খারাপ মেয়ের খোঁজে
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে একটা খারাপ মেয়ের গল্প লিখি।
কিন্তু বিষম একটা সমস্যায় পড়ে যাই। বারবারই।
খারাপ মেয়ে মানেটা যে কী, সেটা ঠিক ধরে উঠতে পারিনা।
ছোটবেলায় ব্যাপারগুলো অনেক সহজ ছিলো। এই যেমন ধরি, দুধ না খেলে খারাপ মেয়ে, চুল আঁচড়ে না বাঁধলে, দাঁত না মেজে দাঁতে পোকা হলে, ঝগড়াঝাঁটি করলে, পুতুল খেলায় খামচাখামচি করলে - এগুলোকে অনায়াসেই খারাপ মেয়ের বৈশিষ্ট্য বলে চালিয়ে দেয়া যেতো।
আরেকটু বড় হলে তো স্কুলে তীব্র ও তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্যে হোমওয়ার্ক না করে আনলে, টিচারের কথা না শুনলে- অবধারিত তুমি খারাপ মেয়ে! আরো বড় গজকাঠি ছিলো বোধকরি শিষ্টাচার। এই এক বিষয় ছিলো স্কুলে, যাতে আমার বান্ধা ২৫ শে ২৫। সবসময়। আর পিটি। এটাতেও ২৫শে ২৫! বাসায় যতই দুষ্টুমি করে ফাটিয়ে ফেলিনা কেন, স্কুলে আমি বরাবরই শিষ্ট। সুত্রানুযায়ী, এখানে যারা কম নাম্বার পাচ্ছে তারা খারাপ মেয়ে। আমি ছিলাম সবচাইতে চঞ্চল, সবচেয়ে ছটফটে। ভীষণ দুরন্ত। তারপরেও কোন্ যাদুমন্ত্রবলে প্রতিবার ভালো মেয়ের খেতাব জুটে যেতো, বুঝতে পারতাম না। আমার মা'ও বোধ করি বুঝতেন না।
ক্লাসে ফার্স্ট হওয়াতে ইজ্জত মান কিছুটা বাঁচতো। নইলে বাবা-মা আমাকে "ভালো" মেয়ে সার্টিফিকেট দিতে যারপরনাই গাঁইগুই করতো, এটুকু জানি।
একটু বড় হতে হতে, দেখি সরে যাওয়া গোলপোস্টের মতো খারাপ মেয়ের সংজ্ঞাও পালটে যাচ্ছে।
যে মেয়েগুলো ডায়াস ফাটিয়ে চ্যাঁচায়, ওরাই দেখি সবচেয়ে ধারালো যুক্তি দেয় বিতর্কের সময়। ক্লাস পালানো প্রেম করা খারাপ মেয়েগুলো দারুণ ইন্টারেস্টিং আমার পানসে জীবনের পাশে। সুইসে আমি আম্মাকে নিয়ে যাই, বেলা আড়াইটা পর্যন্ত প্র্যাক্টিকাল করার পরে ভোঁ ভোঁ করছে মাথা আর পেটে ছুঁচোর কেত্তন - সে সময় অব্দি আমার একটা প্রেমও হয়নি। ন্যাকামি করছিনা, প্রমিস।
আমি মুখ নিচু করে সুইসের ভ্যানিলা পেস্ট্রিতে কামড় বসাই, আর পাশে প্রিতুর বয়ফ্রেন্ড লাজলজ্জার মাথা খেয়ে ওর মুখের আধখাওয়া প্যাটিস চুমোর বদলে টান দিয়ে নিয়ে নিলো- মুখে মুখে এক মুহূর্ত ছোঁয়াছুঁয়ি হলো কি? ছিঃ! দেখতে নেই ওসব। খারাপ মেয়েরা করে।
আচ্ছা, এতো গ্যালো কিশোরী বয়সের কথা।
বড় হতে হতে অনেক পুরুষতান্ত্রিকতার চর্চাকে নিত্যসঙ্গী করে বেড়ে ওঠা। জানিতে বা অজানিতে, চেয়ে বা না চেয়ে অনেক পুরুষপ্রধান প্র্যাকটিসকে বাহবা দিতে শেখা। অথবা নিজের অজান্তেই সেগুলো সমাজ আর সংসারের চর্চায় একরকম সয়ে যাওয়া। বা সইয়ে নিতে শেখা।
তখন জানলাম, বুঝলাম ভালো মেয়েরা মুখ খারাপ করেনা, খিস্তি করেনা।
সিগারেট খায়না।
অতি অবশ্য অবশ্য সিগারেট খেলে তারা খারাপ মেয়ে।
এটা আমার কাছে শাঁখের করাতের মতো লাগতে লাগলো একসময়।
আমার খুব কাছের একটা মেয়েবন্ধু সিগারেট খায়, আমার সিগারেটের গন্ধে বিষম বমি পায়। যে কোনো কড়া গন্ধেই পায়। আজও পায়।
একদিক থেকে আমি সিগারেট খাওয়া সমর্থন করতে পারিনা, অন্যদিক থেকে প্রাণের বন্ধুর টান উপেক্ষাও করতে পারিনা। ও ছেলে বা মেয়ে যাই হোক, আমি প্রাণপণে ওর সিগারেট খাওয়ার আনন্দটুকু কেড়ে নিয়ে ওকে ভালো মেয়ে হবার পথে চালিত করতে রীতিমতো ব্যতিব্যস্ত করে তুললাম। ইংরেজিতে যেমন বলে, ইন্টেনশন ওয়াজ নোবল্, কিন্তু আমি ভুলে গেলাম ও বেচারীর বাড়ির কথা, কী ভীষণ একটা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো ও সে সময়। আরো ভুলে গেলাম, ওই দমবন্ধকর পরিবেশ আর পরিস্থিতিতে ওর একটুখানিক নিজস্বতা যা বেঁচে ছিলো, তা ওই সিগারেট খাওয়া বা আধময়লা জিন্স পরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। ওর সিগারেট, আমার পালিয়ে লুকিয়েচুরিয়ে মডেলিং করার জন্য ছবি তোলা বা লেখালেখির মতোই একটা আউটলেট ছিলো। ভেন্টিলেটর।
এই ভেন্টিলেটর বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবার পর খারাপ মেয়ে নির্ধারণ করা আমার জন্য আরো কঠিন হয়ে গ্যালো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম তসলিমা নাসরীনের সব খারাপ মেয়ে বিষয়ক গল্পগুলোর সাথে হয় আমার নয় আমার চারপাশের বোন, বন্ধু, কাজিন, আন্টি সবার অনেক মিল! এমন কী যখন চেঁচিয়ে খারাপ মেয়ের কবিতা পড়ি, তখন বিষম একটা আনন্দ হয়।
একটা পর্যায়ে এসে শরীর বিষয়ক তুমুল ছুত্মার্গ দেখলাম।
নব্বই শতাংশ মেয়েদের ভেতর ধারণাটাই ধোঁয়াটে।
ছেলেদের ভেতর ভণ্ডামির পরিমাণ বেশি, ওপরের আবরণটা সরলে শরীরের ঔৎসুক্য বিষয়ে তাদের অবস্থান যাহা পাই তাহা খাই ধরনের।
মেয়েদের ধোঁয়াটে হবার কারণ দেখলাম মূলতঃ শুচিতার সংজ্ঞায় তাদের অপরিসীম আস্থা, আর শরীর একটা সম্পদ বা অস্ত্র যাই বলিনা কেন, এই চিন্তাটা মাথার ভেতরে খুব ছোটবেলা থেকে গেঁড়ে বসা। খুব দোষ যে দেওয়া যায় তাদের তা নয়, কিন্তু শরীরী এই অন্ধত্ব, শুধু শরীরী থাকেনা (থাকা সম্ভবও নয় বোধ করি বাংলাদেশের তীব্র পুরুষিক সমাজের ততোধিক পুরুষিক আচরণের জন্য), মানসিক অর্গল হয়ে যখন শারীরিক সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যের বিকাশকেও রদ করে, তখন আমি আবারও হোঁচট খাই।
শরীর দিয়ে সুখ খুঁজতে যাওয়া নারী আর পুরুষের স্তরায়নে এত তফাত। এতো বেশি ডিস্প্যারিটি! তখন খারাপ মেয়ে হিসেবে যেই মেয়েগুলোকে দেখতাম, বা লেবেলিং করা হতো, আজ প্রায় দশ বছর একটা অন্য সমাজে থেকে, সেই সমাজের ভেতরের রূপটাকে আগাপাশতলা দেখে সেই লেবেলিংকে বড় অর্থহীন মনে হয়। শরীরের সুখ যে টাকাপয়সা বড়িগাড়ির মতই সুখ এবং তার অণ্বেষণ যে অন্য সব এষণার মতোই বাঞ্ছনীয়, এটা বুঝতে বা মেনে নিতে আমারও সময় লেগেছে। একটা রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে আপাতঃ অনতিক্রম্য সেই ট্যাবুকে পার হতে হয়েছে। কিন্তু একবার সেটা পার হবার পর দেখি খারাপ মেয়ে খুঁজে পাওয়া বড়ই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
একসময় য়্যুনিভার্সিটিতে স্কার্ট পরাটা খারাপের সংজ্ঞা ছিলো, কখনো পা দেখানোটা। এখন অফিসে এন্তার স্কার্ট পরি, পা সবসময়ই দেখাই। কালো মানুষদের বদলে সাদা মানুষরা দ্যাখে, এই যা! নাইনে ওঠার পর জোবার সাইকেলটা নিয়ে পাড়া দাপানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, সেদিন আমার পার্টনার বললো দূরের সাবার্বে বাড়ি কিনলে ছায়াঢাকা পাখিডাকা পার্কের ভেতর দিয়ে আমরা বাইক চালিয়ে আসবো, আবার শিখতে হবে সাইকেলের অ আ ক খ। চম্কে উঠে দেখি, আবারও গোলপোস্ট সরে গেছে।
ভালো কিংবা খারাপ মেয়ের বিভাজক রেখা বেঁচে নেই আর মাথার ভেতর।
খচখচানিটা বেঁচে আছে।
আর তুমুলভাবে বেঁচে আছে যোনি আর শিশ্নের রাজনীতি।
ভাল আর খারাপের মধ্যিকার বিভাজনটা সবসময়ই আপেক্ষিক। তবে আপনার পুরো লেখার অনেক জায়গায় দ্বিমত। কারণ যতো সহজে জেনারালাইজ করলেন সবকিছু, ব্যাপারটা তেমন না
পড়লাম।
পড়লাম , কিন্তু বুঝতে পারলাম না ।
ভালো-খারাপের সংজ্ঞায় বড় বেশী জটিলতা। স্থানকালপাত্রভেদে এর চেহারা বদলে যায়। শেষ কথাটা পছন্দ হলো, খচখচানিটা বেঁচে থাকে
হিজিবিজি লেগে গেল। লেখায় অনেক জায়গায়ই দ্বিমত লাগল।
তবে, মোদ্দা কথা, শালীনতার ব্যখ্যা একেক জায়গায় একেক রকম, আর তাই বিভিন্ন জায়গায় খারাপ-ভালো'র সংজ্ঞায়ন বিভিন্ন।
ভালো। পড়লাম। লেখায় অনেক জায়গায় শালীনতার ব্যখ্যা একেক রকম

ভালো খারাপের বিবরণ টা পুরোপুরি েবাধগম্য হল না
মন্তব্য করুন