ধূসর গোধূলিঃ ৩৬ - ফন্দি
মফিজ মিয়া মুখে যতই বলুক মেয়েজামাইকে টাকা দেবে না, মেয়ে শেফালির দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত আর পণ রক্ষা হয়না। একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে টাকার ব্যবস্থা করে দেয়। শেফালি চলে যায় শ্বশুরবাড়ী। যাবার সময় জামাই গদগদ ভাব নিয়ে শ্বশুরের পা ছুঁয়ে সালাম করে।
-আব্বা, আমগো লইগা দোয়া কইরেন।
মফিজ মিয়া সবই বোঝে। মনে মনে ভাবে মেয়েটা তবু সুখে থাক।
সারাদিন পর সাজু বাড়িতে ঢোকে। মফিজ মিয়ার রক্ত ওঠে মাথায়। খেঁকিয়ে ওঠে সে। হারামজাদা! সারাদিন কই থাহস? বাপের হোডেলে খাস আর টো টো কইরা ঘুইরা বেড়াস?
সাজু কোন উত্তর দেয় না। নিরবে ঘরে ঢুকে যায়। মফিজ মিয়ার রাগ আরও চড়ে যায়
-কি রে? কি কই কানে ঢোকে না?
-কাম আছিলো। সোজাসাপ্টা উত্তর দেয় সাজু।
-সারাদিন বাইরে কি কাম তোর? ঘোড়ার ঘাস কাটতে গেছিলি? দুই পয়সা আয়ের তো মুরোদ নাই।
বাপকে কিছুই বলে না, মার উদ্দেশ্যে বলে- ওনারে চিল্লাইতে মানা কর। সারাদিন পর ঘরে আইসা এত চিল্লাচিল্লি ভাল লাগে না।
-ওরে কইবা কাইল থেইক্যা আমার লগে তহসিল অফিসে যাইতে। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে মফিজ মিয়া।
-আমারে কন ক্যান, নিজের পোলারে কইতে পারেন না?
-পোলা তো আমার না, তোমার। তুমি অরে লাই দিয়া মাথায় তুলছো।
-সাজু, তোর বাপ কি কয় হুনস না? ছেলের উপর রাগ ঝাড়ে পেয়ারা বেগম।
-ওনারে কইয়া দাও আমি ঐ কাম করুম না। আমারে টাকা দিতে কও, আমি ব্যবসা করুম।
-টাকা কি গাছে ধরে? চাইলেই পাওয়া যায়। আমি এহন কোন টাকা দিতে পারুম না। তুই কাইল থেইক্যা আমার লগে শহরে তহসিল অফিসে যাবি।
-মা তোমারে না আগেই কইছি, আমি ঐ দালালী কাম করুম না। ওনারে কইয়া দাও টাকা দিলে দিবো, নইলে যেন চিল্লাচিল্লি না করে। আমার ব্যবস্থা আমি নিজেই করুম।
মফিজ মিয়া নিজেকে আর সামলাতে পারে না। ছেলেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে।
-জুতাইয়া ঘর থেইক্যা বাইর কইরা দিমু হারামজাদা।
সাজু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ঘর থেকে নেমে যায়, হনহন করে হেঁটে সোজা বেরিয়ে যায় বাড়ির বাইরে।
সাজু বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে মফিজ মিয়া ঘরের সিঁড়িতে অনেকক্ষণ গুম মেরে বসে থাকে। বিকেলের আলো কমে আসে, একটু পরই সন্ধ্যা নেমে আসবে। মফিজ মিয়া সিঁড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। পা বাড়ায় মসজিদের দিকে। দীঘির পাড়ের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলার মুহুর্তে বিভার পরিত্যাক্ত ঘরটির দিকে চোখ পড়ে। ছনের চালাগুলো ভেঙ্গে গেছে, আগাছার জঙ্গলে ভরে আছে চারপাশ। এই অল্প সময়ের মধ্যেই জায়গাটা কেমন বদলে গেছে। এ পথ দিয়ে সে প্রতিদিন আসা যাওয়া করে কিন্তু আজই প্রথম বিভার কথা তার খুব মনে পড়ছে। তার হঠাৎ মনে হয় ওর প্রতি বড় অন্যায় করা হয়েছে। একমাত্র ভাইয়ের মেয়েটির জীবনের করুণ পরিনতির জন্য সে-ই দায়ী। স্ত্রীর কথামত কাদের জন্য এতকিছু করছে সে? আজ খুব আফসোস হয়, ছেলেগুলো একটাও মানুষ হল না। যাদের জন্য একমাত্র ভাইয়ের মেয়েটাকে ঠকিয়ে তার সম্পত্তি হাত করলো আজ সেই ছেলেরাই তার অবাধ্য!
স-মিলের অফিস ঘরে হিসাব নিয়ে ব্যস্ত খালেক তালুকদার। আজ নমিনেশন সাবমিট করে আসার পর থেকে বেশ খোশমেজাজে আছে সে। অনেকদিন থেকে এই দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল খালেক। এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত। মজনু না থাকায় এখন তাকে আর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হবে না। তার প্রতিদ্বন্দ্বী একমাত্র হারু গাজী, যাকে সে গতবার বিপুল ভোটে হারিয়েছিল। এবারও সে আত্মবিশ্বাসী, হারু তার সাথে পেরে উঠবে না। দূর থেকে বাদলকে হস্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে হিসাবের খাতা বন্ধ করে ভাইয়ের অপেক্ষায় বসে থাকে।
-তুমি ঠিকই কইছো ভাই, খোনকাররা হাড়ে হারামি। খালেকের উদ্দেশ্যে বলে সে। দেখেই বোঝা যায় মেজাজ খিঁচড়ে আছে বাদলের।
-ক্যান, কি অইছে আবার?
-তুমি জান সামসু খোনকার নমিনেশন সাবমিট করছে?
কথাটা কানে যেতেই হঠাৎ চুপসে যায় খালেক। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে- এইডা হারু গাজীর কোন চাল না তো? ভাল কইরা খোঁজ নে।
-অইতেও পারে। খোনকারগো বিশ্বাস করন যায়না। সামসু অফিস থেইক্যা বাইর হওনের সময় আমারে দেইখ্যাও না দেখার ভান কইরা চইলা গ্যালো!
একটু আগের অনুভূতি উবে যায় খালেকের মন থেকে। সে ভাবে- হারু গাজী পরীক্ষিত প্রতিদ্বন্দ্বী, তাকে হারাতে পারবে এই আত্মবিশ্বাস আছে। কিন্তু সামসু খোনকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কেমন হবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এই মুহুর্তে গ্রামে তার নিজের অবস্থান তেমন ভাল নয়।
ইতিমধ্যে বাজারে খবর রটে গেছে এবার মেম্বার পদে হারু-খালেকদের সাথে আরও একটি নাম যোগ হয়েছে। করিম লস্কর বলে- খেলা জমবে এবার। কেউ কেউ বলে ওঠে- হারু-খালেক সহজে পার পাইবো না। কয়েকজন আবার বলে, সামসুরে ভোট দিবো কেডা?
এদের মাঝেই কিছু মানুষ থাকে যারা এই আলোচনায় কোন উৎসাহ পায় না। তারা জানে, হারু-খালেক-সামসু কেউই তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রার্থী নয়। এলাকার উন্নয়ন কিংবা মানুষের ভালর জন্য এরা নির্বাচনে আসেনি, এসেছে কেবলমাত্র নিজেদের ভবিষ্যৎ গোছাতে।
সামসু বাজারে ঢুকতেই লোকজন ঘিরে ধরে। করিম লস্কর এগিয়ে এসে হাসতে হাসতে বলে,
-খোনকার মিষ্টি খাওয়াও, নইলে ভোট দিমু না।
সাথে সাথে আরও অনেকে কণ্ঠ মিলায়।
-এহনই কি? সামনে তো অনেক সময় পইরা আছে। খাওয়ামুনে।
-পরে বইলা পার পাবা না খোনকার, খুশির খবর গরম থাকতে থাকতেই মিষ্টিমুখ করাইতে অয়।
সামসু দেখে- এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। আর শুরুতে মানুষজনকে সাথে না রাখলে কাজের সময় এদের কাছে পাওয়া যাবে না। সে সবাইকে নিয়ে হরিপদর দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। ধীরে ধীরে দলটা ভারী হয়। সামসু দেখে কিছুক্ষণের মধ্যেই দোকানের অর্ধেক ভরে গেছে। সবার টেবিলে মিষ্টি দিতে বলে সে।
মিষ্টি খেতে খেতে কিছু মানুষ সামসুর গুণগান করে। সামসু বোঝে এদের মধ্যে অনেকেই তাকে ভোট দিবে না। লোকজন ভোট দিক বা না দিক তার কিছুই আসে যায় না। নির্বাচিত হবার জন্য তো দাড়াঁয়নি। নির্বাচন করে টাকা নষ্ট করার মানুষ সে নয়। মনে মনে ভাবে, আজকেই এতগুলো টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যাবে, হারু মেম্বর সব টাকা দিবে তো !
চলবে.....
আগের পর্বগুলো দেখতে চাইলে - ধূসর গোধূলিঃ ৩৫ - হঠাৎ বৃষ্টি - এ ক্লিকান
প্রথম দিকের সংলাপগুলো কেমন যেন সিনেমাটিক। গল্পের প্লট ভালো লাগল।
ভাল। আরও লিখুন আরও ভাল হবে।
মন্তব্য করুন