↓↓ বৃষ্টিবিলাস ↓↓
শুক্র বার, সময় সকাল ১০ টা। আদ্রিতা পড়ার
টেবিলে, কিন্তু কিছুতেই কনসেন্ট্রেশন
টা পড়ার দিকে রাখতে পারছে না। এর
কারন হচ্ছে জানালা দিয়ে গানের শব্দ
আসছে।
"".. সারাটা পথ জুড়ে আমি একা
হেটে যাই আকাশ তারার পানে চেয়ে
নীল জোছনায় স্মৃতিরও ভীড়ে...""
এই টাইপ একটা গান। এত জোরে কেউ গান
বাজায়। মেজাজ টা প্রচন্ড রকমের খারাপ
হচ্ছে তার। আগের বাসাটাই
ভালো ছিলো। এই রকম কোন
সমস্যা ছিলো না এই বাসাটায় আজ প্রায়
এক মাস। সেই প্রথম দিন থেকেই এই প্রবলেম
টা হচ্ছে। প্রতিদিন দুই টাইম পাশের
বাসার কে জানি প্রচন্ড জোরে গান
বাজায়। আসলে তার রুম টা তাদের বাসার
একটা কর্ণারে। বেলকনি আছে। পাশের
বাসার যে রুমে গান বাজে সেটা তার
রুমের সোজা। অদ্ভুত ব্যাপার
হলো সে আজো ঐ
রুমে কে থাকে বা কে এত জোরে গান
বাজায় সেই ব্যক্তি টাকে দেখার
সৌভাগ্য তার হয় নি। যদি হত
তবে আচ্ছা মত বকে দেয়া যেত।
আদ্রিতার পরিচয়ে আসি,
বাবা মার অতি আদরের মেয়ে। তার দুই
ভাই।দুজনেই দেশের বাহিরে থাকেন।
আদ্রিতা এই বার ইন্টার
পরীক্ষা দিয়েছে, প্রচন্ড
মেধাবী মেয়েটা। অনেক
ভালো রেজাল্ট করছে সে। অল্পের জন্য
গোল্ডেনটা মিস হয়েছে। এখন
সে মেডিকেলের জন্য দিন রাত
পড়ালেখা করছে। লক্ষ্য একটাই, মেডিকেল
এ চান্স পেতেই হবে।
কিন্তু এই উদ্ভট ঝামেলায়
পড়ালেখা টা ঠিক মত করা যাচ্ছে না।
আদ্রিতা পড়ার টেবিল
থেকে উঠে কিচেন এ যায়।
কফি খাওয়া দরকার। রাগ উঠলে তার
মাথায় পেইন আসে।
সে কফির
পেয়ালা হাতে বেলকনি টাতে দাড়ায়।
যদি দেখা যায় মানুষ টাকে, রিকুয়েস্ট
করবে। যদি কাজ না হয় তবে ঝাড়ি।
আদ্রিতা বড় বড় চোখ
করে তাকিয়ে আছে দিকে। তার রুমের
বেলকনি থেকে ঐ রুমের
জানালা টা দেখা যায়।
""
..... মেঘ উড়ে উড়ে, আকাশের
গায়ে ভালোবাসা নিয়ে বৃষ্টি সাজায়......
ইচ্ছে হলে ভালোবাসিস,
না হয় থাকিস যেমন থাকে স্নিগ্ধ
গাংচিল ""
গানের কথা গুলো খুব সুন্দর ত!!!
নিজের অজান্তেই সে মুগ্ধ হতে হয়
আদ্রিতা। প্রতিদিন সকালে এক ঘন্টা আর
বিকালে এক ঘন্টা গান বাজে।
এটা বাজবেই। আর আকাশ
যদি কালো থাকে মানে,
বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব,
তবে গান বাজার সময় টা একটু বারে।
খাওয়া পর দুপুরের দিকে আদ্রিতা একটু
ঘুমায়।
এটা তার অভ্যাস। ঘুম ভাঙে প্রায় শেষ
বিকেলের দিকে। ঘুম ভাঙার পর
কিছুটা সময় ছাদে কাটায়। তখন
কানে থাকে হেডফোন। ভারতীয়
শিল্পী দের গান ভালো লাগে তার। আজও
তার ব্যতিক্রম হয় নি।
বিকেলে ছাদে হাটছে আদ্রিতা।
পাশের বাসায় গান বাজছে,
""...... শেষ কথা গুলো শেষ,
শেষ ব্যর্থ অবশেষ,
চমকে দিবো আজ তোমার ঘুম ভাঙিয়ে
আনন্দে দু:খে নয়, কাদবে বিস্ময়ে.""
যতই সে কনসেন্ট্রেশন টা তার গানের
দিকে রাখতে চায় ততই তার খেয়াল টা ঐ
দিকে চলে যাচ্ছে। মাথাটা আবার টন টন
করতে শুরু করছে। না আর
ছাদে থাকা যাবে না। প্রচন্ড বিরক্ত
ভাব নিয়ে নিজের রুমে যায় আদ্রিতা।
বেলকনি তে দাড়িয়ে জোরে একটা ডাক
দেয়,
"" হ্যালো কেউ আছেন?? ""
ওপাশ থেকে কোন সাড়া শব্দ আসে না।
মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথায় টন টন করছে তার।
##
ভোরের দিকে উঠে পড়তে বসার অভ্যাস
আদ্রিতার। আর এর এখন আরেক টা কারন
হলো সকালে ৯:৩০ থেকে প্রায়
সাড়ে দশটা পর্যন্ত পড়া যায় না ঐ পেইন
টা জন্য। সকাল থেকে আকাশ টা প্রচন্ড
কালো করে আছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসবে।
হঠাৎ আদ্রিতা শুনতে পেলো
"" বৃষ্টি নেমেছে আজ আকাশ ভেঙে
হাটছি আমি মেঠো পথে,
মনের ক্যানভাসে ভাসছে তোমার ছবি
বহুদিন তোমায় দেখি না যে.....""
গানটা যেনো আজ পরিবেশ টার
সাথে মিলে যাচ্ছে।
আদ্রিতা বেলকনিতে যায়। হাতে কফির
পেয়ালা। অদ্ভুত ভালো লাগছে গান টা।
অন্য একটা ভুবনে হারিয়ে যায় আদ্রিতা।
গান গুলো তার মনে ঠাঁই পেতে থাকে।
একটা সময় সে অপেক্ষা করে কখন
সে গানের শব্দ টা শুনবে।
সে মনে মনে একটা ছেলে কে সাজায়
যে ঐ ছেলে টা হবে যে তাকে গান
বাজিয়ে বিরক্ত করে। সে ভাবে,
যদি কোন দিন ছেলেটার
সাথে দেখা হয়
তবে প্রথমে ঝাড়ি দিবে পরে সাথে সাথে সরি ও
বলবে।
*
দেখতে দেখতে মেডিকেল এর পরীক্ষার
সময় এসে যায়। পরীক্ষার দিন
সকলে আদ্রিতা রেডি হয়ে গাড়ি নিয়ে ওসমানী মেডিকেল
হাসপাতালের দিকে যাওয়ার জন্য বের
হয়। তার সিট পরে একটা ছেলে সাথে।
মোটা ফ্রেম এর গ্লাস পড়া ছেলেটার।
ছেলেটার ডান পাশে একটা স্ট্রেচার
রাখা। এটা দেখেই
আদ্রিতা বুঝে যে ছেলেটার
পায়ে সমস্যা। পরীক্ষার আগে একটু কথা হয়
ছেলেটার সাথে,
- কেমন আছেন?
-- জ্বী ভালো।
- আমি আদ্রিতা, কোন কলেজ এর আপনি??
-- আমি রাতুল, এম সি কলেজ, আপনি??
- সরকারী মহিলা কলেজ
-- প্রিপারেশন কেমন??
- মোটামুটি।
-- Best of luck
- Best of luck
*
এক দিন বিকেলে আদ্রিতা ছাদে হাটছে,
হঠাৎ সে পাশের বাসার
ছাদে একটা ছেলে দেখতে পায়।
ছেলেটার এক পাশে স্ট্রেচার রাখা।
দেয়ালে হেলান
দিয়ে দাড়িয়ে আছে সে, ক্ষণিকেই তার
পরীক্ষার হলের ঐ ছেলেটার
কথা মনে পড়লো। সে ভাবলো ,
তবে কি এই ছেলেটাই সেই
ছেলেটা তবে সে এখানে কি করে? আর এই
ছেলেটাই কি জোরে গান বাজায়?
তার কৌতূহল জাগে ছেলেটার প্রতি।
**
" কেউ আছেন?? "
আদ্রিতা ডাক দেয় ঐ বাসার জানালার
দিকে তাকিয়ে কিন্তু কোন সাড়া শব্দ
আসে না। আদ্রিতা আবার ডাক দেয়,
" কেউ কি আছেন?? "
ওপাশ নিঃশব্দ,আদ্রিতা চুপ হয়ে যায়।
ক্ষণিক পরে ওপাশের জানালা খুলে রাতুল
উত্তর দেয়,
"" জ্বী আছি, বলেন ""
আদ্রিতা অবাক আবার রাতুল ও অবাক।
তারা কেউ ভাবতেই পারে নি আবার
দেখা হবে তাও আবার
পাশাপাশি বাসা।
" আপনি এই বাসায় থাকেন!!!
এই রুম আপনার!!!! "
''" জ্বী ""
" বেশ কয়েকদিন আগে ডাকলাম,
আপনি কোন সাড়া দিলেন না যে? "
"" আমি জানালার
পাশে আসতে আসতে আপনি চলে গেলেন ""
" প্রচন্ড বিরক্ত করছেন এই কয় দিন আপনি "
রাতুল আকাশ থেকে পরে,
"" কি ভাবে?? ""
" এত শব্দ করে কেউ গান বাজায়?? "
"" ও দু:খিত, আসলে ভাবতেই
পারি নি যে শব্দ টা ঐ পর্যন্ত যাবে ""
" আজ গান অফ, কারন কি? "
"" ইলেক্ট্রিসিটি নাই ""
" বাসায় কে কে আছেন? "
"" মা ""
" আর কেউ?? "
"" ভাইয়া বাইরে থাকেন ""
" আর কেউ না?? "
"" না ""
" ও, আপনি থাকেন না বুঝি? "
"" আমিতো থাকিই ""
বলে রাতুলও হাসলো।
" আচ্ছা পরে কথা হবে, ভালো থাকবেন "
"" আপনিও ""
**
তার পর থেকে প্রায় কথা হত তাদের।
ভালো বন্ধুত্ব তৈরী হয় তাদের মাঝে।
ফোন , ফেইসবুক সব কিছুতেই কথা হয়।
মেডিকেল এ আদ্রিতা চান্স পায়
না তবে রাতুলের হয়ে যায়।
আদ্রিতা একটা প্রাইভেট মেডিকেল এ
ভর্তি হয়। এক নিমন্ত্রণে আদ্রিতা রাতুলের
বাসায় যায়। রাতুলদের বাসাটা ছোট,
তবে অনেক সুন্দর। সামনে একটা বাগান
আছে। কাঠ গোলাপ, শিউলী আর
বেলী ফুলের গাছ। আর খুব ছিমছাম
করে সাজানো রাতুলের ঘর টা। ঘরের
রং টা নীল,ডান দিকের দেয়াল টায়
পাবলো পিকাসোর আঁকা বড়
একটা পেইন্টিং । বাম দিকের
দেয়ালে অর্থহীন এর একটা গ্রুপ ছবি। তার
পাশে রাতুলের একটা ছবি। তার
সাথে শোভা পাচ্ছে কবিগুরু ও
জীবননান্দ দাশের ছবি। টেবিলের
কর্ণারে বুক সেলফে অনেক গুলো হুমায়ুন
আহমেদ এর বই। হঠাৎ একটা নীল রং এর
ডায়রীর দিকে চোখ যায় আদ্রিতার।
হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে সে। অনেক
গুলো কবিতা, অসম্ভব সুন্দর
কবিতা গুলো তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে,
সব গুলোই উৎসর্গ করা হয়েছে লাবন্য নামক
কেউ এক জন কে। রাতুল ঘরে ঢুকতেই
আদ্রিতা চমকে উঠলো। সে টেবিলের উপর
ডায়রীটা রাখল, রাতুল কে জিজ্ঞেস করল,
"" লাবন্য কে?? ""
রাতুল কিছুই উত্তর দেয় না।
হাতে ডায়রী টা নিয়ে অপলক
তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন ডায়রীটার
দিক।
আদ্রিতা অনেক বার প্রশ্ন করছে কিন্তু কোন
জবাব পায় না। অবশেষে রাতুল এর মার
কাছ থেকে সব জানতে পারে আদ্রিতা।
লাবন্য সেই মেয়ে যার জন্য রাতুল।
আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। আজ তার
একটা পা এই কারনেই নষ্ট। লাবন্য,
রাতুলের মায়ের বোনের মেয়ে। রাতুল
আর লাবন্য তাদের সম্পর্ক ছিলো প্রায়
তিন বছর। লাবন্য
পৃথিবীটা ছেড়ে চলে গেছে। ক্যান্সার
নামক নিষ্ঠুর ব্যধি যা তার
রক্তে বাসা বেধেছিলো।
বিদেশে নিয়েও
চিকিৎসা করানো হইছে কিন্তু কোন
লাভ হয়নি।
আস্তে আস্তে আদ্রিতার কাছে স্পষ্ট
হতে থাকে যে কেন রাতুল এতটা গম্ভীর, এক
সময় রাতুলের বিষয়
গুলো আদ্রিতা কে প্রচন্ড ভাবায়।
একটা পর্যায়ে আদ্রিতা রাতুল কে তার
নিজের মত করে পেতে চায়। সে রাতুল
কে ভালোবাসতে শুরু করে।
তার খুব ইচ্ছে করে রাতুল এর হাত
ধরে হাটতে, তার সাথে আকাশ দেখতে,
বৃষ্টিতে ভিজতে।।
এক বিকেলে,
রাতুল ছাদে বসে আছে, আদ্রিতা উপস্থিত
হলো।
" সারা বাসা তোমাকে খুজলাম, আর
তুমি এখানে?? "
"" কেনো বলতো?? ""
" কি করো?? "
"" তেমন কিছু না, আকাশ দেখি।
আজ আকাশ টা অনেক
কালো করছে,হয়তো বৃষ্টি আসতে পারে ""
" তোমার বৃষ্টিতে ভিজতে অসম্ভব
ভালো লাগে তাই না?? "
"" হুম ""
" একটা কথা বলতে চাই তোমায় "
"" বলো ""
আদ্রিতা কম্পিত কন্ঠে বলে,
" রাতুল, আমাকে তোমার বৃষ্টিতে ভিজার
সাথী করবে? "
রাতুল আদ্রিতার দিকে অবাক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
"" করুণা করছো !!!! ""
" না, নিজে ধন্য হবো "
"" কিভাবে?? ""
" যে ভাবেই হউক, বলো করবে কি? "
"" আমার জীবনে সবাই ভোরের শিশির
হয়। একটা প্রদীপ এর মত, জ্বালানী শেষ
হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি আর তখন
না বলে যা দপ করে নিভে যায় ""
" অতীত টেনে কি লাভ?? "
"" ঐ টা যে আমার অস্তিত্ব ""
" ঐ খানে একটু ঠাঁই চাই আমি "
"" আমি শূণ্য ""
" আমি তোমার পাশে বসে ঐ শুন্য
টাকে অজস্রে পরিণত করবো "
"" প্রতিজ্ঞা সেও করেছিলো ""
" আমিও করলাম, পার্থক্য এটাই যে লাবন্য
এখন অতীত। উনার জন্য
প্রাথর্না করো যেনো উনি শান্তিতে থাকেন
"
"" আবার যদি একা হই? ""
" আটকে রাখতে পারবে না তুমি?? "
"" পাগলামো করছো তুমি আদ্রিতা ""
" মানুষের মনের দুই টা অংশ থাকে, এর
মাঝে একটা অংশ কোন সিদ্ধান্ত
নিতে পারে না। কিন্তু আমার মনে হয় ঐ
ধারনা ভুল, আমার দুটা অংশই
বলছে তোমাকে আমার চাই "
"" এটা হয় না, হতে পারে না ""
" এভাবে বাঁচা যায় না রাতুল "
"" বেশ আছি আমি ""
" মিথ্যে বলছো তুমি "
"" কেনো বিরক্ত করছো ""
" ভালোবাসি তাই "
রাতুল আকাশের দিকে তাকায়, তার
চোখে কয়েক বিন্দু অশ্রুরা ভীড় করতে শুরু
করেছে। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিও শুরু হলো।
আদ্রিতা আলতো করে রাতুলের
হাতটা ধরলো। আজ তারা এক
সাথে বৃষ্টিতে ভিজবে। অতীতের সব কষ্ট
আজ ধুয়ে এই বারি ধারার স্পর্শে। এই
বৃষ্টির ফোটা যেন নতুন জীবনের
সঞ্জীবনী। সব নোনা কষ্ট শেষ
হবে আজকের এই বৃষ্টি বিলাসে।
মন্তব্য করুন