ধূসর গোধূলিঃ ৩৩ - চেতনায় একাত্তর
আজ বিজয় দিবস। দিনের শুরু থেকে গ্রামের সর্বত্রই যেন উৎসবের সুর বেজে ওঠে। সন্ধ্যায় শুরু হবে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান। ডিসেম্বরের হিম শীতের রাতে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে কলাবতী বাজার সংলগ্ন বটতলা প্রাঙ্গণে বিকাল থেকেই জড়ো হতে থাকে বিভিন্ন বয়সী লোকজন। এটা যেন গ্রামবাসীর প্রাণের আয়োজন। প্রতি বছর বিজয় দিবসটিতে হাসি আনন্দে মেতে ওঠে এরা, যেমনি করে উঠেছিল দশ বছর আগে একাত্তরের এইদিনে। শীতের প্রকোপ থেকে দর্শকদের কিছুটা আরাম দিতে মঞ্চের সামনের খোলা জায়গাটির উপরে সামিয়ানা আর চারপাশে কাপড়ের ঘেরাও দিয়ে দর্শকদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাতে ইলেক্ট্রিসিটির অভাব দূর করতে প্রস্তুত রাখা হয়েছে বেশ কিছু হ্যাজাক বাতির।
অনুষ্ঠানের শুরু থেকেই মজনু গ্রামের সব শ্রেণির মানুষের সাথে মিশে যায়। সবার কূশলাদি জানতে চায়, অনুষ্ঠানটি অনেক বেশী মানুষের সাথে মেশার সুযোগ করে দেয় ওকে। বাদল অবশ্য মজনুকে দৃষ্টির আড়াল করে না। অনুষ্ঠানের পুরোটা সময়জুড়ে ওর সাথে আঠার মত লেগে থাকে। খালেক মেম্বার নিজেও মানুষের সাথে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে মিশতে চেষ্টা করে। দশ বছর আগে তাদের এবং তাদের পূর্বপুরুষের ভুলত্রুটি শুধরে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নতুন সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। আজকের দিনে এরা উভয়েই ভুলে যেতে চায় হিংসা-হানাহানি। সবাই দেখে অন্য এক খালেক মেম্বারকে, অন্য এক মজনুকে। সাঈদ খান দূর থেকে লক্ষ্য করে খালেক-মজনুদের নির্বাচনী কৌশল আর মনে মনে হাসে। অবশ্য এও জানে মানুষ দ্রুত সবকিছু ভুলে যায়। আবার হয়তো ভুলেও না, কিন্তু অন্য কোন উপায় না থাকায় মেনে নেয়। এদেরকেই নিয়োগ করে জনপ্রতিনিধি হিসেবে। জানে যে এরা তাদের কাঙ্ক্ষিতজন নয়, তবুও এদের কাছেই প্রত্যাশা করে নতুন সমাজ গড়ার। সাঈদ খান উপলব্ধি করে, এ অবস্থা থেকে উত্তরণ দরকার এবং এখনই সময়।
সন্ধ্যার আগেই দর্শকদের জন্য নির্ধারিত আসনগুলো কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে অনুষ্ঠান। অয়ন দেখে, শ্যামলদা, তপুভাই, আসাদ ভাই সবাই খুব ব্যস্তভাবে ছুটোছুটি করছে। মঞ্চের সামনে পাতা চেয়ারগুলোর একেবারে প্রথম সারিতে বাবার সাথে ইসমাইল স্যার, হরিকাকা, জগানন্দ কাকু, হামিদ কাকা, সাঈদ কাকা, আরও অনেকে বসে আছেন। অয়ন সুবল আর মিরাজের সাথে বাবার পিছনের সারিতে বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে কখন অনুষ্ঠান শুরু হবে।
একটু পরেই আসে সেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। সামনে রাখা টেবিলটার উপর হারমোনিয়ামের সামনে চারুদি, তার পাশেই ছোটদি আর শীলা আপু। ওদের পিছনে অনেকে একসাথে দাড়িয়ে আছে- শ্যামলদা, তপু ভাই, রঞ্জু ভাই, তপনদা। সবাই একসঙ্গে গেয়ে ওঠে জাতীয় সঙ্গীত। অয়নরা দেখে দর্শকরা সবাই দাঁড়িয়ে যায়। অয়নরাও দাঁড়ায়, মনে পড়ে বাবার কথা। বাবা সবসময় বলেন-দেশকে ভালবাসবে, দেশ হচ্ছে মা।
‘এই এলাকার কৃতি সন্তান, যারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন এখন তাদেরকে সম্মাননা জানানো হবে’ -তপু ভাইয়ের কন্ঠে ভেসে আসে ঘোষণা। মঞ্চের মাঝখানে সাদা কাপড়ে ঢাকা টেবিলটার উপরে অনেকগুলো ফুল রাখা হয়। শ্যামলদা আর আসাদ ভাই দর্শকের সারিতে এসে ওদেরকে মঞ্চে ডেকে নেয়। তারপর একে একে এলাকার সূর্য্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের আহবান করা হয়। মঞ্চে উঠে আসেন সাত্তার মাষ্টার, হামিদ শেখ, সাঈদ খান, জগানন্দ, তারাপদ, ইসমাইল হাওলাদার, আতিকুল ইসলামসহ বাকি মুক্তিযোদ্ধাগণ। অয়নদের হাতে তুলে দেয়া হয় ফুলের তোড়াগুলো। ওরা একে একে সবার হাতে তুলে দেয় ওগুলো, মুহুর্মুহু করতালিতে ভরে ওঠে বটতলার প্রাঙ্গণ। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানোর মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার দশ বছর পরে দেশকে নতুন করে গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলিয়ান নতুন প্রজন্ম। এই অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা আশেপাশের অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। যে কোন মূল্যে এই গৌরব ও সম্মানকে ধরে রেখে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার শপথ করে।
গতবারের অনুষ্ঠানের কথা অয়নের হাল্কাভাবে মনে আছে। তবে এবারই প্রথম ও দারুণভাবে উপভোগ করছে বিজয় দিবস। অয়ন আজ সবার সামনে ওর বাবার হাতে ফুল তুলে দিয়েছে। বাবার জন্য আজ খুব গর্ব হচ্ছে ওর। বাবার কথা ভাবতে ভাবতেই মঞ্চ থেকে ভেসে আসে গান। একি অপরূপ রূপে মা তোমার হেরিনু পল্লী জননী...... চারুদি, ছোটদি আর শীলা আপু মিলে গাচ্ছে। চারুদির গানের গলাটা বেশ। ছোটদিও ভাল গায়, তবে চারুদির মত না। আজকের গানটা শুনে চারপাশের প্রকৃতি ওর চোখে ভেসে উঠছে। ওদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা, কোটাখালী ব্রিজ, নদীর চরে কাশের বন, ভবানীপুরের পৌষ মেলা। অয়ন মনে মনে ভাবে- আমাদের দেশটা কত সুন্দর! এরপরই চারুদি এককভাবে গেয়ে ওঠে- ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না...’। চারুদির গান শেষ হলে আবার শ্যামলদা, তাপসদা, রঞ্জু ভাই, ছোটদি আর চারুদি একসঙ্গে গায়- পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল... । অয়ন দেখে দর্শকদের মধ্য থেকেও অনেকে ওদের কণ্ঠের সাথে সুর মিলিয়ে গাইতে থাকে।
গান শেষ হলে কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে যায় মঞ্চ, তারপর হঠাতই ভেসে আসে আতিক ভাইয়ের ভরাট কণ্ঠের আবৃতি।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর...
অয়ন দেখে সারা অনুষ্ঠানে, এমনকি দর্শকদের আসনে বসার জায়গাগুলোতে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা, কেবল আতিক ভাইয়ের কণ্ঠটি শোনা যায় বহুদূর পর্যন্ত। অয়ন আজ নতুন করে যেন উপলন্ধি করে দেশকে, দেশের সম্মানকে। আতিক ভাইয়ের কন্ঠের রেশ কাটতে না কাটতেই তপু ভাই কি যেন বলে দর্শকের উদ্দেশ্যে, অয়নরা বুঝতে পারেনা। তারপরই তপু ভাইয়ের গলা থেকে বের হয়ে আসে অন্যরকম এক হাহাকারের সুর...
“কুমড়ো ফুলে ফুলে
নুয়ে পড়েছে লতাটা,
সজনে ডাঁটায়
ভরে গেছে গাছটা,
আর আমি
ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি।
খোকা, তুই কবে আসবি?
কবে ছুটি?”
চিঠিটা তার পকেটে ছিল
ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা......
একাত্তর কিংবা বাহান্ন, ছোট্ট অয়নের কাছে আলাদা কোন বিষয় নয়, শুধু দেশটাকে মনে হতে থাকে অনেক বড়। অয়ন, সুবল কিংবা মিরাজদের কাছে আজকের দিনের অনুভূতি একটু অন্যরকম। এই অনুষ্ঠান দেশের প্রতি ওদের ভালবাসা বাড়িয়ে দিল অনেকগুন।
গানে আবৃতিতে অনেক রাত হয়ে যায়। সবাই বলাবলি করছে এহন শুরু অইবে নাটক। মন্টুমামা অয়নের কাছে এসে জানতে চায়- এহন বাড়ি যাইবা মামা? অয়নের নাটক দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল। মন্টুমামাকে বলতেই মামা বলে- ঠিক আছে, যাওনের ইচ্ছা অইলে আমারে জানাইও, আমি পিছনের লাইনের চেয়ারে আছি।
নাটক শুরু হওয়ার আগেই বাদল অনুষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। বাদলের পিছনেই আরও একটা ছায়ামুর্তি সবার অলক্ষ্যে বের হয়ে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর শুরু হয় নাটক। অয়ন মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকে মঞ্চের দিকে। মিলিটারীরা নিরীহ মানুষকে ধরে পেটাচ্ছে দেখে মন খারাপ হয়। মঞ্চ থেকে ভেসে আসে চিৎকার চেঁচামেচি, দিগ্বিদিক ছুটে চলেছে মানুষজন, পেছনে তাড়া করে ফিরে মিলিটারী......, ছুটতে ছুটতেই মিলিটারির গুলি খেয়ে কিছু মানুষ মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। হঠাৎ দেখে আতিক ভাই গুলিবিদ্ধ হয়, সুবল আঁতকে ওঠে। অয়ন সুবলের হাত শক্ত করে ধরে রাখে। সন্তানের বুকে মাথা রেখে বিলাপ করে কাঁদে এক মা...
কিছুক্ষণ নাটক দেখে অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসে মজনু। বাইরে এসে দেখে ওর সাথের লোকজন কেউ নেই। গিয়াসদের কোথাও দেখতে পায় না। বাদল চলে যাওয়ার আগে অবশ্য ওকে বাড়ি যাবার কথা জিজ্ঞেস করেছিলো। ও ইচ্ছে করেই থেকে গিয়েছিল।
গ্রামের অন্ধকার রাস্তা ধরে বাড়ির পথে একা এগিয়ে চলেছে মজনু। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আজ টর্চটা সাথে নেই। প্রতিদিন বাড়ি থেকে টর্চটা নিয়েই বের হয়। আজ সকালে শহরে গিয়েছিল, ওখান থেকে সরাসরি অনুষ্ঠানে। অন্ধকারকে ওর কখনই ভয় লাগেনি, তবে আজকের গাঢ় অন্ধকারের সাথে যোগ হওয়া হিম শীতল বাতাস হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। শালটাকে ভালমত জড়িয়ে নেয় গায়ে। রমেন সাহার চিতাখোলার পাশ দিয়ে যাবার সময় বাঁশঝাড়ের দিক থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসটা মনে যেন একটু একটু ভয় ধরিয়ে দেয়। মজনু জোর পায়ে হেঁটে পার হয়ে আসে ঐ জায়গাটা। এই পথটা বড় বেশী নির্জন। এটা ওদের বাড়ি যাওয়ার নিজস্ব রাস্তা, লোকজনের আসা যাওয়া একেবারেই কম। বাড়ির কাছাকাছি মরা পুকুরটার পাড়ে আসতেই হঠাৎ পিছনের ঝোপের মধ্যে কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনে পিছনে ফিরে তাকায়। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পায় না। আবার এগিয়ে চলে বাড়ির পথে।
হঠাৎ অতর্কিত আক্রমণে হকচকিয়ে যায় মজনু। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে পড়ে যায়। খুব বলশালী একজন ওর শরীরের উপরে চেপে বসে হাতদুটো আটকে ফেলে, আরেকজন ওর শরীর থেকে শালটি খুলে নিয়ে নাক-মুখের উপর চেপে রাখে বেশ শক্তভাবে। হালকা পাতলা গড়নের মজনু কোনরকম নড়াচড়ার সুযোগই পায় না। শক্ত হাতগুলো সাঁড়াশির মত চেপে ধরে আছে ওর মাথা, মুখমন্ডল। কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পায় ক্রমশ দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। প্রাণপণে চেষ্টা করে নিঃশ্বাস নেবার। ধীরে ধীরে নড়াচড়ার শক্তি লোপ পেতে থাকে। মজনু উপলব্ধি করে- মারা যাচ্ছে ও। বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে করতে উপর দিকে তাকায়, দেখে অন্ধকারের মধ্যে দু’জন মানুষ ওর দিকে ঝুকে আছে। একজনের মুখ কাপড়ে ঢাকা। ধস্তাধস্তির কোন এক ফাঁকে অন্যজনের মুখ থেকে কাপড়ের একপ্রান্ত খুলে পড়েছে, হয়ত টের পায়নি কিংবা ঠিক করার সুযোগ হয়নি। মজনু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অনেকদিনের চেনা মুখটির দিকে, তারপর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আততায়ী দু’জন মৃত্যু নিশ্চিত হবার পর লাশটি ঠেলে ফেলে রাখে মরা পুকুরের পাড়ে। অতঃপর গাঢ় অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
চলবে....
আগের পর্বগুলো দেখতে চাইলে - ধূসর গোধূলিঃ ৩২ - লড়াই - এ ক্লিকান
চলুক সিরিজটা!
দেশের গল্প সব সময় ই সেরা।
এই গল্পটা পড়তে পড়তে ছোট বেলায় ফিরে গেলাম।তখন বিজয় দিবস,স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পাড়ার বিভিন্ন ক্লাবে অনুষ্ঠান করা হতো।অনুষ্ঠানে দেশের গান গুলো কী চমৎকার করে গাইত।বাবার সাথে এরকম অনুষ্ঠান গুলোতে গিয়ে রাত জেগে গান শোনার সেই দিন গুলো যদি কেউ ফিরিয়ে দিত!
চলুক। খুব চমৎকার লাগলো এটুকু।
ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় এই কবিতাটা স্কুলের ১৬ই ডিসেম্বরের প্রোগ্রামে আবৃত্তি করেছিলাম।
মর্মস্পর্শী একটি গল্প। এমন পরিনিয়ত ঘটছে। এমন দেশ দেখার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেননি এদেশের বীরেরা।
মন্তব্য করুন