ধূসর গোধূলিঃ ৩৫ - হঠাৎ বৃষ্টি
সন্ধ্যার ঠিক পর পরই খেলার পাট চুকিয়ে ঘরে ফেরে সুবল। পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে কেউ কোথাও নেই। মাঝখানের বড় ঘরের টেবিলের উপর টিমটিম করে জ্বলছে কুপিবাতি। সুবল সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বাহিরের দিকে চোখ পড়তেই দেখে উঠানের দক্ষিণ প্রান্তে খেজুর গাছটার নিচে তাফালে খেজুরের গুড় জ্বাল হচ্ছে। মা, কাকু, কাকীমা উনুনের কাছে বসে আছে আর গোপালদা খরকুটো এগিয়ে দিচ্ছে। সুবল সোয়েটারটা গাঁয়ে জড়িয়ে উঠানে নেমে আসে। তাফালের আগুনের আলোয় উঠানের অনেকটাই আলোকিত। সুবল পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে কাকার গলা জড়িয়ে ধরে। তারাপদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, প্রিয় ছোট ভাতিজাকে দেখে দু’হাত ধরে সামনে নিয়ে আসে। কাকুর কোলের মধ্যে ডুবে যেতেই সুবল হারিয়ে যায় ওমের রাজ্যে। তাফালের চারপাশ থেকে উঠে আসা টকটকে লাল আগুনের শিখা থেকে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশে।
হঠাৎ টুং টাং শব্দ শুনে কাকুর কোলের মধ্য থেকে গলা উচু করে তাকিয়ে দেখে ছোটদি একটি প্লেটে করে মুড়ি আর চা নিয়ে এসেছে। চারুর উদ্দেশে ও বলে- খুব ক্ষিধা লাগছে, ছোটদি আমারে আগে দে। তারাপদ হেসে উঠে বলে- চারু মা, ওরেই আগে দে, ও তো আমগো মুরুব্বী। ধোয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তাফালের উল্টাদিকে বসা মায়ের দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সুবল। গনগনে আগুনের আভায় মায়ের ফর্সা রঙটা এখন আরও উজ্জ্বল হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে, যেন সাক্ষাৎ দুর্গা।
ইদানিং প্রায়ই বিষন্ন হয়ে পড়ে শিউলি। সারাদিনের বিরক্তিকর একঘেয়েমি কাটাতে শিউলির সঙ্গী বই আর রেডিও। দুপুরের পর এটা নিয়েই কাটে ওর সারাটা বিকেল। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে। কখনও বই পড়ে কিংবা গান শুনে। মনে পড়ে গাঁয়ের সবুজ শ্যামল পথে ছুটে বেড়ানো, মাটির সোঁদা গন্ধ। মন উদাস হয়। নাহিদকে কতদিন বলেছে কোন একটা স্কুলে চাকরীর ব্যবস্থা করে দিতে। ওটা হলেও বেঁচে যেত। রেডিওতে একটানা গান বেজে চলে। একটা শেষ হয়ে আরেকটা। রেডিও শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুম থেকে উঠে দেখে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাইরের খোলা মাঠে আঁধার নেমে এসেছে। উঠে আলো জ্বালায়। আগে নাহিদ সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরতো, ইদানীং ফিরতে বেশ রাত হয়। নাহিদ না ফেরা পর্যন্ত চলে ওর দীর্ঘ অপেক্ষা, তারপর আবার একাকীত্ব। শিউলি মনে মনে ভাবে- এভাবেই সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত আসবে। ওর একাকীত্বের সঙ্গী হবার জন্য কেউ নেই, এটাই তো হবার। এই একা থাকাটা বড্ড বেশি কষ্টকর, মাঝে মাঝে খুব কান্না পায় শিউলির।
প্রমোশনের পর থেকেই কাজের চাপ বেড়ে গেছে নাহিদের। বেশ কিছুদিন ধরে প্রতিদিন অফিস থেকে বেরুতে নয়টা বেজে যায়। ও বের হবার সময় প্রতিদিনই লক্ষ্য করে অফিস প্রায় ফাঁকা। বাসায় ফিরে শিউলির মনমরা চেহারাটা দেখে খুব খারাপই লাগে। আজ ভেবেছিলো একটু আগেভাগেই ফিরবে, কিন্তু অফিস থেকে বেরুতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। একটা রিকশা নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। নতুন বাজারের কাছে আসতেই মনে হয় অনেকদিন শিউলির জন্য কিছু কেনা হয় না। গত একমাস অতিরিক্ত কাজ করার জন্য বাড়তি কিছু টাকা হাতে এসেছে আজ। আর কিছু না ভেবে মার্কেটে ঢুকে পড়ে। জড়োয়া ভুবন থেকে একটা আংটি কিনে ফেলে।
বাইরে নক শুনে এগিয়ে যায় শিউলি। দরজা খুলতেই দেখে ওপাশে দাঁড়িয়ে নাহিদ। কিছু না বলে শোবার ঘরের দিকে চলে আসে শিউলি। নাহিদও পিছন পিছন আসে, শিউলিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলে,
-মহারাণীর রাগের পরিমাণটা মনে হয় অনেক বেশী!
শিউলি অনেকটা নিরসভাবেই বলে-আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরলে!
-আজ একটু আগেই কাজ শেষ হয়ে গেল, কেন আমি কি কখনও তাড়াতাড়ি ফিরি না?
-ইদানীং অফিসই তোমার সব, বাসাটা তো রাত্রি যাপনের স্থান মাত্র। শিউলির কণ্ঠে তাচ্ছিল্য।
নাহিদ বোঝে গত একমাস ধরে ওকে সময় দিতে পারে না, শিউলির একা একা মন খারাপ হয়। ও বলে,
-আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপর কাজের ঝামেলা একদম কমে যাবে।
-ছাই কমবে! আমার কথা চিন্তা করে তোমার কি হবে? তুমি থাক তোমার অফিস নিয়ে। শিউলি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে।
শিউলির হাতটা কাছে টেনে নেয় নাহিদ, আংটিটা পড়িয়ে দেয় অনামিকায়। শিউলি তাকিয়ে দেখে।
-কি দরকার ছিল এতগুলো টাকা খরচ করার?
-আমার ইচ্ছা। বলে নাহিদ ওর হাতটা নিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়ায়। শিউলির তবুও মান ভাঙে না। কপট অভিমানে বলে,
-থাক, আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না।
শিউলির কাছে এগিয়ে আসে নাহিদ। খুব কাছে। শিউলির কিছুক্ষণ রাগ, অভিমান; অতঃপর বাঁধ ভেঙ্গে যায়। মিশে যায় নাহিদের মাঝে। ভিতরে ভিতরে অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায়, কেঁপে ওঠে। নাহিদের মধ্যেও বিদ্যুৎ চমকায়। ঘুমন্ত শরীর জেগে ওঠে এক অদৃশ্য, তীব্র আকর্ষণে। দুর্বোধ্য ভাষায় রচিত হয় অনন্য কাব্যগাঁথা। শিউলি লজ্জা পায়, লাল হয়। তারপর মুখ লুকায় নাহিদের বুকে।
নির্বাচনী উত্তাপে ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে শ্যামলপুর-উজানপুর জনপদ। এবার কে কে দাঁড়াবে নির্বাচনে এ নিয়ে মানুষের মাঝে বেশ আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। খালেক মেম্বরের গতবারের ব্যর্থতায় তার বিকল্প একজন ভাল প্রার্থীর প্রত্যাশা বাড়তে থাকে মানুষের মধ্যে আর চেয়ারম্যান হিসেবে বশিরুল্লাহ পাটোয়ারী গ্রামবাসীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল বেশীর ভাগ সময়। নির্বাচনে ভাল প্রার্থী না আসায় এখনও এদের উপর নির্ভরশীল হয়ে আছে গ্রামবাসী।
স্বাধীনতার পর এই প্রথম নির্বাচনমুখী হল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি। এতদিন নিজেদের দূরে রেখে দেখেছে শকুন হায়েনারা ছিঁড়ে খাচ্ছে দেশটাকে। তাই চুপ করে না থেকে রুখে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে এই উদ্যোগ। সাইদ খানের বাড়িতে আজ প্রথম মিটিং বসেছে। আসছে নির্বাচনে কিভাবে নিজেদের সংঘটিত করবে তাই নিয়ে আলোচনা চলছে। ইতিমধ্যে অনেকে জেনে গেছে সাঈদ খান চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াচ্ছে তবে আতিকের বিষয়ে এখনো কেউ জানে না।
-মনোনয়ন সাবমিশন শুরু হইবে আগামী পরশু থেকে। আতিক বলে
-শেষদিন কবে? সাইদ খান জানতে চায়
-আগামী পাঁচ তারিখ। বলে ইসমাইল মোল্লা
-তাইলে আমরা পাঁচ তারিখেই জমা দিমু। সাইদ খান বলে
-হুনতাছি হারু গাজী এইবারও খাড়াইবো। কাজেম বলে
-ও খাড়াইলেই কি আর না খাড়াইলেই কি? মরা গরু নিয়া চিন্তার কিছু নাই। ওরে কেডা ভোট দিবো? আতিক এমনিই পাশ কইরা যাইবো। হামিদ খান বলে।
-পাটোয়ারীরে নিয়াও চিন্তার কিছু নাই। জানি গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষ আমগো লগে থাকবো তয় আমগোও কাম করতে অইবো। ক্লাবের পোলাপাইনগো কামে লাগাইতে অইবো। সাত্তার মাষ্টার বলে
-তুমি ঠিকই কইছো মাষ্টার, ওরা মাঠে থাকলে আমাদের কাজটা অনেক সহজ অইবো। বলে ওঠে সাঈদ খান।
-রঞ্জু, তুই ক্লাবের সবাইরে আমগো লগে আইজ সন্ধ্যায় দেহা করতে কইবি। ছেলের উদ্দেশ্যে বলে সাঈদ খান
-ঠিক আছে বাবা। সন্ধ্যায় অগোরে মাষ্টার চাচার দোকানের সামনে আইতে কমুনে
সন্ধ্যার পর গদিতে বসে আছে হারু মেম্বর। মজনুর মৃত্যুর পর ইদানিং বেশ গম্ভীর হয়ে পড়েছে। মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে। খালেক-বাদলকে একটা শিক্ষা না দেয়া পর্যন্ত মনে শান্তি আসবে না। সে বেশ বুঝতে পারে মজনুকে সরিয়ে দিয়ে পথের কাঁটা দূর করেছে খালেক। নির্বাচনে ওকে এত সহজে জিততে দেয়া যাবে না। সে জানে গ্রামে তার নিজের বেশ বদনাম, কিন্তু খালেককেও লোকজন যে পছন্দ করে না এটাও সে বোঝে। হারু মেম্বর ঠিক করে এবার সে আবার মেম্বর পদে দাঁড়াবে। দরকার হলে টাকা দিয়ে হলেও ওকে হারানো চাই। গদিতে বসে হারু মেম্বর ছেলের উদ্দেশ্যে বলে,
-বাইরে বাদাইম্যার মতন আর কতকাল ঘুরবি? বাজারে আইসা আমার লগে তো একটু হাত লাগাইতে পারস।
-আমি তো এইহানে বইতে চাইছি, তুমি তো বইতে দেও নাই
ধমকে ওঠে হারু মেম্বর। -ক্যান গদিতে বইতে দেইনাই বোঝোনা? গদিতে বইলেই তো ট্যাকা লুঙ্গিতে গোঁজো। এইহানে তোমার বহনের কাম নাই। এহন মজনু নাই, স-মিলডা দেহাশুনা কর।
গিয়াস মাথা নিচু করে রাখে। -আইচ্ছা ঠিক আছে, কাইল থেইক্যা স-মিলে বমুনে।
-খালেইক্যা ছাড়া ভোটে আর কেডা কেডা খাড়াইবো, খবর নে। আমি এইবার খাড়ামু।
-আর কারো নাম তো হুনি নাই। তুমি খাড়াইয়া কোন লাভ অইবো? অইতে তো পারবা না। গিয়াস বলে
হারু মেম্বর ক্ষেপে যায়। বলে- অইতে পারুম না আগেই ক্যান মনে অইলো তোর? য্যামনেই হউক খালেইক্যারে আটকাইতে অইবো। অয় আমার ভাইরে মাইরা পথ পরিষ্কার করতে চাইছে, এত সহজে ওরে ছাইড়া দেওন যাইবো না। এহন থেইক্যাই কাম শুরু করতে অইবো। সব পোলাপাইনগুলারে কামে লাগা। বাপের রাগ দেখে দমে যায় গিয়াস।
-আইচ্ছা ঠিক আছে, আমি সবাইরে কামে লাগামুনে কিন্তু সময় তো বেশী নাই।
-অসুবিধা নাই। সময় যা আছে তাতেই অইবো। তুই অগোরে কামে লাগা, লোকজনরে আমগো পক্ষে নিয়া আইতে অইবো। টাকা যা লাগে আমি দিমু। আর একটা কাম কর- সামসু খোনকাররে আইজই আমার লগে দেখা করতে কইবি।
গিয়াস বাপের চালের মিল থেকে বের হয়ে স-মিলের দিকে এগিয়ে চলে। সামনে তাকিয়ে দেখে নদীর পাড়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছে খালেক আর বাদল। মনে আবার প্রতিশোধের স্পৃহা জেগে ওঠে। নিজেই নিজেকে বলে-য্যামনেই হউক এই হারামিগুলারে হারাইতে অইবো।
চলবে.....
আগের পর্বগুলো দেখতে চাইলে - ধূসর গোধূলিঃ ৩৪ - সংঘাত - এ ক্লিকান
মন্তব্য করুন