ইউজার লগইন

নারীদের গল্পঃ ০১- দাগ

মাত্র চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হইছি। শহর থেকে দল বেঁধে ট্রেনে করে আসা-যাওয়া করি। আমি উঠতাম ঝাউতলা থেকে। দলটা সাইজে দশ-বারো জনের হয়ে গেলো ছেলে আর মেয়ে মিলিয়ে। দলে যারা মুল ষ্টেশন অর্থাৎ বটতলী থেকে উঠতো তারা কাগজ কিংবা ইটের টুকরা কিংবা নিজের ব্যাগ দিয়ে সীট রাখার চেষ্টা করতো। আমি উঠতাম ঝাউতলা থেকে। আমাদের গ্রুপের একমাত্র আমি আর বাকিরা বটতলী আর কেউ কেউ উঠতো ষোলশহর থেকে। মুল ছাত্র-ছাত্রীদের ষ্টপেজ ছিলো বটতলী আর ষোলশহর।আর অন্যান্য ষ্টেশনগুলোতে টুপ টাপ দুই একজন উঠতো কিংবা নামতো। আমি আর তুহীন সব সময় দরজায় বসে যেতাম। সে এক অসাধারন মজা। ফতেয়াবাদ থেকে ট্রেনটা যখন বাঁক ঘুরে ইউনিভার্সিটির ষ্টেশনের দিকে যেতো অদ্ভুত সুন্দর লাগতো।আরেকটা বিরক্তিকর কাজ হলো ট্রেনের জন্য অপেক্ষা! ঝাউতলাতে দাঁড়িয়ে আছি তো আছি! ট্রেনের খবর নেই। ফেরার পথে হেলে দুলে সেই ট্রেন আবার ফিরতো-ঠিক ষোলশহরে আসলেই ট্রেন প্রায় ফাঁকা। আমি ঝাউতলা নেমে পাহাড়ী আঁকা-বাকা পথে চলে যেতাম আমার গন্তব্যে।

যাইহোক একদিন এমনি দাঁড়িয়ে আছি। হাল্কা-পাতলা বৃষ্টি হচ্ছে! চট্টগ্রামের বৃষ্টি মোটামুটি ফেমাস। একবার শুরু হলে চার-পাঁচদিন। আর তখনকার ঝাউতলা ষ্টেশন হলো একদম ফাঁকা। ছোট্ট ষ্টেশন মাষ্টারের অফিসের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছি। রিনি ঝিনি কন্ঠে একজন ডাকলোঃ
-এই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছো কেন? ছাতার নীচে আসো।
আরে এযে মেঘ না চাইতেই বজ্রপাত!রিনি ঝিনির দিকে তাকালাম।প্রায় দিন দেখা হতো।একি ষ্টেশনের সহযাত্রী। ভাবতাম সিনিয়র আপা। ছাতার নিচে দাঁড়ালাম। না আমাদের সাথেই পড়ে।
-আমি সোসিওলজি ফার্ষ্ট ইয়ার; তুমি তো আমাদের সাথেই পড়ো!
-আমি কিন্তু ফার্ষ্ট ইয়ার নিউ।
-আরে আমিও ফার্ষ্ট ইয়ার নিউ!
রিনি ঝিনি আবার হাসছে। ভিড়ে গেলো আমাদের দলে। আমাদের দলের সাথে আসা-যাওয়া শুরু হলো। তার নাম রিনি ঝিনি থাকুক। খুব সহজ-সরল ছিলো রিনি ঝিনি। আমরা হয়তো আড্ডা দিচ্ছি; কোনো কথা বলছি-সে মাঝখানে এসে এমন এক কথা বলতো-সবাই অবাক হয়ে যেতো। যেমন একদিন আমাকে সবার সামনে বল্লোঃ তুমি নামাজ পড়োনা কেন? তখন আমাকে যারা চিনে কিংবা আমার বন্ধু ছিলো-তারা খুব অবাক হয়ে তাকালো!
-নামাজ পড়লে কি হবে?
-বেহেস্তে যাবা।
-বেহেস্তে যাইবার চাইনা। আমি মেজাজ খারাপ কইরা কইলাম।
-তাইলে পাঁচ বেলা হাত মুখ ধোয়া হইবো-মন মেজাজ ভালো থাকবে।
শিমুল ক্ষেইপ্পা বোম।
-এই মাইয়া তোরে কয়দিন পরে তাব্লিগে না হয় মামু পার্টিতে নাম লেখাইবো।
আমি প্রশ্রয়ের হাসি হাসি। কেমন যেনো মায়া পড়ে গেছে। রাগও করিনা। যা বলে শুনি-কথা বলি আবার যথারীতি ঝাউতলা নেমে পাহাড়ী পথ ধরে তার বাসা বুড়ি ছূঁয়ে আমার গন্তব্যে। সবাই একটা সুন্দর প্রেম কাহিনী শোনার জন্য নড়ে চড়ে বসেছেন? না ইহা মোটেও প্রেম ছিলোনা-ছিলো এক ধরনের বিরক্তি! তখন চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে মিছিল করা হইলো মহা কাহিনী। ছাগুদের উতপাত এতো বেশী-মিছিল হইলেও ধাওয়া- পালটা ধাওয়া। ঢিল ছোড়া-ছুঁড়ি। হাজার হ্যাপা। আমি ঝাউতলা ছেড়ে দিলাম। আজ এখানে-কাল ওখানে।দারুল ফজল মার্কেট কিংবা দোস্ত বিল্ডিং-ক্যাম্পাস-লালদীঘি-মেডিকেল ক্যাম্পাস-কোট-কাছারী। সুতাহীন ঘুড্ডি!আমাদের সেই কঠিন রাজনৈতিক আড্ডায় আইসা উঠতো রিনি ঝিনি। আমার পাশে বসতো। একদিন কি জানি একটা কথার পরে জিগাইলামঃ তুমি নৃবিজ্ঞান পড়োনা সোসিওলজিতে?
-পড়িতো।
-আমারে একটু বুঝাইয়া দিও।
সে পরের দিন এক তাড়া হ্যান্ড নোট এনে দিলো। আমি তো টাস্কি।
-কি দিলা?
-তুমি পড়ে নিও-আমি সোশিওলজি বুঝিনা-মুখস্ত করি।

এ হলো রিনি ঝিনি খুব সরল-সহজ ছিলো। আরেকদিনের ঘটনা আরো মজার। সবাই ট্রেনে করে ফিরছিলাম। হঠাত সে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বল্লোঃ জানো আজকে আমার আব্বুর খুব লস হবে!
-কেন? সবাই সমস্বরে জিজ্ঞেস করলো।
-আজকে বৃষ্টি তো-তাই আইসক্রিম কেউ খাবেনা।
সবাই হা হা করে হেসে ফেললো। আর সে খুব অবাক হয়ে চাইলো। আমি সেদিন খুব বকা দিলামঃ তুমি স্থান-কাল-পাত্র বুঝোনা! এসব কথা বলতে হয়!

লেখা প্রায় শেষ! তার চোখের কথা বলিনি। এখোনো আমি যেসব কবিতা লিখি তার চোখের কথা ভেবেই! আমার ভাবনায় যে কয়জন নারী আছে-সে তাদের একজন! তার চোখ ছিলো অসাধারন।আমার ধারনা রিনি ঝিনি নিজেও জানতোনা।

আমার সেই ব্যস্ততার মাঝেই রিনি ঝিনি থার্ড ইয়ারে যেতে না যেতেই বিয়ে করে ফেললো না হয়ে গেলো আমি ঠিক জানিনা। মেহেদীবাগে আমরা সব বন্ধুরা খুব লাফা-লাফি করে বিয়ে উতসবে সামিল হলাম।আমার মনে হয়তো কিছুটা মেঘ ছিলো-কিছুটা বৃষ্টি ছিলো-কিছুটা আদ্রতা ছিলো। সেদিন সে যখন চলে যাচ্ছিলো গাড়ী করে-লাল শাড়িতে-কেমন যেনো অনুভুতি! ঠিক বুঝাতে পারবোনা।

তারপরেও সে মাষ্টার্স করেছিলো। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে আসতো।আমি নোট রেডী করে রাখতাম।সে নিয়ে যেতো। পরীক্ষা দিতো। পাশ করে ফেলেছিলো। যেদিন ক্যাম্পাস ছাড়বো সেদিন-ইউনিভার্সিটি রেলওয়ে ষ্টেশনে অপেক্ষা করছি ট্রেনের জন্য। দেখি রিনি ঝিনি এসে দাঁড়িয়েছে। আজকে তো তার আসার কথা ছিলোনা।আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনটা বিশের ইউনিভার্সিটি ট্রেন অনেক ফাঁকা থাকতো। সে আমার সাথে উঠে বসলো।
-তুমি তো জানতে চাওনি-আমার কার সাথে কোথায় বিয়ে হয়েছে?
-জানি তুমি ভালো আছো।
-জানো আমার দুইটা মেয়ে আছে-অনেক সুন্দর!
-জানি তো তোমার মেয়ে পরীর মতোই হবে।

ট্রেনের জানালায় উদাস বাতাসে তার চুল উড়ছে।বাঁক ঘুরছে ট্রেন। শেষবারের মতো আমাকে ছাত্র হিসেবে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ষোলশহরে রিনি ঝিনি থাকতো স্বামীর সংসারে-আমি জানতাম। ষোলশহর-পলিটেকনিক-ঝাউতলা পার হয়ে বটতলীতে ট্রেন থামলো। হঠাত খেয়াল হলো রিনি ঝিনি আমার হাত চেপে বসে আছে! নখের দাগ পড়েছিলো হাতে। সেই দাগ আজ আরো গভীরে পড়েছে কি? জানিনা! সময় নেই। জীবন ধাবমান।

পোস্টটি ১৩ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

আরাফাত শান্ত's picture


গল্পটারে আরও রুমানটিক বানাইতে পারতেন। সে পথে যান নাই! কি আর করা। যে পথে গেছেন সেই পথের বর্ননা ভংগীটাও অসাধারন হইছে। জায়গা গুলো চেনা অনেক বার যাওয়া চান্স পায় নাই তাই পড়িও নাই তবে অনুভব করলাম। তবে সময় একটা বড় জিনিস! সব কিছু পালটে দেয়!

অনিমেষ রহমান's picture


না রোমান্টিক কিছু ছিলোনা। জাষ্ট গল্প লিখে গেছি-নিজের মতো করে।

মৃন্ময় মিজান's picture


বেশ সুন্দর এবং স্নিগ্ধ লেখা। কিছুটা অযত্ন আর অবহেলা লক্ষ্য করলাম। তবু আমার ভাল লেগেছে বেশ।

অনিমেষ রহমান's picture


ধন্যবাদ ভাই-আমি আসলে একটানে লিখে যাই।
সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ!!

শাশ্বত স্বপন's picture


ভাই, আইসক্রিমওয়ালার মেয়ে কি শিবির ছিল? এত সুন্দর, অথচ রোমান্স নেই।কিছুটা অযত্ন আর অবহেলা লক্ষ্য করলাম। তবু আমার ভাল লেগেছে বেশ।গল্পটারে আরও রুমানটিক বানাইতে পারতেন। সে পথে যান নাই! ভাই নিজেরে একবার সৎ রাখছেন আবার স্মৃতিও মনে রাখছেন, এখানে লিখলেন।

আমি কিন্ত সন্দেহ করলাম, তয় কারও কাছে কইমু না।

অনিমেষ রহমান's picture


খুব সাধারন গল্প হিসেবে নেন-অসুবিধা নেই। না রিনি ঝিনি কিছুই ছিলোনা। খুব সাধারন মানুষ ছিলো। এমন অনেক সাধারন আমাদের সাথে ছিলো। এখানে সৎ কিংবা অসতের কিছু নেই। জাষ্ট গল্প।
Wink Wink

অকিঞ্চনের বৃথা আস্ফালন's picture


Sad(
কষ্ট পেলাম বিচ্ছেদে

অনিমেষ রহমান's picture


বিচ্ছেদেই সুখ!

অকিঞ্চনের বৃথা আস্ফালন's picture


kanna

১০

অনিমেষ রহমান's picture


মন খারাপের কিছু নাই দাদা।
স্মাইল।
Crazy Crazy

১১

শামান সাত্ত্বিক's picture


পড়লাম।

১২

অনিমেষ রহমান's picture


ধন্যবাদ ভাই!!

১৩

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


সুন্দর। আরও বড় হলে আরও ভাল হত।

এরকম আরও লেখা চাই। ভাল থাকুন।

১৪

অনিমেষ রহমান's picture


ধন্যবাদ ভাই!!
ভালো থাকবেন।
চেষ্টা করবো ভালো কিছু লিখার।

১৫

টুটুল's picture


স্যার,
ফাকিবাজি ভালু না Smile

১৬

অনিমেষ রহমান's picture


আছেন কেমুন উস্তাদ!
Smile Smile

১৭

তানবীরা's picture


বেশ সুন্দর এবং স্নিগ্ধ লেখা। কিছুটা অযত্ন আর অবহেলা লক্ষ্য করলাম। তবু আমার ভাল লেগেছে বেশ।

১৮

অনিমেষ রহমান's picture


আমার লেখা সবসময় একটু আউলানো ভাব থাকে।
ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।

১৯

তানবীরা's picture


নামটা নারীদের গল্প, মানে কি? জীবনের সব নারীদের গল্প কি একের পর এক আসবে? খুব ভাল একটা কাজ হবে তাহলে। সাথে আছি

২০

অনিমেষ রহমান's picture


ইচ্ছে আছে-আমার মা-নানু-না দেখা দাদু-আমার ছোটবেলার স্কুলের ম্যাডাম-সব রকম নারীরাই চরিত্র হয়ে আসবেন।
ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।

২১

তানবীরা's picture


ওহ খালি নানু দাদু Sad(

মানে তিনাদের কথা লিখবেন না ইয়ে মানে আরো যারা সাথে ছিলেন অবসর সময়ে মানে মানে ...।

২২

অনিমেষ রহমান's picture


অবশ্যই লিখবো।
বুঝছি কি বুঝাইছেন।

২৩

তানবীরা's picture


আকলমান্দলোগকে লিয়ে ইশারাই কাফি Big smile

২৪

অনিমেষ রহমান's picture


Innocent Innocent Innocent Innocent
হা হা হা হা
হাসলাম।

২৫

জ্যোতি's picture


ধূর যা! বিচ্ছেদ কেন? তবে ভালো লেগেছে খুব ।পরের গল্প আসুক।

২৬

অনিমেষ রহমান's picture


বিচ্ছেদ গল্পইতো মজার!

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

অনিমেষ রহমান's picture

নিজের সম্পর্কে

শুধু-শুধু লিখি !!