মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-১
১৯৭১ সাল দেশে যুদ্ধ চলছে। তখন আমার বয়স ৬-৭ বছর। তাতে কী, এ সময়ের ঘটনা আজো স্মৃতিতে গেথে আছে। আমরা তখন সপরিবারে (মা-বাবা, মেজভাই-ভাবি, আমি ও আমার অগ্রজ ভাই) পুরান ঢাকার লালবাগের কাজী রিয়াজ উদ্দিন রোডে নিজবাড়িতে ছিলাম। তখন এখানে এতোটা ঘনবসতি ছিল না। আমাদের বাড়িটি লালবাগ কেল্লার ঠিক দক্ষিণে, মন্দিরের কাছে। এ মন্দিরে কখনো শাঁখের ধ্বনি শোনা যায়নি, এমনকি পূজা-অর্চনাও হতে দেখিনি কখনো। সম্ভবত এটি আগেই বেদখল বা বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। এ মন্দিরটি এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রভাবশালীরা এটিকে হিন্দু বাবুদের কাছ থেকে কিনে ইট-বালির গাঁথুনিতে ঢেকে দিয়েছে। লোকচু থেকে আড়াল করে রেখেছে, তবে ভাঙা হয়নি। এ এলাকায় এখনো একাধিক মন্দির বা মঠ রয়েছে, যা পরিত্যক্ত অবস্থায় লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছে। বলতে গেলে বুড়িগঙ্গার কাছে হলেও আশপাশে ছিল কয়েকটি পুকুর বা ডোবা। তবে তেমন ঘনবসতি না থাকায় প্রধান সড়কের লোকজন, গাড়ি-ঘোড়া এবং লালবাগ কেল্লায় আসা দেশী-বিদেশী পর্যটকরা সহজেই নজর কাড়তো। বাড়ির পাশে ছিল এটলাস নামে একটি অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি। এখানে হেলিকপ্টার ব্র্যান্ডের অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িপাতিল বা তৈজসপত্র তৈরি হতো। কারখানাটি ছিল পাকিস্তানি এক খানের।
দেশে যুদ্ধ চলছে, মুক্তিযুদ্ধ। গ্রামের লোকেরা এখনো এ মুক্তিযুদ্ধের সময়টিকে গণ্ডগোলের বছর হিসেবে উল্লেখ করেন। তাদের এ সহজ-সরল উক্তির অর্থ হলো দাঙ্গা-হাঙ্গামার বছর। গণ্ডগোলের বছর বলারও একটি যুক্তি বা ব্যাখ্যা আছে। এর মূল কারণ, ৯ মাসে একটি দেশ স্বাধীনতা লাভ করতে পারে- এমন নজির বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই। এছাড়া যে বছর যুদ্ধ শুরু, সে বছরই দেশ স্বাধীন হয়। তাই হয়তো গ্রামের লোকেরা সহজ ভাষায় এ সময়কে ‘গণ্ডগোলের বছর’ হিসেবে আখ্যা দেন। মা বলতেন যুদ্ধের বছর আমরা পায়ে হেঁটে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি (মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ) গিয়েছিলাম। তারপরও গ্রামের পথে হেঁটে যাওয়ার কিছুটা স্মৃতি এখনো আমার হৃদয়পটে গেথে আছে। দিন-তারিখ মনে নেই। যুদ্ধের বছর দিনভর আকাশে যুদ্ধবিমানের দাপাদাপি দেখে কখনো উৎফুল্ল হয়ে হাততালি দিতাম, আবার কখনো বিমানকে লক্ষ্য করে কামানের গোলা বা মিসাইল ছোড়ার শব্দে কানে আঙুল দিতাম। গোলাগুলির শব্দ আমরা একটু বেশিই পেতাম। এর কারণ, পিলখানা ছিল (বর্তমান বিজিবি হেডকোয়ার্টার) আমাদের খুব কাছে। বিমানের আনাগোনা আর গোলার ধোঁয়ায় দিনের আকাশকে মনে হতো নক্ষত্রের হাট। দিন পেরিয়ে রাত আসে। রাত যতো গভীর হচ্ছিল, গোলাগুলির শব্দ যেন ততোই বাড়ছিল। আমাদের বাড়ির ছাউনিটি ছিল টিনের। রাতভর প্রচণ্ড গোলাগুলিতে বন্দুক আর রাইফেলের গুলির খোসা এসে আমাদের টিনের চালে পড়ছিল মুষলধারায় বৃষ্টির মতো। রাত গভীর, ভোর ছুঁই ছুঁই করছে, অবিরাম গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে বুক কেঁপে উঠছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে বাবা আমাদের রাতেই একটু দূরত্বে নদী পার হয়ে (বর্তমান লালবাগের ইসলামবাগ) এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে রাখলেন। অপেক্ষা ফজরের আজানের। তখন নাকি কিছু সময়ের জন্য গোলাগুলি বন্ধ থাকে। রাত ভোর হলো, মসজিদের মাইকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল ফজরের আজান- ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর’ -‘আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান’। সেদিন রাতে আর ঘুম হয়নি। আজানের সাথে সাথে বাবা আমাদের নিয়ে গেলেন ঢাকার কালীগঞ্জে (সদরঘাটের বিপরীত পাড়ে) তার এক দূরসম্পর্কের ভাইয়ের বাসায়। যেদিন সেখানে গেলাম, সেদিন রাতেই সূত্রাপুরের গেণ্ডারিয়ায় আগুন দিয়েছিল পাক-হানাদার বাহিনী। মনে হলো দৃশ্যটি খুব কাছ থেকে দেখলাম।
পরের দিন কালীগঞ্জ ছেড়ে পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম নিজগ্রাম বিক্রমপুরের উদ্দেশে। সেদিন সকাল থেকে শুধুই হেঁটেছি শেষ গন্তব্য পর্যন্ত। মনে আছে চলতিপথে উৎসুক জনতা পথচারীদের কাছ থেকে ঢাকার অবস্থা জেনে নিচ্ছেন।
চলবে...
চলুক....
কুমারভোগ কি আপনার গ্রামের বাড়ি?
কুমারভোগ চেনেন নাকি?
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনার অংশ।
ধন্যবাদ।
চলুক.......
চলছে, চলবে..
আপনের বাড়ি লালবাগে? আমিও ঐ এলাকায় বড় হইছি...তয় আমার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পরের বছরে। আমার মামাগো চিনবার পারেন।
রোড এবং মামাদের নাম বললে হয়তো চিনবার পারতাম।
জগন্নাথ সাহা রোড। আমার ছোটমামার নাম অঞ্জু।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনার অংশ
চলুক.......
চলবে...
এই সিরিজটা চলতে থাকুক। আহমদ আলী ভাইকে
রিপিয়ার হচ্ছে..চলবে শিগগিরই. ধন্যবাদ আপনাকেও।
চলুক।
চলবে আজ-কাল..
চলুক
চলবেই তো..
আপনার বয়স এত কম ছিল অথচ স্মৃতিলোপ পাওয়ার ব্যাপারটি ঘটেনি! আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এভাবেই সমস্ত স্মৃতির শ্রেষ্ঠ স্মৃতি আপনাদের কাছে যারা এখনো বিস্মৃত করেনি ১৯৭১কে। নিয়মিত দেখতে চাই লেখাটা।
তবে স্মৃতিলোপ বলতে যা ঘটেছে, তাহলো দিন-তারিখ মোটেও মনে নেই। বাবা-মা বেঁচে থাকলে হয়তো তা দিতে পারতাম। আপনাদের প্রেরণা আমাকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে বলে আশা করি। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন