কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভেতরে সবারি সমান রাঙা
মানুষ হিসেবে আমাদের সীমাবদ্ধতা অসীম। কেউ সেটা স্বীকার করতে ভয় পাই আবার কেউ সজ্ঞানে এড়িয়ে গেলেও অবেচেতনে নানারকম বর্ণবাদ নিজেদের ভেতর পুষে রাখি। দীর্ঘ প্রবাসজীবনে আমার সৌভাগ্য হয়েছে ভিন্ন পরিবেশ,ভিন্ন চিন্তাধারা এবং ভিন্ন ভৌগলিক পারিপার্শ্বিকতায় মানুষের নানা রূপ অবলোকনের। এ লেখার টুকরো কয়েকটি ঘটনা হয়তো নিজেদেরকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে আরেকবা্র ভেতরটা দেখে নেয়ার সু্যোগ করে দেবে। নামধাম কাল্পনিক হলেও ঘটনাগুলো আমার বা আমার খুব কাছের মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত, বলাই বাহুল্য।
১.পুলিশ দেখে করিসনে ভয়, আড়ালে তার ......
মেলবোর্নের মনাশ ইউনিভার্সিটিতে এম বি এ করছি তখন। বেশি রাত হ’লে কিছু পি এইচডির ছেলেমেয়েরা ল্যাবেই ঘুমাতো আর ভোরে উঠে দাঁত মেজে সটান ক্লাসে যেতো। আমি কিছুতেই ল্যাবে ঘুমাতে পারতাম না। যতো রাতই হোক, বাসায় নিজের বিছানা না হলে আমার ঘুম আসতো না। সেদিন কাজ শেষ করে দেখি রাত বাজে দু’টো। ল্যাবমেটরা সাইকেল অথবা বাস ধরে অনেক আগেই ফিরে গ্যাছে।কি আর করা! হক মওলা বলে বীরের বেশে একাই পদব্রজে রওনা দিলাম। রাস্তায় বের হতেই কনকনে ঠাণ্ডায় হাতপা জমে বরফ হওয়ার জোগাড়। মনে মনে নিজের নির্বুদ্ধিতাকে গালি দিচ্ছি আর বিশ মিনিটের পথ কোনক্রমে দশ মিনিটে পার হওয়ার জোর প্রচেষ্টায় রীতিমতো দৌড় প্রতিযোগিতার গতিতে হাঁটছি, এমন সময় প্যাঁ পোঁ শব্দে সুনসান রাতের অন্ধকার চিরে কোত্থেকে ইয়া বড় এক পুলিশের গাড়ি এবং তার ভেতর থেকে তার চেয়েও বড় হাতি এবং ডাইনোসর সাইজের দুই পুলিশ বের হয়ে এলো। বাঙালী মাত্রেই পুলিশ ভীতি বিশ্বখ্যাত, আমিও বাদ যাইনা, ঝেড়ে দৌড় লাগাবো কি’না ভাবছি এবং বাংলাদেশী পুলিশের পূর্বঅভিজ্ঞতাপ্রসূত দু:সহ স্মৃতি থেকে পুলিশগুলোকে মনে মনে ঝেড়ে গালিগালাজ করছি- নানাধরনের বাজে কথা শুনেছি এদের সম্পর্কে, কোন কারণ ছাড়া ধরে নিয়ে যায়, নন–হোয়াইটদের শুধুশুধু হ্যারাস করে...। তখন এদের প্রতি আমার ঘৃণা-ভীতির অন্ত নেই। হঠাৎ শুনি ডাইনোসর আমাকে বলছে, আমি কি পথ হারিয়েছি? কোনো অসুবিধে হলে এরা আমাকে বাসায় লিফট দিতে পারে। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম হাতিসমা পুলিশটি একজন মহিলা পুলিশ এবং সে মহা আনন্দে ম্যাকডোনাল্ডসের বিগম্যাক খাচ্ছে।ডাইনোসরও আমাকে বললো বাইরে খুব ঠাণ্ডা, গাড়িতে করে তোমার আপত্তি না থাকলে চলো তোমাকে পৌঁছে দেই, যাবার পথে এককাপ কফিও খাওয়া যাবে। মহা আনন্দে সেই প্রথম পুলিশের গাড়িতে চড়লাম এবং ম্যাকডোনাল্ডসের ফ্রাই, কোক, বারগার এবং কফি সব পুলিশের বদৌলতেই পেটপুরে খেয়ে নিজের বাসায় এসে আরামের ঘুম দিলাম!সেদিন থেকে এদেশের পুলিশকে আমি স্টিরিওটাইপিং করা বাদ দিয়েছি।
২. ফ্রিজ আছে?
তখন অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ফোন কোম্পানিতে চাকরি করি। জার্মানির এক খটখটে মহিলা মার্থা আমাদের সাথে কাজ করে। অপছন্দের তালিকায় অফিস লিস্টে সে মোটামুটি শীর্ষস্থান দখল করে রাখে। বাংলাদেশের কোরবানির ঈদ,পশুহত্যা,মাংস সংরক্ষণ এগুলো নিয়ে একদিন লাঞ্চরুমে আলাপ হচ্ছে, হঠাৎ সে খুব অবাক হয়ে এবং ভীষণ তাচ্ছিল্যভরে জিজ্ঞেস করলো “মাংস রাখবে, তোমাদের দেশে কি ফ্রিজ আছে নাকি???” আমি এতটাই থতমত খেয়ে গেছি তার কথার উত্তরে কি বলবো ভেবেই পাচ্ছিলাম না। আমি বললাম কি বলতে চাইছো মার্থা? সে বললো,” না তোমরা যেহেতু গরীব বন্যাপীড়িত দেশ এবং তোমাদের তো বেশিভাগ জায়গায় ইলেক্ট্রিসিটি নেই, তোমাদের নিশ্চয়ই ফ্রিজ নেই, এবং আমার ধারণা ছিলো তুমি অস্ট্রেলিয়াতে এসেই প্রথম ফ্রিজ জিনিসটার সাথে পরিচিত হয়েছো। তোমাদের অনেক লোক তো জঙ্গলেও থাকে, তাইনা?” মহিলাকে জোরে একটা চপেটাঘাতের দুর্দমনীয় ইচ্ছেকে চেপে রেখে আমি উত্তর দিয়েছিলাম আমাদের ওখানে বহুদিন থেকেই ফ্রিজ আছে ঠিক যেরকম জার্মানিতেও অনেক গাধা আছে, কিন্তু তাদেরকে জার্মানিতে রাখা হয়না মাঝেমাঝে এক্সপোর্ট করে অস্ট্রেলিয়াতে পাঠিয়ে দেয়া হয়! বলাবাহুল্য এরপর থেকে তার আর আমার এরকম “মধুর” আলাপ খুব বেশি জমেনি।
৩. নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস
“সরো,আমাকে নিঃশ্বাস নেবার জায়গাটাও তো তুমি দিচ্ছোনা” কটমটে দৃষ্টির শ্বেতাঙ্গিনী-সুবেশিনী বৃদ্ধাটি ধমকে উঠলেন আমাকে। এই দেশের ট্রাম ভ্রমণের আদবকায়দা আগেই রপ্ত করে নিয়েছি, বুড়োবুড়িরা আসলে উঠে দাঁড়াই, অন্তঃসত্ত্বা বা প্রতিবন্ধীদের না বলতেই জায়গা ছেড়ে দেই। তারপরও এরকম কিছু অসভ্য লোকজনের মুখোমুখি না চাইতেও হতে হয়। মহিলা গজগজ করছেন রাগে কারণ আস্ট্রেলিয়া কালো(পড়ুন অশ্বেতাঙ্গ) আর এশিয়ানে ভরে যাচ্ছে, এদের নিঃশ্বাস খুব দূষিত, এদের নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়া উচিত, এদের জন্য সত্যিকারের আস্ট্রেলিয়ানরা সব চাকরি হারাচ্ছে, এই সমস্ত অর্থহীন বিদ্বেষপূর্ণ কথা সহ্য করতে না পেরে পরের স্টপেই নেমে পড়লাম। স্টপের নাম বার্ক স্ট্রিট মল। বড় টিভিতে দেখাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড, শ্বেতাঙ্গ, অ্যালোংস্যাক্সন- ক্ষমা চাইছেন, অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী লস্ট জেনারেশনের কাছে তাদের নিজের দেশ কেড়ে নেবার জন্য, তাদের শিশুদের পুরো একটি প্রজন্মের শৈশব ছিনিয়ে নেয়ার জন্য!অবাক হয়ে ভাবলাম, এই শ্বেতাঙ্গিনী এখনও তার জাত্যাভিমান ভোলেননি কিন্তু ভুলে গেছেন দেশটা আসলে আবোরিজিনালদেরই জন্মভূমি, নিজের দেশে বোধকরি সবার আগে তারই ফিরে যাওয়া উচিত।
৪. রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি
“আরেহ, বুঝলেন না এই চাইনিজগুলি মহা বদমাইশ। এরা নিজেদের হাঁড়িতে পর্ক রাঁধবে, বলেন আমি কি সেই হাঁড়িতে পরে মাংস রাঁধতে পারি? যতই ধুই, নাপাক জিনিস কি এতো সহজে দূর হবে?” আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,শান্টু, নিজের হাঁড়িকুড়ি কিনে নিচ্ছেন না কেন?“কী বলেন? মাত্র দুই বছরের জন্য ডিগ্রি করতে এসে আবার এতো খরচ করবো!তাছাড়া আমি তো তিনটা চাইনিজ মেয়ের সঙ্গে শেয়ারে থাকি। পয়সা নষ্ট করে কী লাভ? ওদের চাদর, হাঁড়িবাসন, বিছানা বালিশ, আগের স্টুডেন্টদের ফেলে দেয়া জিনিসই তো ব্যবহার করবো। জানেন না অস্ট্রেলিয়ান এক ডলার এখন বাংলাদেশে প্রায় ষাট টাকা?”এই শান্টু কখনো ল্যাবের প্রিন্টারে কয়েন ভরতো না। তক্কে তক্কে থাকতো কখন অন্য কেউ এসে ভরবে ঠিক তখনই সে প্রিন্ট কম্যান্ড দিতো এবং গিয়ে সেই ছেলে বা মেয়েকে বলতো ভীষণ আর্জেন্ট, তার পোর্ট কাজ করছে না অন্যদের পোর্ট থেকেই করতে হবে। একদিন দেখি সে আরো দুই তিন জন বাঙালি ছাত্রকে বসে বসে নসিহত করছে ইউনিভার্সিটির টয়লেটে যেহেতু অনেক বড় টয়লেট রোল দেয়া থাকে,সেহেতু বাসায় একটা দু’টো নিয়ে যাওয়া কোনো অপরাধ না! উপরন্তু যেহেতু ইউনিকে আমরা অনেক টাকা দিচ্ছি, সেহেতু টয়লেট পেপার তো সেই টাকা থেকেই কেনা হচ্ছে। সুতরাং বাসায় নিয়ে ইউজ করলে ক্ষতি কী। এই টয়লেট পেপার চুরি সে কতদিন অব্যাহত রেখেছিলো জানিনা, কিন্তু পরের সেমিস্টারে দেখি সে এক চাইনিজ মেয়েকে গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে সেই মেয়ের গাড়ি বগলদাবা করে ব্রিসবেন মুভ করে গেলো। আরো বড় বিস্ময় বছর দুয়েক পরে, আমরা সবাই তখন পাশ টাশ করে বেরিয়ে গেছি, ফোনে একদিন খুব গর্বভরে জানালো সে বাংলাদেশ যাচ্ছে, মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে, মেয়ে হিজাব করে, এটাই তার একমাত্র শর্ত ছিলো, আর গত ক’বছরের জমানো টাকা দিয়ে সে মেয়ের জন্য ডায়মন্ডের আংটি কিনে নিয়ে যাচ্ছে।“জানেন আস্ট্রেলিয়ান ডলারে ডায়মন্ডের দাম এখন বাংলাদেশী টাকায় কতো??”
৫. উই আর ওয়ান,বাট উই আর মেনি
একটা ব্যাংকে কাজ নিয়েছি। একদিন ভীষণ বৃষ্টি, আমার ধূম জ্বর। তারপরেও ছুটি পাইনি। অফিস যাবার রাস্তায় আধা পথে নেমে পড়লাম একটা স্টপে।খুব শরীর খারাপ লাগতে লাগলো, বমি করে দিলাম। বৃষ্টিতে চারপাশ আঁধার, ট্রাম স্টপে একটা লোকও নেই। একটু পানির তৃষ্ণায় বুকটা ছটফট করছে। হঠাত এক অফিসযাত্রিনী, আমাকে দেখে দৌড়ে এলো। পানির বোতল থেকে পানি দিলো, অনেকক্ষণ আমার মাথাটা কোলে করে বসে রইলো।নিজের কাজ ফেলে আমাকে নিয়ে হাসপাতাল গেলো, ডাক্তার দেখিয়ে, ওষুধ নিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিলো। পরে সেই বিদেশিনীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। আডেলেইডে বড় হওয়া শ্বেতাঙ্গিনী সেই মেয়েটির বয়ফ্রেন্ড ছিলো দক্ষিণ ভারতীয় একটি ছেলে। অচেনা সেই স্নেহস্পর্শ সারাজীবন মনে থাকবে।
৬. দ্য জাপানিজ ওয়াইফ
ভারতীয় মেয়ে দীপার চোখের এশিয়ান মানেই নাকবোঁচা মানেই মিথ্যুক মানেই বাটপার। ঠকিয়ে পয়সা নেয়া ছাড়া চাইনিজ, জাপানিজ ভিয়েতনামিজদের কোনো কাজ নেই। এই হেয়ার সেলুনে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এনেছি।বারবারই সে ব্যাগ সামলাও, চুরি করবে, চুল কাটার সময় পার্স খেয়াল করো ইত্যাদি বলে ব্যতিব্যস্ত করে তুললো। কাজ শেষে টাকা দেয়ার সময় ভাঙা ইংরেজিতে জাপানিজ মহিলা বললেন, মনে করতে পারো গতমাসে এটা ফেলে গিয়েছিলে? অবাক হয়ে দেখি আমার ভিসার গোল্ড কার্ড! কবে যে এটা ফেলে গেছি, গতবার হলিডেতে প্লেন ধরার তাড়াহুড়োয় এখান থেকেই ছুট দিয়েছিলাম এয়ারপোর্টে, মনেও ছিলোনা। কার্ডটা ক্যানসেলও করাইনি। আতঙ্কে হাত পা...... না জানি কী ক্ষতি হয়ে গেলো! ওদিক থেকে দীপা সমানে কান বিষিয়েই চলছে। মহিলা শান্ত স্বরে হাসিমাখা মুখে জানালেন, গত একমাস সযত্নে তিনি কার্ডটি আমার জন্য রেখে দিয়েছিলেন নিজের সেইফবক্সে। কাউকে হাত পর্যন্ত লাগাতে দেননি। আমার নাম্বার জানা না থাকায় ফোনও করতে পারেননি।
দীপার আরক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে শেষ হাসিটা আমিই হেসেছিলাম।
এবং উপসংহারে
৭. ফ্রম অল দ্য ল্যান্ডস অন আর্থ উই কাম
নিউইয়র্কের সাবওয়েতে আফ্রিকান আমেরিকান তথা কাউলাদের থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে সতর্ক করেছে বহুবার,বহুজন।ড্রাগ বেচবে, ছিনতাই করবে, গ্যাং রেপ হতে পারো এরকম বহু গা-শিউরানো কথাবার্তা। ট্রেন থেকে নেমেই বুঝলাম হরেক আভেনিউ আর স্ট্রিটের চক্করে পড়ে পথ হারিয়েছি। বৃষ্টিস্নাত রাত, পথে হদিশ জানাবে টুরিস্টকে আর কে? এক কাউলাকে দেখলাম ঢুলতে ঢুলতে যাচ্ছে। যা থাকে কপালে বলে ঝুলে পড়লাম হত্যে দিয়ে তার সামনে। কিমাশ্চর্যম! শুধু ডান বাম নয়, রীতিমতো ম্যাপ এঁকে,ছক কষে এবং নিজের দুই ব্লক উলটো হেঁটে এসে আমার হোটেল চিনিয়ে দিয়ে গেলো আমাকে সেই বুড়ো। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ঢুলছো কেনো? বললো, পার্কিন্সন রোগ হয়েছে, কড়া ওষুধ খাই, তাই রাতের বেলা ঢুলুনি আসে। মাতাল ভাবাতে নিজেই লজ্জা পেলাম নিজের কাছে। বারেবারে ধন্যবাদ দিয়েছি সেই কৃষ্ণাঙ্গ বৃদ্ধকে আর অন্যসব “কাউলা”দের যারা বারবার সাহায্য করেছে আমাকে আমেরিকায় নানা কাজে।
দ্যা সিকারস এর আই আম অস্ট্রেলিয়ান গানটার কতকগুলো লাইন আমার খুব প্রিয়। সারা পৃথিবীর মানুষের এক হবার কথা, এক রকম হবার কথা ওখানে বলা আছে সুন্দর করে-
We are one but we are many
And from all the lands on earth we come,
we share a dream,
And sing with one voice,
I am, you are, we are Australian.
দিনশেষে আমরা সবাই এক। এতো বিচ্ছিন্নতা সত্বেও। কোন না কোনোভাবে।
অনেকদিন পর এমন চমৎকার একটা লেখা পড়লাম।
্কেমন আছেন আপনি? অনেক দিন কিছু লেখা হয়না। আপনার লেখা বেশ লাগে।
মন্তব্য করুন