সেদিন বাঁধভাঙা চোখের জল খুঁজে পেয়েছিল ভালবাসার আশ্রয়
শহরের ছোট্ট একটি এলাকা। আধুনিকায়নের ছোঁয়া তখনো লাগেনি তেমন। সারা মহল্লায় কয়েকটি একতলা বিল্ডিং, কিছু টিনশেড সেমিপাকা বাড়ি আর বাদ বাকী সব বাঁশের বেড়ার ঘর উপরে টিন কিংবা চাটাইয়ের ছাউনি। চলাফেরার রাস্তাগুলোর বেশির ভাগই কাঁচা আর বাড়িগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বেশ কিছু খোলা মাঠ আর নিচু জমি। মোটকথা শহরের মধ্যেই কিছুটা গ্রামীণ পরিবেশের আবহ।
একতলা বাড়ির সামনে একটু খোলা চত্বর, তারপর বেশ বড় একটা মাঠ। সেই মাঠে পানি জমেছে। দুপুরের আগে থেকেই একনাগারে বৃষ্টি হচ্ছে, যতদূর চোখ যায় ধু ধু করা ধূসর আকাশটা যেন কেঁদেই চলেছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে অস্থির নাগরিক জীবনে কিছুটা স্বস্তি এনে দেয় এই আষাঢ়ে বৃষ্টি। বৃষ্টির পানিতে থৈ থৈ করা মাঠ কিশোর মনকে আন্দোলিত করে তোলে। নির্জন দুপুরের এই বিষণ্ণ প্রহরে জানালার গ্রীল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে ছোট্ট ছেলেটি। কোন কিছুই আজ তার মনকে আন্দোলিত করতে পারছে না, তার ভিতরটা আজ আকাশের মতই হু হু করে কাঁদছে। বাবার জন্য, গাঁয়ের জন্য মনটা ভীষণ খারাপ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে উদাসভাবে বাইরে তাকিয়ে আছে, বৃষ্টিতে ডুবে থাকা মাঠটিকে মনে হচ্ছে যেন নদী। তার দৃষ্টি পানিতে ডুবন্ত খোলা মাঠের শেষ প্রান্তে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছটির দিকে নিবদ্ধ। চোখে ভেসে ওঠে ওর গাঁয়ের ছবি।
গাঁয়ের সবুজ প্রকৃতি, নদী, চেনাজানা মানুষ, সবার কথা খুব মনে হচ্ছে। কেন সে গ্রাম ছেঁড়ে আসলো? বাবা ঢাকা আসবে শুনে খুশিতে বাবার সাথে চলে আসলো। নানীও বলল স্কুল ছুটি, তোর খালার বাসা থেকে বেড়িয়ে আয়। বাবা সেই যে এখানে রেখে চলে গেল আজ এক সপ্তাহ হল এখনও এলো না! এখানে ওর একদম মন টিকছে না। বার বার শুধু গ্রামের কথাই মনে হচ্ছে। সামনের মাঠের বিস্তৃর্ণ জলরাশি দেখে গ্রামের নদীর কথা খুব মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যেদিন প্রথম নদী পার হয়েছিল। যেন নতুন আবিষ্কার! সেই আনন্দের কথা আজও চোখে চোখে ভাসে। কতদিন নদীর পাড়ে বসে একা একা ভাবত ঐ পাড়টা কত সুন্দর! কি লম্বা চর আর কাশের বন! ও কি কোনদিন যেতে পারবে ওপারে?
একদিন ঠিকই সুযোগ এসেছিল, সেদিন সফিক মামাদের সাথে নদী পার হয়ে চলে গিয়েছিল তার স্বপ্নের রাজ্যে। নৌকা থেকে চরে নামতেই সে কি আনন্দ! যেন নতুন রাজ্য জয় করা হল। সফিক মামা বলেছিল, মামা দূরে কোথাও যেওনা, নদীতে নেমো না। ও ঘার নেড়ে শুধু জানিয়েছিল যে সে দূরে কোথাও যাবে না। চরের নরম বালুতে ছোট ছোট পা ফেলে ছুটে চলা, আহা! সে কি ভোলা যায়! বালুচরে আর কাশবনে ছুটোছুটি করে কি চমৎকার সময় কাটিয়েছিল সেদিন! সাদা সাদা বকের ঝাঁকের ওড়াওড়ি! সফিক মামাদের কাজ শেষ হলে আবার ফিরে এসেছিল এপারে।
মনে পড়ে যায় তাকে খুঁজে না পেয়ে নানীর দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করুণ মুখের ছবিটাও। দীর্ঘ সময় তাকে খুঁজে না পেয়ে চারিদিকে রটে গিয়েছিল তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। নানীর সে কি কান্না! তাকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কেঁদেছিল, সব আজ মনে পড়ছে। নানী কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, কোথায় গিয়েছিলে ভাই? তোকে হারালে তোর বাবাকে আজ কি জবাব দিতাম? তোর মা মারা যাবার সময় আমি যে তাকে কথা দিয়েছিলাম, তোকে আমি দেখে রাখব! আর কখনো আমাকে না বলে কোথাও যেওনা ভাই! সে নানীকে কথা দিয়েছিল আর কখনই তাকে না বলে কোথাও যাবে না, যায়ওনি কোনদিন। আজ নানীর কোথাও মনে পড়ছে খুব। এই পৃথিবীতে দুজন মানুষকে সে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে, একজন বাবা আরেকজন নানী।
দুপুর শেষ হয়ে বিকেল গড়ায়, ধীরে ধীরে বৃষ্টিও থেমে যায়। মাঠে জমা পানি কমে গেছে অনেকটা। চারিদিক খোলা থাকায় পানি জমে থাকেনা তেমন। একটি দুটি করে শিশু কিশোর ভিড় জমায় মাঠে, অনেক জায়গায় কাদা জমে আছে, তা সত্ত্বেও ওরা মেতে ওঠে ফুটবল নিয়ে। জানালার গ্রিল ধরে ছেলেটি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। খালাতো ভাই খেলতে যাবার সময় অবশ্য ডেকেছিল, ওর ভাল লাগছিল না তাই আর যাওয়া হয়নি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, যেন কোন কিছুর জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা!
পশ্চিম আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে লালচে আভা, বিকেলের শেষ আলোটুকু নিভু নিভু করছে, হঠাৎ ছেলেটির চোখদুটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ম্লান মুখে ছড়িয়ে পড়ে একরাশ আনন্দের ঝিলিক। তার দৃষ্টি অনেক দূরে, মাঠের একেবারে শেষ প্রান্তে একজন মানুষের অবয়বের উপর নিবদ্ধ। ধীরে ধীরে অবয়বটি কাছে এগিয়ে আসে, আরও কাছে। বাড়ির সীমানার কাছাকাছি আসার সাথে সাথেই ছেলেটি ঘর থেকে বেরিয়ে একছুটে বাইরে চলে আসে।
ছেলেকে দেখে বাবা যেন থমকে দাঁড়ায়! আধবসা হয়ে দুহাত বাড়িয়ে দেয় সামনের দিকে। ছেলেটি দৌড়ে এসে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, গলা জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়ে কান্নায়। সারাদিনের পুঞ্জীভূত মেঘ ভালবাসার উষ্ণ ছোঁয়ায় হঠাৎ যেন গলতে শুরু করে। ছেলের কান্না দেখে বাবার মনটা খারাপ হয়ে যায়। কি ব্যাপার, কাঁদছ কেন বাবা? বাবার কণ্ঠ শুনে ছেলের কান্না যেন আরও বেড়ে যায়। আমি এখানে থাকবো না, আজ খালা আমাকে মেরেছে। বাবার মুখ থেকে হাসিটুকু মুছে যায়। ধরা গলায় শুধু বলে, কাঁদে না বাবা, আমরা এখান থেকে চলে যাব, কালই গ্রামে চলে যাব। ওখানে তোমাকে আর কেউ মারবে না।
অনেক অবেগ ভরা লেখা। এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। ওই বয়সে কারও মা না থাকাটা সত্যি অনেক কষ্টের।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য। এরকম কষ্ট অনেককেই পোহাতে হয়।
গল্প, না কি সত্যি কাহিনি। আমি শেষটা মেনেই পড়লাম। দারুণ লেখেন আপনি।
আপনার ধারনাই ঠিক, অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগলো আবেগময় গল্পটা!
জীবনের গল্প তো!
চমৎকার লিখেছেন।
ধন্যবাদ বাউন্ডুলে।
আপনার লেখা কই?
লেখা ভুলে গেছি ভাই,
কিছুই মাথায় আসে না আর..
শুরু করেন, দেখবেন মাথা খুলে গেছে....
চমৎকার লিখেছেন।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন