভালো লেগেছে।
আমার একটা উইশ
চাই একটা গুইশ----------
গুইশ এর আর পর্ব হবে না?
গুইশ এর আর কি পর্ব হবে? আপনি কি চান টুম্পার বাবা-মা আবার ঝগড়া শুরু করুক?
ভালো লাগলো
ধন্যবাদ
আর মনে মনে ভাবলো, "ঝগড়াটা নাহয় অন্য কোন রাতের জন্য তোলা থাক!
হুহ, ঝগড়ার সময় কারো এসব চোখে পড়লেতো।
গল্পেই এমন হয়। বাস্তবে হলে ঘরে ঢুকে টুম্পার মাকে শেষ প্যারাখান শুনিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গীতে ঘুমাতে যাবে।
গল্প সুন্দর হয়েছে। শামিউলের কারনে কি এটা লেখা নাকি ভাঙ্গা?
গল্পটার আইডিয়া অনেক পুরানো, আর অবশ্যই এরকম না। আমার চিন্তা ছিল গুইশ চরিত্রটা আরেকটু ফুটিয়ে তুলে অনেকটা ফ্যাণ্টাসি টাইপ গল্প লেখা। ফ্যান্টাসি গল্প লেখার মতো কল্পনাশক্তি আমার নাই। সুতরাং কেমনে কেমনে যেন গল্পটা ফালতুই হয়ে গেল। যদিও গল্পটার প্লট অনেক আগে টুকে রাখা, শামিউলের খবরটাও গল্প লেখার সময় মাথায় ছিল...প্রভাবক বলা যায় মনে হয়।
মন্তব্যে দেখলাম লিখেছেন, গল্পটা ফালতুই হয়ে গেলো। টেনশনে পড়ে গেলাম। আমি ভাবছি চমৎকার একটা গল্পের জন্য ভাঙ্গাদা'কে জম্পেশ একটা ধইন্যা দিতে হবে আর বলে কি না ফালতু গল্প???
আবার পড়লাম। কোথাও কি ফালতু কোন কিছু মিস্ করলাম কি না দেখার জন্য। নাহ্। কোথাও ফালতু কিছু পাইও নি মিস্ও করি নি। দাদা মনে হয় মন্তব্যে ভুল করে কথাটা লিখে ফেলেছেন যাহোক।
২ নং এর চতুর্থ লাইনে প্যারাফ্রেজিং দরকার ছিলো মনে হয়েছে। গুইশ নামকরণটা অদ্ভূত হয়েছে। বিশ্বাস করি যে এমন নাম দিতে পারে সে ফ্যান্টাসী গল্প লেখার কল্পনাশক্তি খুব ভালোমতোই ধরে। শুভকামনা রইলো।
এই কারণেই বলছিলাম, ফ্যাণ্টাসি গল্প লেখার মতো কল্পনাশক্তি আমার নাই। গুইশ নামটা ঠিক কল্পনাশক্তির কর্ম না।
"গুইশ" শব্দটা ছিল আমার মুখের প্রথম বুলি(মায়ের মুখে শোনা)। প্রায় তিন বছর পর্যন্ত যাবতীয় কথাবার্তা আমি "গুইশ গুইশ" বলেই চালাতাম। গল্পটা লেখার সময় কোন নাম মাথায় না আসায় গুইশই রেখে দিলাম
আর তাতেই বাজিমাত
মেয়ের মুকহে হাসি দেখে বাবা-মা ঝগড়া ভুলে গেল, মেয়ের মুখে হাসিটা আনলো কে? গুইশ। আহারে ঘরে ঘরে একটা করে গুইশ থাকলে সব বেবীরা হাসত আর সব বাবা-মা ঝগড়া ভুলে যেত।
এবার বল আমি কি গুইশ চেয়ে ভুল করেছি?
গুইশ না চেয়ে বরং ঝগড়া না করলে ভাল হইতো
ভাল হয়েছে
ভালো লাগলো। অনেক ভালো। থ্যাংকু ।
য়ামার থ্যাঙ্কু আপ্নে কইলে আমি কি কমু
খুব ভালো লাগলো ।
ধন্যবাদ
তো তু্ইত! গু্ইশের একটা স্কেচ দিও।
গু্ইশ সিরিজ চলুক। শুধু ঐ এক বাড়ীতেই গু্ইশ থাকবে/যাবে তা তো না। এই ধরো গণভবনে চলে গেলো... এমনকি আমাদের বিমার বাসরেও যেতে পারে
বিমাদা ভদ্দরলুক না হইলে এক বছর পরে গুইশরে পাঠায় দিব
বাহ্, মজার তো।
গুইশ তো দারুন চুইইইইট।।
গল্পটা পড়তে ভাল লাগছে.।।।
থেঙ্কু
গুইশ কি ব্রাজিল করে?
ভাল্লাগছে
গুইশ কিছু করে না
মন্তব্য করুন