ট্রেন থেকে লিখছি.........
উৎসর্গঃ প্রিয় দাদী
৫ ডিসেম্বর, সকাল ৭.৩০। রাজশাহী রেলস্টেশন থেকে গল্পটা যখন লিখছি তখন আমি সিল্কসিটি ট্রেনের ‘ঝ’ বগির ৩৯ নম্বর সিটের যাত্রী, গন্তব্য ঢাকা। পাশের সিটে আমার খুব কাছের প্রিয় এক মানুষ, আমার দাদী।
৭৪ এর দুর্ভিক্ষে আমার আপন দাদীকে হারিয়েছে, তাই আমার সৌভাগ্য হয়নি তাকে দেখা দাদু পরে আর বিয়ে করেনি। বাকিটা জীবন একা কাটিয়ে দিয়েছেন। ২০০৫ সালে এসে দাদুকেও হারালাম।
তারপর থেকে রাজশাহীতে বাবার এক চাচা-চাচীকে দাদু আর দাদী বলে ডাকি। আপন দাদীর যে আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি তা অনেকটাই পূরণ করেছেন এই দাদী।
দু জনে বসে গল্প করছি আর রাস্তার দু ধারের সরিষা ক্ষেতের মনোরম দৃশ্য দেখছি
কখনো বা আসেপাশের সিটে বসা মানুষের গল্প শুনছি। আমাদের সামনের সিটগুলোতে দশ জনের এক বিশাল পরিবার। খুব মজা করছে ওরা। ওদের কথার সাথে আমরাও একটু আধটু তাল মিলাচ্ছি।
কথা প্রসঙ্গে সামনের সিটের মহিলা খুব গর্ব করে বলছে তাঁর দুই বছরের ছেলে ফেসবুক ব্যবহার করছে।
ফেসবুক ব্যবহার করা দোষের কিছু না। কিন্তু বাচ্চারা যাতে মিস ইউস না করে সে ব্যাপারে কয়জন সচেতন। দিনদিন যেভাবে সামাজিক মূল্যবোধের অবখহয় হচ্ছে তাতে করে সমাজে সুস্থ ভাবে টিকে থাকায় দায়।
কয়দিন পর যখন চার বছরের শিশু পর্ণ ছবি দেখে প্রশ্ন করবে আম্মু এইটা কি, তখন কি বলবেন???
আর যদি বলেন ওদের এখন থেকে সব জানা দরকার তাহলে আমার কিছু বলার নেই। বেশি মডার্ন হতে গিয়ে যে আমরা নিজেদের শিকড় কে ভুলে যাচ্ছি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইদানীং যে হারে পরকীয়া আর আত্মহত্যার খবর বের হচ্ছে, সত্যিই তা ভাব্বার বিষয়। ছোট থেকেই তো বৃহৎ কিছুর সৃষ্টি। এভাবে চলতে থাকলে......
আজকাল তো বাসার সবাইকে নিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখা দায়, নাকি আমি বেশি বেকডেটেড হয়ে গেছি তা বুঝতে পারি না। ইন্ডিয়ান সব চ্যনেলের বদৌলতে আজ অধিকাশ মেয়েরাই পাখি না কি রোগে আক্রান্ত
সন্ধ্যার পর বাসার চতুর্দিক থেকে যেভাবে স্টার জলসার আওয়াজ কানে আসে তাতে মনে হয় আমিও আসক্ত হব।
ধুর কি লিখছে এসব!!!!! কে কি হইল তাতে আমার কি আসে যায়.........
কোথায় ট্রেন ভ্রমণের কাহিনি লিখবো, তা না লিখে কি ভাবছি এসব।
এই মাত্র দাদী সহ সকালের নাস্তাটা সারলাম। চায়ে এক চুমুক দিয়েই ল্যপটপটা বের করলাম। না এবার মাথা ঠাণ্ডা , সিট পরিবর্তন করে জানালার পাশের সিটে বসলাম। রাস্তার দু পাশের হলুদ সরিষার ফুল জানালা ভেদ করে আমার মনের পর্দায়। মনে হচ্ছে বাংলা সিনেমার নায়ক আর নায়িকা নাচছে সরিষার ক্ষেতে, আর আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি অপলক।
রাজশাহী টু ঢাকা আবার ঢাকা টু রাজশাহী দীর্ঘ পাঁচটা বছর ট্রেনে ভ্রমন করেছি।
তাই ট্রেনের প্রতি আমার আলাদা একটা টান আছে। পাচটা বছর রাজশাহীতে থেকে একপ্রকার রাজশাহী শহরের প্রেমে পড়ে গিয়েছি। জন্মস্থান কুড়িগ্রামের পরেই এই শহরের মায়ায় পড়েছি বেশি।
গেল বছর লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ফেলেছি, আপাতত আর ইচ্ছা নেই। চাকুরী জীবন সম্পূর্ণ নতুন আলাদা এক জগত, কাজ ছাড়া আর কিছুই নেই বিশেষ করে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে বেশি।
একঘেয়েমি জীবন আর ভাল লাগছে না, আবার চাকুরীও ছাড়তে পারছি না। ভবঘুরে ছেলেকে তো আর কেউ দাম দিবে না। নিজের বাপ হোক আর মেয়ের বাপ হোক।
১লা ডিসেম্বর লাঞ্চের পর, আমরা বন্ধু ব্লগে একটু ঢু মারব ঠিক ওই মুহূর্তে বস তলব করল। সালাম দিয়ে রুমে ঢুকলাম। চুপচাপ বসে আছি, তারপর বস কিছু ফাইল হাতে ধরাইয়া দিয়ে বলল আগামীকাল রাজশাহী যেতে হবে, দু তিন দিন থাকতেও হতে পারে।
কয়েকদিন থেকে শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, জ্বর আসতে চায় আবার কি মনে করে চলে যায়।
রাজশাহীর কথা শুনে সানন্দে রাজি হলাম। পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করে বিমানবন্দর রেল স্টেশনে গেলাম। দীর্ঘ লাইন দেখে মাথা গরম আর আমাদের জমিদার কাউন্টার মাষ্টারদের ভাবসাব দেখলে মাথা গরম না হওয়ার উপায় থাকে না। একটা টিকেট দিতে তাদের পাঁচ মিনিট চলে যায় তাও তারা টের পায় না।
যাই হোক অবশেষে টিকেট পেলাম। যাত্রার তারিখ ২ ডিসেম্বর সকাল ৬.৩২।
বাসায় ফিরেই ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। রাতের খাবার সেরে সুমনা ফুপীর জন্য কিছু মুভি পেনড্রেইভে নিয়ে যখন ঘুমাতে যাব ঘড়ির কাঁটায় তখন ১ টা বাজে।
পরদিন সকালে ট্রেন, তাই মা বার বার তাড়া দিচ্ছিল ঘুমানোর জন্য। মনে খুব আনন্দ, দীর্ঘ ১ বছর পর আবার যাচ্ছি প্রানের শহর রাজশাহীতে। প্রিয় সব জায়গা আর মানুষগুলার সাথে দেখা হবে এই সপ্ন দেখতে দেখতেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টেরও পাইনি।
সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন পাঁচটা ত্রিশ বাজে। তাড়াহুড়া করে রেডি হয়ে দৌড়। টঙ্গী থেকে যখন ২৭ নম্বর বাসে উঠলাম তখন প্রায় ছয়টা। এই সকাল বেলায় রাস্তা অনেক ফ্রী থাকে তাই ভাবলাম সমস্যা হবে না। কিন্তু ভাগ্য খারাপ যেটা কখনো হয়নি সেটাই হল আজ।
টঙ্গী থেকে এয়ারপোর্ট আসতেই তিনবার ট্রাফিক জ্যামে পরলাম। ফলাফলও তাই হল জীবনে প্রথমবার ট্রেন মিস করলাম। এর আগে কখনো এমনটি হয়নি।
অবশ্য এর আগে কখনো বন্ধু বান্ধব ছাড়া যাওয়া হয়নি। এবারই প্রথম কাউকে ছাড়া একা যাচ্ছি আর কাকতালীয় ভাবে ট্রেনটাও মিস করলাম।
মনে হচ্ছিল ট্রেন না আসলে বন্ধুদের অনেক মিস করছি। বন্ধু ছাড়া লাইফ ইম্পসিবল কিনা তা জানি না তবে লাইফে বন্ধু অনেক বেশি প্রয়োজন।
রেলস্টেশন থেকে ফিরে উত্তরায় দেশ ট্রাভেলসে টিকেট করে রাজশাহীর উদ্দ্যেশে যাত্রা শুরু করলাম সকাল সোয়া আটটায়। কিন্তু কোন ফিলিংস পাচ্ছিনা। নেই হকারের চাপাবাজি কথা কিংবা ভিক্ষুকের আর্তনাদ।
পাশের সিটের ছেলেটা দিব্বি ঘুমাচ্ছে। আমিও কোন সঙ্গী না পেয়ে শিরোনামহীন এর গান ছেঁড়ে চোখ বন্ধ করলাম.........
আরেকবার যেতে চাই রিম ঝিম ঝিম সুদূরপুর
অবাক রোদ ভেজা তপ্ত দুপুর
আরেকবার তোমাদের লাল, নীল রং আনন্দে
একলা রাস্তায় এক চিলতে রোদ্দুর।
সারা বেলা বন্ধ জানালা ......
যদি তোমাদের অনেক শব্দ, আমার জানালায়
ছোট ছোট আনন্দের স্পর্শে, আঙ্গুল রেখে যায়
যদি সহস্র শব্দের উৎসব থেমে যায়
সারা বেলা বন্ধ জানালা ......
যদি তোমাদের লাল নীল গল্প আমার শরীরে,
কোন একলা রাস্তায় অবাক ভ্রমণে
যদি ইচ্ছের নীল রং আকাশ ছুঁয়ে যায়
সারা বেলা বন্ধ জানালা ...
গান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের ও পাইনি। সুপারভাইজারের লাঞ্চের ঘোষণায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। উত্তরবঙ্গের নামকরা রেস্টুরেন্ট ফুড ভিলেজে হালকা কিছু খেয়ে দাদীর জন্য দই নিলাম দুই কেজি।
ঘণ্টা দুয়েক বাদে রাজশাহীতে পৌচ্ছালাম। বাস স্টেশন থেকে অটো যোগে সাহেববাজারে দাদীর বাসায় গেলাম। কলিংবেল চাপতেই তিনতালার জানালা দিয়ে দাদী উঁকি মেরেই মুচকি এক হাসি দিলেন, যে হাসি দেখে বোঝার উপায় নেই দাদীর বয়স এখন পঞ্চাশ ছুই ছুই। বলে রাখি দাদী এখনো অনেক সুন্দরী।
আমাকে দেখেই দাদী মহাখুশি। দাদীর হাতে দইয়ের প্যাকেট দিয়েই বললাম কি আছে তাড়াতাড়ি দাও খুব ক্ষুধা লেগেছে। ফ্রেশ হয়ে এসে দাদা-দাদী ও ফুপুরা মিলে একসাথে খেলাম। দাদীর কোন ছেলে না থাকায় আমাকে খুব বেশি আদর করত।
তিন ফুপীর মধ্যে বড় জন বোটানিতে অনার্স করে প্রাইভেট একটা জব করছে, মেজো ফুপী ডাক্তার আর ছোটটা ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে।
বড় ফুপী ইতোমধ্যে বিয়ের চ্যাপ্টার ক্লোজ করে দিয়েছে, ফুপা দুদকে চাকরী করে। খাওয়ার পর সবাই মিলে সুখ দুঃখের আলাপ করলাম একটু আধটু। তারপর কিঞ্চিৎ বিশ্রাম ......
বিকেলে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই সোজা আমান জুট মিলস এর উদ্দ্যেশে রওনা দিলাম। নওদাপাড়া আমচত্তর পার হয়ে নারিকেল বাড়িয়ায় আমানের বিশাল ফ্যাক্টরি দেখে প্রানটা জুড়াল। যাক অবশেষে উত্তরবঙ্গে কল কারখানা হচ্ছে। প্রায় ২৫০০ লোকের কর্মসংস্থান এই ফ্যাক্টরিতে।
এখানে বি জি এম ই এ(BGMEA)এর দুই উরদ্ধতন কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ হল। উনারা খুব বন্ধুসুলভ মানুষ। পুরা প্লান্ট আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখালেন, পাট থেকে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ তৈরি হচ্ছে এখানে। খুব ভাল লাগল। অনেক কিছুই শেখা হল।
তারপর আমার কাজ বুঝে দিল। কাজ শুরু করে দিয়ে চলে আসলাম সেদিনের মত।
রাতে দাদুর বাসায় ফিরে সুমনা আর সিফাত ফুপুকে নিয়ে মুভি দেখলাম। দ্যা কনজুরিং (The Conjuring ) ,ভুতের মুভি তাই কিছুক্ষণ পর পর সুমনা ফুপির চিৎকার। দাদী তো একবার ভঁয়েই পেয়ে গেছিল ওর চিৎকারে।
পরদিন সকালে উঠেই নাস্তা সেরে আবার সাইট ভিজিট করতে গেলাম। স্যারদের সাথে মিটিং সারতে সারতে লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। স্যার দাওয়াত করল, স্যার আর একজন গেস্ট সহ মোট তিনজন একসাথে খেলাম। ফ্যাক্টরির ভিতরে লাগানো লাউ গাছের লাউ, টমেটো আর পুকেরর তাজা রুই মাছ। ওহ কি যে সুস্বাদু খাবার, ঢাকার ফরমালিন যুক্ত খাবার খেতে খেতে খাবারের আসল স্বাদটাই যেন ভুলতে বসেছি।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাতে বাসায় ফিরলাম। ঢাকায় ফিরতে হবে, টিকেট কাটতে হবে, দাদুকে বলব ঠিক ঔমহুরতে দাদু ২ টা টিকেট এনে হাতে দিল আমার। বলল তোর দাদীকে নিয়ে কাল ঢাকায় তোর বড় ফুপির বাসায় নিয়ে যাবি।
ভাবলাম ভালই হইল, ট্রেনে একা একা জার্নি খুব বোরিং লাগে। তাছাড়া দাদী আমার খুব ভাল বন্ধুও বটে।
আসার সময় ট্রেন মিস করেছি, তাই এবার খুব বেশি সচেতন। সকালে উঠেই আধাঘণ্টা আগেই রওনা দিলাম যদিও সাহেব বাজার থেকে রেলস্টেশন বেশি দুরের পথ না। সাড়ে সাতটায় যখন ট্রেন ছাড়ল তখন জানালা দিয়ে দাদু হাত নেড়ে বিদায় দিচ্ছিল আর দুষ্টামি করে বলল, তোর হাতে তুলে দিলাম, দেখে শুনে নিয়ে যাস।
তারপর সেই সকাল থেকে দুজনেই গল্প করছি, আর ফাকে ফাঁকে আমি লিখছি। মাঝে মাঝে দাদী ভুল ধরাইয়া দিচ্ছে, বলছে এই লাইনটা ঠিক কর। ঔখানে ঔ শব্দটা দে ভাল হবে।
রাজশাহী স্টেশন থেকে লেখা শুরু করে কখন যে মির্জাপুরে পৌচ্ছালাম তা টেরও পেলাম না। মনে হচ্ছে এইতো কিছুক্ষন আগে রাজশাহী থেকে উঠেছি।
ল্যাপ্টপের চার্জও প্রায় শেষ, চাইলেও আর লিখতে পারছি না। থাক সব কথা না হয় না -ই বললাম। কিছু কথা স্মৃতিতে রেখে দিলাম। দাদীকে কমলাপুরে ফুপীর বাসায় রেখে আমি হয়তো টঙ্গী চলে যাব। তারপর আবার শুরু হবে কর্মব্যস্ত দিন যেখানে নেই কোন বিনোদন কিংবা আনন্দ আছে শুধু হরষে বিশাদ !!!!!
জানি না আবার কবে হবে এইরকম ভ্রমণ। ট্রেনে বসে লেখা, অদ্ভুত এক অনুভূতি, অন্য রকম অভিজ্ঞতা। আজ এ পর্যন্তই……………..
সাবলীল লেখা। চলুক।
ধন্যবাদ
ভাল লাগলো
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
ভালো লিখছেন।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য আর সাথে সাথে মন্তব্য করার জন্য। ভাল থাকবেন।
মন্তব্য করুন