ইউজার লগইন

ধূসর গোধূলিঃ ৩৪ - সংঘাত

dhusor godhuli-34.jpg
শীতের তীব্রতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ঘন কুয়াসায় ঢেকে থাকে সুর্য্য অনেক বেলা অবধি। রাস্তার দু’পাশের ক্ষেতে শিশিরে ভেজা গাঢ় সবুজ খেসারীর ডগা আর কাঁচা হলুদ সরিষার ফুলগুলোকে অনেক সতেজ লাগে। শীত অয়নের সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। সকালে সদ্য ঝরানো খেজুরের রসের মজাটাই অন্যরকম। সেই সাত সকালে উঠে মন্টুমামা খেজুরের রস নামিয়ে নিয়ে আসে, রান্নায় বসানোর আগে মা কিছুটা কাঁচা রস ওর জন্য রেখে দেয়। মা’র ব্যস্ততা সেই সকাল থেকেই। কাকভোরে উঠে কাজে লেগে পড়ে, প্রতিদিনই কোন না কোন পিঠা তৈরি করে মা।

অয়নের ঘুম ভেঙ্গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই, লেপের ওমের ভিতর থেকে বেরুতে ইচ্ছে করছিল না। অনেকক্ষণ ধরে ছোটদির ডাকাডাকির পর উঠে পড়ল। গরম সোয়েটার গায়ে জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরের পিছনের খোলা জায়গায় এসে দেখে রান্নাবান্নায় ব্যস্ত মা। বাবা, মন্টুমামা আর ছোটদি চুলার পাশে বসে খেজুরের গুড় দিয়ে চিতই পিঠা খাচ্ছে। ওকে দেখে মা বললেন,
-যাও বাজান, হাতমুখ ধুইয়া আস। গরম গরম পিঠা খাইয়া নেও। ঠাণ্ডা হইয়া গ্যালে ভাল লাগবো না।
-মা, আমার খেজুরের রস আছে তো? বকুলের দিকে তাকিয়ে অয়ন মাকে জিজ্ঞেস করে
-দেরী কইরা উঠছো ক্যান, আইজক্যা তোমার রস আমি খাইয়া ফেলাইছি। অয়নকে ক্ষেপাতে বকুল বলে।
-আমার ভাগের রস খাইলে তোর খবর আছে।
সালমা বেগম হাসে। বলে- না রে বাজান, তোমার রস কে খাইবো? আমি আলাদা কইরা রাইখ্যা দিছি। তুমি হাত মুখ ধুইয়া আসো। মা দু’জনের ঝগড়া থামায়।
-যারা কাঁচা রস খাইবো, তারা কিন্তু রসের ফিন্নি পাইবো না। বকুল অয়নকে ক্ষেপাতে আবার বলে
-এই ছোটু, তুমি বেশী কতা কইও না। আমি জানি, মা আমারডা ঠিকই রাইখ্যা দিছে।
অয়নের কথা শুনে সবাই হেসে ওঠে। সালমা বেগম ছেলেকে থামাতে বলে-না, তোমার ফিন্নিও রাখা আছে। আগে রস খাও, পরে দিমুনে।
খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া শেষ করার পর অয়ন দেখে মার হাতে একবাটি খেজুরের রসের ক্ষীর। রাতে রান্না করে রাখা ক্ষীরটুকু শীতে জমে গিয়ে উপরে পুরু সর পড়ে আছে। সন্ধ্যার আগে কাটা খেজুর গাছ থেকে কিছু রসের হাঁড়ি রাতেই নামানো হয়। তারপর রান্না করে রাখা হয় সকালে খাবার জন্য। শীতের সময় এই খাবারটি অয়নের খুব প্রিয়। সাত্তার মাষ্টারেরও খুব পছন্দের।

বিভার অন্তর্ধানের পর আরও দুই মাস কেটে গেছে। প্রথম প্রথম ওদের করুণ পরিণতির জন্য গ্রামের মানুষ দুঃখ প্রকাশ করত। এখন অনেকেই ভুলে গেছে। ভুলতে পারে না মঈনুদ্দীন মৌলভী। বিভার ঘরের জায়গাটুকুর জন্য তার অপেক্ষা এখনও শেষ হয়নি। সে প্রতিদিনই আশায় থাকে মফিজ মিয়া তাকে এই ভিটায় বসত করতে বলবে, কিন্তু এখনও তেমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মৌলভী আজ ভাবে মফিজ মিয়াকে বিষয়টা মনে করিয়ে দিবে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় মফিজ মিয়ার ঘরের দিকে।
আজ দু’দিন ধরে শয্যাশায়ী মফিজ মিয়া। জ্বরে বেশ কাবু হয়ে পড়েছে, কাশির জন্য কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে তার। সামনের বারান্দার চৌকির উপর বসে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে তার একমাত্র মেয়ে জামাই মালেকের দিকে তাকিয়ে আছে। দুদিন ধরে শ্বশুর বাড়িতে আসলেও আজই প্রথম তার সাথে দেখা করতে আসলো মালেক। দীর্ঘদিন ধরে মেয়ে শেফালি বাবার বাড়িতেই পড়ে আছে, শেফালিকে বাড়িতে নিয়ে যাবার কোন উদ্যোগ তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। অথচ শেফালি মারফত টাকার কথা অনেকবারই বলানো হয়েছে। আজ সে জামাইকে ডেকে পাঠিয়েছে। শ্বশুর রেগে আছে বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে তার সামনে থেকে সরে সরে যাওয়ার উপায় খুঁজতে থাকে। শ্বশুরের কাছে এসে বসে, খুব ভক্তি সহকারে কূশলাদি জিজ্ঞেস করে-
-আব্বা, কেমন আছেন?
-ভাল। তা তোমার খবর কি কও তো? এইভাবে আর কয়দিন চলবে?
-আমি একটু সমস্যার মধ্যে আছি আব্বা, আপনে যদি একটু সহযোগিতা করতেন তয় এইডা কাটাইয়া উঠতে পারতাম।
-আর কত? আমার কি জমিদারী আছে? বিয়ার পর থেইক্যা তোমারে তো কম দেইনাই। কয়েকমাস আগে দোকান দিবা কইয়া টাকা নিলা, এহন আবার হুনতাছি গাড়ি কিনবা, আমি তো বারে বারে তোমার এইসব চাহিদা মিটাইতে পারুম না।
-এইবার আর এমনে এমনে দিতে অইব না, আমারে ধার হিসাবে দেন। আমি প্রত্যেক মাসে আপনারে শোধ দিয়া দিমু।
-ধার করলে তোমার বাপ-ভাইগো কাছ থেইক্যা কর। আমার এহন টানাটানি চলতাছে, এই মুহুর্তে আমি তোমারে কোন টাকা দিতে পারুন মা। আর শেফালিরে এইহানে ফালাইয়া রাখছো ক্যান?
-বাবার কাছ থেইক্যাও নিমু, তয় তাতে সবটা অইবোনা। যেমনেই হউক এইবারের মতন আপনারে সাহায্য করতেই অইব, আমি কতা দিতাছি ছয় মাসের মধ্যে আপনার টাকা শোধ দিয়া দিমু।
মফিজ মিয়া আরও কিছু বলতে গিয়ে দেখে মঈনুদ্দীন মৌলভী উঠানের মধ্যে দিয়ে এদিকেই আসছে। মৌলভীকে আসতে দেখে থেমে যায় সে। বাইরের লোকের সামনে আর যাই হোক নিজের মেয়ের জামাইকে ছোট করাটা ঠিক হবে না। মৌলভী এসে পড়ায় মালেক যেন শ্বশুরের কাছ থেকে মুক্তিলাভের সুযোগ পেয়ে যায়। সে বলে
-আব্বা, আমি রাইতে আপনার লগে কতা কমুনে, এহন যাই?
-আচ্ছা যাও, রাইতে তুমি আমার লগে বইবা। বলে জামাইকে চলে যাবার অনুমতি দেয়। তারপর মৌলভীর দিকে অনেকটা বিরক্তি নিয়ে তাকায়। মনে মনে ভাবে, এ আরেক যন্ত্রণা! বউয়ের দিকের মানুষ বলে কিছু বলতেও পারছে না।
ঘরে ঢুকে মফিজ মিয়াকে অসুস্থ দেখে মন খারাপ হয়ে যায় মঈনুদ্দীন মৌলভীর। যে উদ্দেশ্যে সে এসেছিল এই অসুস্থতার মধ্যে ঐ প্রসঙ্গ তোলাটা ভাল দেখায় না। সে মফিজ মিয়ার কূশল জানতে চায়
-মিয়াভাইয়ের শরীর তো দেখি অনেক খারাপ হইয়া গ্যাছে, আপনারে অনেক কাহিল লাগতাছে।
-হ, শরীরটা কয়দিন ধইরা ভাল যাইতেছে না। আপনের কি খবর?
-ভালই আছি। আপনের লগে কিছু কতা আছিল, তয় এহন না, আপনে সুস্থ অইলে কমুনে
-আচ্ছা, ঠিক আছে। শরীরডা ভালো লাগতাছে না। আমি একটু ঘুমামু।
মঈনুদ্দীন মৌলভী চলে গেলে মফিজ মিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। সে জানে মৌলভী তার কাছে কি জন্য এসেছিলো। মফিজ মিয়া উপলব্দি করে ইদানং মৌলভির মোসাহেবী আচরণ তার কাছে যেন অসহ্য লাগছে।

সাত সকালে গাজী বাড়িতে চিৎকার আর কান্নার রোল ভেসে আসে। আশেপাশে বাড়ি থেকে লোকজন ছুটে আসে হারু মেম্বরের বাড়ি। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভিড় বাড়তে থাকে, ধীরে ধীরে ভরে যায় বাড়ির উঠোন। ঘরের সামনের উঠোনে পড়ে আছে মজনুর নিথর দেহ আর সামনের সিঁড়িতে গম্ভীর হয়ে বসে আছে হারু মেম্বর। অন্দরমহল থেকে ভেসে আসা মহিলাদের বিলাপ আর কান্নার রোলে ভারি হয়ে উঠেছে সারা বাড়ি। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে সবারই প্রশ্ন- কি হয়েছিল? অনেকেই বলাবলি করতে থাকে- কাল রাতে অনেকের সাথেই দেখা হয়েছে মজনুর, সবার সাথেই হাসিখুশি ছিল। সুস্থ সবল যুবকটির এই হঠাৎ মৃত্যু অনেকের কাছেই রহস্যজনক লাগে।

গাজীদের গ্রামের অনেকেই পছন্দ করে না। এর কারণ অবশ্য তাদের পারিবারিক পূর্ব ইতিহাস আর হারু মেম্বরের ব্যক্তিগত ইমেজ। মজনু যদিও এর ব্যতিক্রম ছিল না, তবে অতি সম্প্রতি ওর কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হচ্ছিল। বিশেষ করে এলাকার বর্তমান জনপ্রতিনিধি খালেক মেম্বারের ব্যার্থতা আর তার বিরুদ্ধে মজনুর সোচ্চার হওয়ায় প্রতিপক্ষ হিসেবে মজনুকে অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য করে তুলছিল। অনেকটা মন্দের ভাল হিসেবে। আজ এই অকাল মৃত্যু যেন ওকে আরও জনপ্রিয় করে তুলল।

পুকুরের ঘাটে গিয়াসকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করে ওর সাথের লোকজন। সাজু, পলাশ আর হারিস মিলে বোঝায় কিন্তু গিয়াসের একই কথা- এই কাম বাদইল্যা আর ওর ভাইয়ের। কয়েকদিন ধরে খালেক মেম্বার আর বাদলের গতিবিধি ওর কাছে ভাল লাগছিলো না। মজনুকে ও বলেছিল সে কথা। হঠাৎ বাড়ির মূল রাস্তা দিয়ে বাদলকে প্রবেশ করতে দেখে তৎক্ষণাৎ উঠে দাড়ায় গিয়াস। সাজু আর পলাশ মিলে ওকে থামায়। সবাই বোঝায় এই হিসাব আমরা পরেও করতে পারুম, এখন লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সাজুরা দাফনের ব্যবস্থা করতে লেগে যায়। গিয়াস তখনও গুম মেরে বসে থাকে পুকুরের ঘাটে।

ভিড়ের মাঝে হঠাৎ উপস্থিত হয় বাদল। মজনুর লাশের কাছে গিয়ে বিলাপ করে কেঁদে ওঠে। -আমি ক্যান ওরে একলা রাইখ্যা আগে আগে চইলা আইলাম, ক্যান ওরে জোর কইরা নিয়া আইলাম না। বাদলকে দেখে সামসু খন্দকার এগিয়ে এসে বলে, এমন কইরা কান্দিস না বাদল, ওর আত্মা কষ্ট পাইবো। মিয়াভাইয়ের মনের অবস্থা ঠিক নাই, আমগোর এহন অনেক কাম। দাফন কাফনের ব্যবস্থা করতে অইব।

এতক্ষণ চুপচাপ আর গম্ভীর হারু মেম্বর হঠাৎ গর্জে ওঠে। -ঐ হারামজাদারে আমার ভাইয়ের লাশের কাছেত্তন সইরা যাইতে ক সবাই।
বাদল এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকলেও হারু মেম্বরের এমন রুদ্রমুর্তি দেখে কিছুটা ভরকে যায়। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে হারু মেম্বরের কাছে এসে বলে- মিয়াভাই, আপনে আমারে ভুল বুঝতাছেন। মাঝে মাঝে আমগো মধ্যে মন কষাকষি অইলেও মজনু আছিল আমার প্রাণের দোস্ত। কাইলও আমরা একলগে অনুষ্ঠান দ্যাখছি, আমি বাড়ি আহনের সময় ওরে সাধছিলাম কিন্তু ও কইলো আরও পরে বাড়ি আইবো। তাই আমি আগেই চইলা আইছিলাম। যদি বুঝতাম এমন অইবো তাইলে কি আর ওরে ফালাইয়া আইতাম? বলে আবার কেঁদে ওঠে বাদল।
-ভাইয়ের মতন অভিনয় তো ভালই শিখছোস। তোরা যে কালসাপ হেইডা আমার থেইক্যা ভাল আর কেডা জানে? মনে রাহিস, আমি তোগো ছাড়ুম না, তোর ভাইরেও কইয়া দিস। হেয় আমারে ভালই চিনে, তুইও চিনবি আস্তে আস্তে। হারু মেম্বর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাদলের দিকে।
সে বেশ বুঝতে পারে তার ভাই এমনি এমনি মারা যায় নাই, এর পিছনে কার ষড়যন্ত্র বুঝতে বাকি থাকে না। প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারবে না, এটা বুঝতে পেরে চুপ করে থাকে। কেবল মনে মনে বলে-সময় আমারও আসবে।

সবাই বুঝতে পারে বাদলের উপস্থিতি পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে। তাই লোকজন ওকে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য বলে। বাদল চলে যাবার সময়ে দেখে গিয়াস পুকুরঘাটে বসে আছে। কিছু বলার জন্য ঘাটের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে দেখে, ওর দিকে সোজা তাকিয়ে আছে গিয়াস। সে চোখে প্রহিংসার আগুন যেন দাউদাউ করে জ্বলছে।

চলবে....

আগের পর্বগুলো দেখতে চাইলে - ধূসর গোধূলিঃ ৩৩ - চেতনায় একাত্তর - এ ক্লিকান

পোস্টটি ১৩ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

সামছা আকিদা জাহান's picture


ভাল লাগলো।

আরাফাত শান্ত's picture


পড়ছি ভাইয়া!

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture

নিজের সম্পর্কে

খুব সাধারণ মানুষ। ভালবাসি দেশ, দেশের মানুষ। ঘৃণা করি কপটতা, মিথ্যাচার আর অবশ্যই অবশ্যই রাজাকারদের। স্বপ্ন দেখি নতুন দিনের, একটি সন্ত্রাসমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের।