ইউজার লগইন

বহ্নি জ্বালা(পর্ব-২)

আমার ছেলেমেয়ের জন্য আমার অনেক দুঃখ হয় বিশেষ করে ছেলের জন্য। আমি যে নির্মল আনন্দ গুলো করেছি আমার ছেলে তা ভাবতেও পারে না। আমার ছেলে এখন অষ্টম শ্রেনীতে পড়ে, ঠিক একই বয়সে ফাগুন চৈত্র মাসে নিজ হাতে বানানো ঘূড়ি উড়িয়ে কি যে মজা পেতাম কিভাবে ব্যাখ্যা করব। উড়ানোর মজা এক, বানানোর মজা আরেক। আজ যখন মনে হয় ভাবি এত কষ্ট করতে হত, একটা ঘুড়ি বানানোর জন্য?
সে সময় মেলায় ঘুড়ি পাওয়া যেত। তা কিনেও আনতাম, তবে সে সব ঘুড়ি ছিল ছোট ও পাতলা কাগজের, কদিনেই ছিড়ে যেত। তাই ঘুড়ি বানানোর জন্য বাঁশের ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে শুকাতে দিতাম। বাতা করার উপযোগী হলে তা থেকে উপর নিচের ধনুকের মত দুটি শলাকা এবং মাঝের জন্য আর একটি শলাকা বের করে নিতাম। ঘুড়ির লেজ বানানোর জন্য আরও একটি শলাকা লাগত। সুতার সাহায্যে বেঁধে ঘুড়ির কাঠামো তৈরীর পর কাগজ দিয়ে তার ছাউনি তৈরী করা হত।
কাগজ ঘুড়ির অবকাঠামোতে লাগানোর জন্য সিদ্ধ আলু,কখনও ভাত, সবচেয়ে ভাল হত ঝিগা গাছের আঠা পাওয়া গেলে। সে আঠা পাওয়ার জন্য অনেক সময় দা দিয়ে ঝিগা গাছের গায়ে কোপ দিয়ে রাখতাম। তা আঠা যাই হউক না কেন কাগজের ছাউনি শেষ হলে সুতা বেঁধে এবার আকাশে উড়ানোর পালা। ঘুড়ি আকাশে উড়ছে আমার মন প্রানও যেন আনন্দের অতিশয্যে আকাশে উড়ছে। বেশী আনন্দ পেয়েছিলাম যে দিন ঘুড়ির মাথায় সাইকেলের টিউব বাঁশের শলাকার সাহায্যে অর্ধ বৃত্তাকৃতির করে বেঁধে দেওয়াতে ঘুড়ি যত উপর উঠছিল তত টিউবের এক রকম ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনতে পেয়ে। এই বিষয়টি আমি আমার এক চাচার কাছ থেকে শিখেছিলাম। উনারা ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতা করতেন। উনারা নাকি ঘুড়িতে হারকিন বেঁধে দিতেন, যার ঘুড়ি সাড়া রাত হারকিন সহ বা বেশী সময় উড়ত তিনি বিজয়ী হতেন। তবে আমি তা কখন ও দেখিনি। অনেক সময় ঘুড়ি ছিড়ে কোথাও চলে যেত, ছিড়ে যাওয়া ঘুড়ি উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায় ভেসে ভেসে,আর আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘুড়ির পিছে পিছে দৌড়, কিন্তু আমার বানানো ঘুড়িও যে আমাকে তখন চেনে না। আমার চেয়ে অনেক দ্রুত সে উড়ে চলেছে, আর আমি তাকে ধরার জন্য প্রাণ তুচ্ছ করে তাঁর পিছে ছুটছি।
এমননি একদিন বিশাল এক ঘুড়ি যা উড়াতে পাটের সুতলী ব্যবহার করতে হয়েছিল। দিনরাত চব্বিস ঘণ্টা কখনও নামানো হয়নি, একাধারে তিনদিন তিনরাত। আমি স্কুলে চলে গেলে বছর মারী কামলা অয়াহাব ভাই ঘুড়ির খেয়াল করত। একদিন বিকেল বেলা ঘুড়ি ছিড়ে গেল, অয়াহাব ভাই বাজারে গেছেন। আমি ঘুরির পিছে পিছে দৌরাচ্ছি। কোন দিকে খেয়াল নেই। দৌড়াতে দৌড়াতে কয়েক মাইল দৌড়ালাম, এক সময় আমার প্রাণপ্রিয় ঘুড়িটি আকাশে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমিও হতাশ হয়ে দৌড় থামালাম। একসময় হতাশা কান্নায় রূপ নিল। কতক্ষন কেঁদেছিলাম জানিনা। বাড়ীর দিকে রওয়ানা দিলাম।
আমাদের বাড়ী থেকে আধ কিলোমিটার দুরে ছিল বিন্দামন শাহর বাড়ী। এই বাড়ীতে ছিল বিশাল বিশাল কুকুর। কতক ছিকলে বাঁধা থাকত, কতক ছাড়া থাকত। তবে রাতের বেলায় সবগুলো ছাড়া থাকত। কেউ বাড়ীর পাশের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় বিশাল বিশাল কুকুর যখন ঘেউ ঘেউ করে উঠত তখন অন্য কারও জানিনা, আমার ছোট্ট কলিজা খানা ভয়ে খান খান হয়ে যেত। তাই বাবা বা বড় ভাইদের সাথে ছাড়া ওই বাড়ীতে বা বাড়ীর পাশ দিয়ে কখনও যেতাম না। কিন্তু সেদিন কখন কিভাবে ওই বাড়ী পার হয়ে আমার সাধের ঘুড়ির পিছু ধাওয়া করেছিলাম বুঝিনি। এবার আসার সময় বিশাল বিশাল কুকুর গুলোর কথা মনে হতেই কলিজাটা শুকিয়ে গেল, শরীর হীম হয়ে গেল। কি করে কুকুর রূপী বাঘের হাত থেকে বাচা যায়। হামলা না করলেও যদি ঘেউ ঘেউ শব্দে আমার দিকে দৌড়ে আসে তবেই কম্ম সাবার। আইলের রাস্তায় বসে এবার শুধু কুকুরে ভাবনা। পিছনে খলিফার জংগল নামে বিশাল এক জংগল সামনে বিন্দামন শাহ্‌র কুকুর নামের বাঘ, দুইদিকেই বিপদ।এ দিকটায় তেমন কেউ আসে না। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এল এ যেন মরার উপর খারার ঘা। ওসমান ভাই দেওয়ান মানুষ, সালিশ সেরে কোথা থেকে আসছিলেন আমাকে দেখে যেন চমকে উঠলেন,
কিরে এখানে কি করছিস? আমি কাদো কাঁদো স্বরে বললাম,ঘুড়ি ছিড়ে উড়ে গেছে, তাঁর পিছন পিছন আসতে আসতে এতদুর চলে এসেছি। এখন কুত্তার ভয়ে যাইতে পারছি না।
দুর বোকা। আয় আমার সাথে।
বাড়ী এসে ভীষন মন খারাপ করে বাহিরের ঘরে শুয়ে আছি। কিছুক্ষন পর ওয়াহাব ভাই বাজার থেকে এসে ঘুড়ি উড়তে না দেখে আমাকে খুঁজে বের করে জিজ্ঞেস করল, ঘুড়ি কই।
আমি তাকে জড়ায় ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলাম। ঘুড়ি ছিড়ে উড়ে গেছে। তাঁরও অনেক কষ্ট হচ্ছিল বুঝলাম, কিন্তু আমাকে সান্তনা দেবার জন্য বলল, আমি তোমাকে ঘুড়ি বানানোর টাকা দিব, তুমি কাইন্দো না। অয়াহাব ভাই আমাদের বাড়ীতে দেড় যুগের বেশী ছিল। ছোট থেকে কুলে পিঠি চড়েছি। কোনদিন কাজের লোক মনে হয়নি।
মাঝে মাঝে ঘুড়ি হারানোর ব্যাথা থাকলেও আনন্দটা ছিল অনেক বেশী। আহ্‌ যদি একবার ফিরে যেতে পারতাম সেদিনে।

রিসোর্টের বিশাল এলাকা জুড়ে আছে সবুজের সমারোহের জন্য বিভিন্ন গাছ গাছালি, আছে ফুল, পাতাবাহার খেলার মাঠ চিলড্রেন ডেভলপমেন্ট সেন্টার, ( সি, ডি সি) তেমনি আছে কয়েক্টি হাট্‌ বা কুড়ে ঘর।
বাংলাদেশে যাদের বাড়ি গ্রামে তাদের অধিকাংশের ছিল বা এখনও আছে কুড়ে ঘর। যারা একটু বৃত্তশালী তাদের ছিল মাটির দেয়াল উপরে টিন,কিছু কিছু এলাকায় আবার টিনের বেড়া টিনের চাল। তবুও সব ঘর গুলো টিনের হতো না। যেমন গোয়াল ঘর গুলো বেশীর ভাগই চাটির বেড়া,খড়ের চালের হতো। খড়ের ঘর গুলোর নির্মাণ কাজ, এই সময় ফাগুন চৈত্র বৈশাখ মাসেই বেশী হতো। এর কারন হিসেবে আমার মনে হয় এই সময়টাতে বৃষ্টি যেমন হতো না, তেমনই প্লিন্থ বা মাটির দেয়াল তৈরীর জন্য মাটি সংগ্রহের সুবিধা ছিল। এ ঘরগুলো তৈরীতে উপকরণ যা লাগত, নিজের বাঁশের ঝাড় থাকলে বাশ কেটে নাও বাতা তৈরীর জন্য, বাঁশের খুটি এবং ফ্লোর বানানোর জন্য মাটি। আর কিছু শ্রমিক। যাদের বাড়ীতে দুইতিন ভাই তারা নিজেরাই একাজগুলো করে ফেলে। তাই খরচ তেমন একটা হয় না।
আমাদের ৮৫ সিরিজের একটা গেট টুগেদার ছিল আমাদের বন্ধুর ধানমণ্ডির বাসার ছাদে। বন্ধুটি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বিশাল ছাদে সে খেলার (টেনিস, ক্যারাম) ব্যবস্থা করার পাশাপাশি সবুজের সন্নিবেশ ঘটাতে পরিসীমা বরাবর আলাদা দেয়াল করে মাটি দিয়ে তাতে সবজি সহ বিভিন্ন নাতিদীর্ঘ শিকর ওয়ালা গাছ লাগিয়েছে। বসার জন্য আমার বন্ধুটি চতুর্দিকে অনেক কটি কুড়ে ঘর বানিয়েছে। ওর কাছে কুড়ে ঘড়ের খরচের কথা শুনে আমার হয়ত টাস্কি লেগে যেত কিন্তু বাহরাইনে ১৫/২০টাকার লাউ ১৫০/২০০ টাকায় কিনার স্মৃতি আমাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করল।
কুড়ে ঘরের কথা মনে আসতেই ছোট বেলার এক কষ্টকর তিক্ত অভিজ্জতার কথা মনে পড়ে গেল।
দিনের বেলায় গরু রাখার জন্য বাহির আংগিনায় একটি কুড়ে ঘর তৈরী করে চাল দেয়া হয়েছে, ভিট করার জন্য কিছু মাটি কেটে রাখা হয়েছে এখনও সমাপ্ত হয়নি। আর কিছু দিন পর ২৬শে মার্চ, স্কুলে খেলা হবে। হাইজাম্প, লংজাম্প দৌড় এ অংশ গ্রহণ করব। তাই স্কুলের পাশাপাশি বিকাল বেলায় আলু ক্ষেত বা চাষ করা ক্ষেতে চলছে প্রাকটিস। একদিন শুক্রবার দুপুর বেলা ঘরের ভিটে ফেলা মাটির উপর আরম্ভ করলাম লংজাম্প প্রাকটিস, সঙ্গী চাচাত ভাই, হীরা মিয়া। শয়তান বাবাজী মনে হয় সর্বদা সে সময় পিছে লেগেই থাকত। দুই ভাইয়ের মাঝে চুক্তি হল যে আড়াআড়ি ভাবে এপাশ থেকে অন্যপাশে যেতে পারবে ১০টি মার্বেল তাকে দেয়া হবে। আরম্ভ হল লাফালাফি। না পার হওয়া যায় না। তাই শান্তি চুক্তিতে দুরত্ব কিছটা কমিয়ে নেয়া হল। এবার যেই না লাফ মেরেছি দুপা বাঁশের খুটির দুপাশে,বিশাল একটা চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। কিছু আর জানিনা। যখন জ্ঞান ফিরল সদর হাসপাতালে শিয়রের পাশে মা, বড় মা কাঁদছেন। হাটু থেকে পা ভেঙ্গে গেছে। রংপুর নিয়ে যেতে হবে। জ্ঞান ফিরেছে শুনে বাবা দৌড়ে এসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। চাচা, ফুপা, ফুপু,চাচাত ভাই ভাতিজারা আর ও কতজন এসেছিল মনে নেই। তবে একজনের কথা খুব মনে আছে।
তিনি আব্দুল মোতালেব ওরফে জ্বিন। তাঁর শরীরটাও ছিল জ্বিনদের মতই বিশাল, কালো কুটকুটা গাঁয়ের রং। দেখলেই ভয় লাগে। সে আমাদের বংশের কেউ না। তবে যাকে বিয়ে করেছে সে কোন না কোন সুত্রে আমাদের বোন হয়, তাই সে আমাদের ভগ্নিপতি।
মুক্তি যুদ্ধের আগে তাঁর পেশা ছিল ডাকাতি করা এবং তাঁর বিশাল একটা ডাকাত দল ছিল। দিনাজপুর, রংপুর, পঞ্চগড় এই সব জেলায় ছিল তাঁর বিশাল এক বাহিনী। (চলবে)
এপ্রিল,১২,২০১৪খ্রীঃ
চৈত্র২৯,১৪২০ বাংলা
সিরাজগঞ্জ।

পোস্টটি ১৬ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

আহসান হাবীব's picture

নিজের সম্পর্কে

তোমার সৃষ্টি তোমারে পুজিতে সেজদায় পড়িছে লুটি
রক্তের বন্যায় প্রাণ বায়ু উবে যায় দেহ হয় কুটিকুটি।।
দেহ কোথা দেহ কোথা এ যে রক্ত মাংসের পুটলি
বাঘ ভাল্লুক নয়রে হতভাগা, ভাইয়ের পাপ মেটাতে
ভাই মেরেছে ভাইকে ছড়রা গুলি।।
মানব সৃষ্টি করেছ তুমি তব ইবাদতের আশে
তব দুনিয়ায় জায়গা নাহি তার সাগরে সাগরে ভাসে।
অনিদ্রা অনাহার দিন যায় মাস যায় সাগরে চলে ফেরাফেরি
যেমন বেড়াল ঈদুর ধরিছে মারব তো জানি, খানিক খেলা করি।।
যেথায় যার জোড় বেশী সেথায় সে ধর্ম বড়
হয় মান, নয়ত দেখেছ দা ছুড়ি তলোয়ার জাহান্নামের পথ ধর।
কেউ গনিমতের মাল, কেউ রাজ্যহীনা এই কি অপরাধ
স্বামী সন্তান সমুখে ইজ্জত নেয় লুটে, লুটেরা অট্টহাসিতে উন্মাদ।
তব সৃষ্টির সেরা জীবে এই যে হানাহানি চলিবে কতকাল।
কে ধরিবে হাল হানিবে সে বান হয়ে মহাকাল।।