ইউজার লগইন

বিষাদ গুচ্ছ টব (১)

বয়স তার ষোল, যদিও মায়ের হাত বাদামি পনেরোকে স্বচ্ছ তুতে রঙে ঢেকে নিয়ে আসে সকালের গোড়ায়, গভীরে সে আজও আকন্ঠ বাদামি। যে বাবা স্বপ্নে দেখেছিলো এক ফুটফুটে মেয়ের, স্বপ্ন দেখেই ছুটি নিয়ে বাড়ি ফেরার দিনে, ট্রেনে উঠার আগে মুন্সী বাজার ঘুরতে ঘুরতে সেই বাবার মনে ধরে মিহি বাদামি যেন ফুটফুটে মেয়ের গায়ের রঙ।তখনো কমলালেবুর ন্যায় পৃথিবীটা জানেনি এই বাবার কোনদিন দেখা হবে না এক বাদাম রঙা মুখ, কোনদিন কেনা হবে না মেয়ের জন্য শখের মাটির পুতুল, বাদাম রঙা সেলোয়ার কামিজ, কলাপাতা রঙের চুড়ি, বড়োবেলার প্রথম শাড়ি।

মেয়েরও আজ বয়স ষোল। শেষ বাজারের স্মৃতি নিয়ে স্থবির পড়ে থাকা পুরনো বাদামি আর দু’দিনের নতুন তুতে রঙে এক হয় তার এগারোটা শাড়ি, পাঁচ নেপথিনের গুটি, কাপড়ের ভাঁজে নাড়ুর বয়াম, নয়টা ব্লাউজ যার থেকে চুরি যাবে এক কী দুটো, সবুজ পেটিকোটের ফোকরে ঢোকানো দুশো টাকা, আরো কিছু দরকারী, প্রিয় কিছু। অন্য কোথাও তখন হয়তো বাদামি অথবা তুঁতে নয়, স্বচ্ছ খয়েরি, সবুজ কিংবা লালচে রঙে হয়তো মুড়ির বয়াম, আমের আচার, কুরআন শরীফ, একটা কাঁসার থালা, কোথাও হয়তো ছোট্ট প্রতিমা। হয়তো শাড়ির গণনায় ভুল হবে, ব্র্যাশিয়ারের মাপ এদিক ওদিক হয়ে ছয়টা নারীর গল্প হবে। এইসব তফাতের মধ্যে থেকে যাবে প্রগাঢ় এক মিল-বাড়ির জন্য ভীষণ মন খারাপ করা।

জোর করে চাপিয়ে দেয়া সাহস আর এই ভীষণ রকম মন খারাপ নিয়ে অনেকটা কিশোরী আর কিছুটা তরুণীর ছয় ছাতা আর ছয় অচেনা গল্প এসে দাঁড়াবে কামরুন্নাহার হলের গেটে। হল সুপার শাহীনুর আক্তারের রুম পর্যন্ত ছায়ার মতো সঙ্গ দেবে বৃষ্টি, কাঁদা, বাবা, মামা, বড়ো ভাই, বড় আপার বর। এক ছাতা অন্য ছাতার মুখোমুখি/ পাশাপাশি হয়ে বাইরের বারান্দায় একটা কোমল দৃশ্য হবে, জোহরাই কাঁদা-পানি ঝাড়-পোছ করবে ভেবে হলের দারোয়ান এবং বউ পাগল করিম ভাইয়ের গজর গজর চলবে, মায়েরা তখন তুঁতে, খয়েরি, সবুজ অথবা লালচে ট্রাঙ্কে বয়াম হবে, আচার হবে আর মেয়েরা হবে উজ্জ্বল আকাশের স্বাধীন অথচ মেঘলা পাখি।

হল সুপারের অফিস পেরিয়ে যারা এগিয়ে যাবে আর যারা পেছনে রয়ে যাবে তারা যেন খুলে দেবে এক রূপকথা- প্রিয় রাজকন্যাকে সেই-ই দূরের প্রাসাদে রেখে ফিরে যাচ্ছেন বিষণ্ণ রাজেন্দ্র। হল সুপার যদিও ততোটা ড্রাগন নয় তবু তাকে মধ্যবর্তীতে রেখে বিচ্ছেদের রাগিনী ছুঁয়ে যাবে ছাতায় ছাতায়, মানুষের মনে। সুপারের অফিস থেকে ১০৭ নম্বর রুমে যেতে মেয়ের যতখানি ভিজতে হবে, ভিজে আবার জ্বর বাঁধাবে, ছোটবেলা থেকেই ঠাণ্ডা একদম সহ্য হয় না –এসব ভাবনার ভার বইতে বইতে মেয়ের কথায় ছাতা নিয়ে ফেরা এক বাবা মন খারাপ করবেন। সেই বাবার তখন মনে পরবে পনেরো বছর সাত মাস আগের এক উজ্জ্বল দিন, মহানগর প্রভাতী, স্যুট-টাই পড়া ভীষণ সুদর্শন এক লোকের কোলে তোয়ালে জড়ানো বড়ো ফুটফুটে এক শিশু মুখ।

অবিরাম কান্নায় বেসামাল বাবার হতাশ মুখ দেখে শাহ পরাণ কিংবা ছাতা মাথায় ফেরা বাবার ভেতরে জন্ম হবে ‘আহারে, আহারে’। সমস্যা আপনার স্ত্রীর নয়, আপনার-ই ফল নেই- আশা ছেড়ে দেয়া ডাক্তাররা যার বাবা হতে চাওয়ার ইচ্ছেকে দুমড়ে-মুচড়ে শেষ করে, যে সংসারে দিন আসে, রাতে আসে, সন্তান না থাকার কষ্ট আসে সেই বাবা হতে চাওয়া মনে হয়তো অনায়াসেই জন্ম নেয়ে আহারে, আহারে। তাই ডিসি অফিসের ড্রাইভার শাহ পরাণ পঁচিশের মধ্যে একজন হয়ে বলে উঠেন- আমার কোলে দিন স্যার। শাহ পরাণ নিজে বাবা হতে পারেনি। মা মারা যাওয়ার পরে ছোট ভাই কোলে নিয়ে ছাগল বাঁধতে বাঁধতে, ছেলেদের ডাঙ্গুলি খেলার সামনে ভাইকে কোলে নিয়ে দুই-একবার থামতে থামতে, ভাত খাইয়ে দিতে দিতে, বউকে লুকিয়ে পরীক্ষার ফি পাঠাতে পাঠাতে নিজের অজান্তেই বাবা হয়ে উঠেছিলেন। আর তাই হয়তো বাবা না হয়েও বাবা হওয়া শাহ পরাণ কোলে নিতেই মেয়েটা চুপ হয়ে যায়।

আপনার বোধহয় অভ্যাস নাই, বাচ্চার মা কই? – এই প্রশ্ন আরো এক ইতিহাসের মুখোমুখি করে। অফিসের কাজে লীলাছড়ি শহরে যাওয়া, একজন কনট্রাকটরের সাথে পরিচয়, তারপর কোন এক শুক্রবারের দাওয়াতে তাঁর ছোট মেয়ে জাকিয়াকে দেখে এবং জাকিয়ার হাতের খাবার খেয়ে সুদর্শন মানুষটার মনের কোথাও যেন গাঢ় এক মুগ্ধতা তৈরি হয়। এই মুগ্ধতা রূপ নেয় বিয়ে, সংসার, কন্যা সন্তান এবং অনেক কিছু ভুলে যাওয়ায়। তবে হঠাৎ বৈশাখী ঝড়ের মতো একদিন আবির্ভাব হয় গ্রামের বাড়িতে থাকা বড় বৌয়ের। অনেক মাস না পাওয়া খোঁজ তাকে ঝড় বানায়, ঝড়ের মাঝখানে স্থানান্তর করে। এতদিনের জানা ব্যাচেলার অফিসারের জোড়া বউ সমস্যায় পাড়ার মুরব্বী কিংবা পরিচিতরা বসে এই সিদ্ধান্তই নেন ছোট বউ জাকিয়াকেই ফিরে যাওয়া উচিত।

আইন কিংবা পাড়ার‍ বৈঠকী সিদ্ধান্তের কাছে জাকিয়ার বোকামী, ঠকে যাওয়া বড়োই ঠুনকো তাই জাকিয়া ফিরে চলেন, একবার হলেও বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ে দিতে মেয়েকে বাবার কাছে রেখে ফিরে চলেন ভাইয়েরা, একবার হলেও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে বড় বৌ আসন পেতে বসেন, আর সুদর্শন বাবা চলেন মেয়েকে দাদীর কাছে রাখতে। যেরকম তকতকে করে বলা হলো, সুদর্শন বাবার ইতিহাস বলাটা অবশ্য সেরকম ছিল না। সেখানে ছিল অসহায়ত্ব, ভুল করার তাপ, ট্রেনের শব্দ, একটা ভিক্ষুকের করুণ আকুতি, বাবুটার চুপ ঘুম, কিছু গোঙানী, বিষাদ বিকেল, শাহ পরাণের বুকে জন্ম নেওয়া ক্রমাগত আহারে। এই ইতিহাসের সবথেকে ঠকে যাওয়া মুখ, সবার কাছে বোঝা মনে হওয়া নরম মুখটা বুকে চেপে হঠাৎ ঘোরে কিংবা স্থির সিদ্ধান্তে কিংবা কী এক অধিকারবোধে বাবা না হয়েও বাবা হওয়া মানুষটা আচমকা বলে উঠেন- আমারে দেন স্যার। ডাক্তার বলে দিয়েছে কোনদিন আমার সন্তান হবে না। দেবেন আমারে?

__________
একটা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করে লিখতে লিখতে যেখানে থেমে গিয়েছিলাম, যেখানে থেমে আছি

পোস্টটি ১৪ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

অতিথি's picture


ভালো কথা

তানবীরা's picture


সাথে আছি, পড়ছি

মীর's picture


যথারীতি অসাধারণ। পরের পর্ব চাই, জলদি Smile

টুটুল's picture


অপেক্ষায় আছি পরের পর্বের জন্য Smile

প্রজ্ঞা মৌসুমী's picture


বন্ধুদের অসংখ্য ধন্যবাদ। এটা আমার প্রথম উপন্যাস লেখার প্রচেষ্টা, বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্য শুরুর দিকটা নিয়ে সমালোচনা, পরামর্শ পাওয়া। আমাকে উৎসাহ দিচ্ছেন তার জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা।

ক্লাস-পড়াশোনার জন্য লেখার গতি কমে গেছে, তবে আশা রাখছি তাড়াতাড়ি শুরু করবো।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

প্রজ্ঞা মৌসুমী's picture

নিজের সম্পর্কে

Smile

pragga'র সাম্প্রতিক লেখা